ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হ্যালো

ইমরুল কায়েস
🕐 ২:৫৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২২

হ্যালো

কথায় কথা টানে। বয়স জীবনে অভিজ্ঞতা আনে। কেউ দেখে শেখে, আবার কেউ ঠকে শেখে। সেলিমের এ জীবনে আর শিক্ষা হলো না। যতবারই ধোঁকাবাজি করে ধরা খেয়েছে ততবারই মনে মনে শপথ করেছে, জীবন থাকতে আর এ রকম করে কোনো যুবককে ঠকাবে না। এলাকা, পাশের থানা, জেলা সব জায়গায় সে মহাবাটপাড় নামে খেতাব অর্জন করেছে। সেলিমের প্রতিবছরের গণধোলাইয়ের পর মনে হয়, আর না। এখন থেকে গা ঘামিয়ে উপার্জন করা শুরু করবে। প্রতিবারই তার শপথ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় গভীর পূর্ণিমা রাতে পদ্মানদীর ফাঁকা তীরে। ওপরে ধূসর শামিয়ানার মতো খোলা আকাশ। নিচে ধবধবে সাদা বালিমাটি। আর আশপাশে পূর্ণিমার ঠিকরে পড়া চকমকে আলো। এমন পরিবেশেই এমনতর গুরুত্বপূর্ণ শপথ করা চাই। এ রকম করে কতবার যে সেলিম শপথ নিয়েছে তার হিসাব দিতে পারবে না; তবে শপথ ভাঙার দিনগুলো তার মনে আছে। কেন তার এই শপথ ভাঙার প্রয়োজন দেখা দিল।

