মুসলিম লীগের ভাবাদর্শ : ঐক্যফ্রন্টের ভিত্তি
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
🕐 ৯:৫৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০১৮
নির্বাচন, জোট, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকালীন সরকার এখন সর্বাধিক আলোচিত ইস্যু। তবে নির্বাচনের আগে জোট, জাতীয় ঐক্যজোট, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি আমরা লক্ষ করছি। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ স ম আবদুর রবের মতো ব্যক্তিদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যজোট প্রকৃত অর্থে কোনো জাতীয় জোট নয়।
বরং এটি আওয়ামীবিরোধী জাতীয় ঐক্যজোট। সরাসরি এই নামটি ব্যবহার করলেই ভালো হতো। অর্থাৎ বর্তমান সরকারবিরোধী জোট। তবে হাস্যকর হচ্ছে, জোটের অভ্যন্তরের অনেককেই আবার ড. কামাল হোসেনকে মাহাথির মোহাম্মদের মতো নেতার সঙ্গে কল্পনা করছেন। মাহাথির মোহাম্মদ সত্যিকার অর্থেই জনগণের নেতা। নেতার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, তার কিছু অনুসারী থাকতে হয়। যা না থাকলে নেতা হওয়া যায় না। অর্থাৎ নিজে নিজে পীর হওয়া যায় না, পীরের কিছু মুরিদ থাকতে হয়। সাবেক কয়েকজন নেতা এই জোট গঠন করেছে।
সাবেক বলছি এই জন্য, তাদের এখন আর কোনো অনুসারী আছে বলে জানা নেই। আ স ম আবদুর রব এক সময় ৭৬টি রাজনৈতিক দলের কম্বাইন্ড পজিশন ফ্রন্টের নেতা ছিল। গৃহপালিত বিরোধী দল। এখন জাতীয় পার্টিকে অনেকে এই বদনাম দেয়। আ স ম আবদুর রব তেমনি। জোটের আরেক নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি করেন। যিনি মনে করেন, জিয়াউর রহমানের ছেলে হওয়ার কারণেই তারেক জিয়া কোনো অপরাধ করতে পারেন না, তারেক জিয়ার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীকে দেখতে পান। আর একজন হচ্ছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। যিনি এ দেশের সব চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা। জোটের এই কয়েকজন ব্যক্তির কোনো দল নেই, অনুসারীও নেই। তাদের নেতা বলা যায় কি না, সন্দেহ আছে। তারা প্রকৃত অর্থে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির ওপর নির্ভর করছে।
জোটের এসব ব্যক্তি একদিকে বলছে জোটে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ থাকতে পারবে না এমন অনেক কিছুই। আবার অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধ্বংস করার অন্যতম সংগঠন বিএনপির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। এটা সবারই জানা, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা এখনো শেষ হয়নি। কোনো দিন শেষ হবেও না। কাজেই বিএনপি-জামায়াতকে মেনে নিয়েই জাতীয় ঐক্যজোট। এই জোট একদিকে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের কথাও বলে আবার অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্যতম প্ল্যাটফর্ম বিএনপির সঙ্গে জোট করছে।
এ অবস্থায় নৈতিকতার দিক থেকে চিন্তা করলে এই জোট ভিন্ন জিনিস। স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ন্যূনতম যে সমঝোতা থাকা দরকার, সে রকম কিছু এই জোটের মধ্যে আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য সময় দরকার। তবে পরীক্ষার সময় সম্মুখে। আগামী ৩ নভেম্বর বোঝা যাবে। কারণ, ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। কামাল হোসেনরা কি জেলহত্যা দিবস পালন করবে নাকি ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহী জনতা বিপ্লব পালন করবে। তখন জোটের পরীক্ষা হবে। আজকের কামাল হোসেনদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। এমন ভাবনা অবান্তর এবং কল্পনাতীত। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীর মতো নেতৃত্ব এই জাতীয় ঐক্যের মধ্যে আবিষ্কার করা কেবলই কল্পনা। বাঙালি এবং বাঙালিত্বের বিরুদ্ধে অন্যতম শক্তি ছিল মুসলিম লীগ। সেই মুসলিম লীগ এবং তাদের ঘরানার শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট। বাঙালির সবকিছুর বিরুদ্ধে ছিল এই মুসলিম লীগ।
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রসংগীত, পহেলা বৈশাখসহ বাঙালি কৃষ্টি-কালচারের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব ছিল মুসলিম লীগ। যেমনটি ছিল জামায়াতে ইসলামের। তারা ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। সেই মুসলিম লীগ, জামায়াত ’৭১-এর পরাজিত শক্তি। পরবর্তী সময়ে তারা সবাই মিলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। সেই মুসলিম লীগের ধারাবাহিকতার ফসল আজকের বিএনপি। মুসলিম লীগ ভাবাদর্শই লালন করে বিএনপি। কাজেই এখানে যত ফ্রন্ট কিংবা ঐক্য আসুক না কেন, সবাই মিলে একটি দলই সেই বিএনপি। কাজেই এই জোটের মূল দল হচ্ছে বিএনপি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট যে মতাদর্শের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সেই মতাদর্শকেই ধারণ করছে বিএনপি। কাজেই আজকের এই জাতীয় ঐক্যজোট ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিপরীত। এই জোট মুসলিম লীগ ঘরানার। কামাল হোসেনরা বলছেন, তাদের ঐক্যফ্রন্ট হচ্ছে কয়েকটি সম্মিলিত বিরোধী দল। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তা, ভারত বিরোধিতা, পাকিস্তানের নৈকট্য, এই হচ্ছে জোটের মতাদর্শ। যা বর্তমানে সুপ্ত থাকলেও নির্বাচনের সময় বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মতাদর্শগত দিক থেকে এই জোট মুসলিম লীগের মতাদর্শী। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই কামাল হোসেনদের ঐক্যফ্রন্ট হচ্ছে মুসলিম লীগের ভাবাদর্শের পতাকাবাহী। আর এই জোটের প্রকৃত একজন নেতা তারেক জিয়া। জোট নিয়ে চরম বিপরীতধর্মী অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে অন্যদিকে আবার আওয়ামী লীগবিরোধী। যেদিন এই আওয়ামীবিরোধী জোট গঠন করা হয়, সেদিন জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়। ড. কামাল হোসেন তার বক্তৃতার ১০ মিনিট ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুকে আনবো জেলের তালা ভাঙবো এরকম অনেক কিছুই বললেন।
এই যদি কামালদের বক্তব্য হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের নেতা, জয় বাংলা স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকারসহ সবকিছুই স্বীকার করতে হবে। জোটের অন্যরা যদি এই সবকিছু স্বীকার না করে কিংবা মেনে না নেয়, তাহলে ফ্রন্ট হবে কীভাবে? কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধীরা এক পাশে থাকলেও কতকগুলো মৌলিক বিষয়ে এক জায়গায় থাকতে হবে।
কাজেই আওয়ামীবিরোধী এই জাতীয় ঐক্যজোটের শেষ পরিণতি দেখার জন্য আমাদের আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। জাতির কাছে এখনো অনেক বিষয়ই পরিষ্কার নয়।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।