প্রত্যেকটি শপথ ভাঙার জন্য সেলিমের যতটা না হাত থাকে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় সে এলাকার যুবকদের কা-কারখানা দেখে। দেশে নতুন মোবাইল আসার পর কী যে এক অস্থির ব্যাপারস্যাপার ঘটেছে! কে কার সঙ্গে পালিয়ে বাবুই পাখির সংসার রচনা করছে তার ঠিক নেই। এই মোবাইল ফোন এসে উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরা ও যুবতী-তরুণীদের ইটিস-পিটিস আরও উসকে দিয়েছে। একটা ফোন কানের সঙ্গে লেপটে নিয়ে সারাদিন কী যে গাজুর-গুজুর শুরু করেÑ চারদিকে মনে হয় দুনিয়া অন্ধকার। একমাত্র এই মোবাইল আর ওপারের ফিসফিসানিই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা। আহা ঢং দেখলে সেলিমের পিত্তি জ¦লে ওঠে। সেলিম আর নিজের শপথে ঠিক থাকতে পারে না।
সেলিম এমন ছিল না। মায়ের বড় আদরের সেলিম কিশোর পেরিয়ে যখন একটু একটু করে যৌবনের দখিনা হাওয়ায় গা ভাসাতে শুরু করেছে, তখন আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে, তার ভেতরে কেমন যেন একটু মেয়েলি স্বভাব প্রকাশ পাচ্ছে। সেলিমের তেঁতুল গাছ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। টক জাতীয় যে কোনো খাবারে তার অরুচি তো নেই-ই বরং দিনকে দিন লোভ বেড়ে যাচ্ছে। শরীরটা পুরুষের হলেও চিন্তা, রুচি ও অনুভূতিতে মেয়েলি প্রভাব। এমন কথা কি বাইরে বলা যায়! সেলিম নিজের ভেতরে নিজেই ঘুরতে থাকে। কী করবে, বুঝতে পারে না। ভাবনার কোনো কিনারা খুঁজে না পেয়ে পৃথিবীর মালিক স্বয়ং আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মানসিকভাবে তার ভেতরে যে পরিবর্তন চলে এসেছে তা হলো, অন্য ছেলেদের বা পুরুষ লোকদের হিংসে করা। বিশেষ করে তার সমবয়সী ছেলেদের ফুসুর-ফাসুর, মেয়েদের সঙ্গে তাদের কীর্তনলীলা দেখলেই তার হিংসার পারদ চরমে ওঠে। সেলিম আর স্থির থাকতে পারে না। আর এই স্বভাব যখন চাড়া দিয়ে ওঠে বিপত্তিটা ঘটে তখনই।
কিশোর বয়স পর্যন্ত সেলিমের মতো শান্ত-ভদ্রÑ যাকে বলে গো-বেচারা- গ্রামে দ্বিতীয়টি ছিল না। সেই সেলিমই আজ ঠকবাজ ও বাটপাড় হিসেবে এক নম্বর আসন অলংকৃত করছে। এ পথের শুরু সেলিমের এক রাতের গভীর স্বপ্ন থেকে। সেলিম সেদিন বাড়িতে ফিরেছে অনেক দেরি করে। ঘোর অন্ধকার। অমাবস্যার রাত। সেলিমের মা বাড়িতে নেই। বাড়িতে ঢুকতেই সেলিম উঠানের দক্ষিণ কোণের আড়ালে লক্ষ করে, ডালিম গাছের নিচে শাড়ির পাড় ছড়িয়ে যেন একটি নারীমূর্তি বসে আছে। আর যাই হোক, সেলিমের ভয়-ডর বলতে কিছু ছিল না। এই ভয় সেলিমের কেটেছে বিটিভির টিপু সুলতান সিরিজ আর ভিসিআরের নেশায়। ভূতপ্রেত যাই হোক না কেন, সেলিমের কুচ পরোয়া নেহি। সেলিম ডালিম গাছের দিকে আস্তে আস্তে এগোয়। যত এগোয় কাপড়টি তত পিছিয়ে যায়। সেলিমও ভিসিআর দেখার জন্য অনেক বড় বড় নদী সাঁতরে পার হওয়া ছেলে। ‘ভূত কোন মায়ের পুত’ বলে আরও এগোয়। সেলিম যতদূর আগায় ততখানির চেয়ে কাপড়টি বেশি দূরে চলে যায়। মূর্তিটা সেলিমের চেয়ে আরও দ্বিগুণ গতিতে পেছাতে থাকে। এবার সেলিমের ধৈর্যের সীমা মাপকাঠি ছেড়ে দেয়। সে আর কালক্ষেপণ না করে দৌড়ে গিয়ে মায়াবিনীর শাড়ির আঁচল ধরে ফেলে। ওমা! তবু থামল না মেয়েটা। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পেছন পেছন টেম্পোর ধোঁয়ার মতো ছেড়ে যাচ্ছে দীর্ঘতর শাড়ির বহর। ক্যাসিও ঘড়িতে ছোট সুচের বাটন চেপে আলো জ্বাালিয়ে দেখে, রাত কাঁটায় কাঁটায় বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পাকা অমাবস্যা। যে অমাবস্যাই হোক আজকে এর একটা বিহিত সে করবেই।
রাত কেটে সকাল হলে সেলিম দেখে, সে বাড়ির পেছনের দিকে মজা পুকুর ঘাটে পাকুর গাছের তলে। ঘটনা কী? চোখ কচলাতে কচলাতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। না জানি মা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। পরের রাতে সেলিম স্বপ্নে দেখল, কে যেন তার গলায় কাপড় পেঁচিয়ে ধরে আছে। হাঁসফাঁস করছে। গলা থেকে কাপড়টা কোনোভাবেই সরাতে পারছে না। চিৎকার করতে করতে হঠাৎ লক্ষ করল, তার গলা দিয়ে মেয়েদের মতো মিহি আওয়াজ বের হচ্ছে। যত জোরে কথা বলতে চাইছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে তার গলার মেয়েলি কণ্ঠটা। সেলিমের ঘুম ভেঙে গেল ফজরের আজান শুনতেই। আজকে এই স্বপ্ন দেখে তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। গলা শুকিয়ে গেছে সেলিমের। ঘরের কোনায় বাঁশের মাচায় রাখা মাটির কলস থেকে এক ঘটি জল নিয়ে পান করল। স্বপ্নে দেখা কাপড় পেঁচানোর মতো করে তার স্যান্ডো গেঞ্জি গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে কথা বলা শুরু করল। আস্তে করে ডাকল, মা!
সেলিম নিজেই নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। একদম মেয়েদের গলার মতো শোনা যাচ্ছে। বেশ সুমিষ্ট ও মধুুর। এই কারিগরি কা- দেখে তার আগের রাতের কাপড়ের কাহিনি মনে পড়ে গেল। সেলিমের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। কী করবে ভেবে পায় না। সেলিম দরজা জানালা লাগিয়ে দিল। লুুঙ্গির পোঁচ খুলে নাভির নিচে তাকিয়ে দেখল, সব ঠিকঠাক আছে কিনা! না, সব ঠিকই আছে। এবার সেলিমের কলিজায় পানি এলো। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে বেরিয়ে পড়ল।
সেলিমের এই এক বড় সমস্যা। সে ছেলে-ছোকরাদের এই নতুন যন্ত্রটা নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে টাঙ্কি মারা একদম দেখতে পারে না। তার হিংসে হয়। এ জাতীয় যুবকদের জ¦ালাতন করার উপায় খুঁজতে থাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেলিমের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। আরে, এ অস্ত্র তো তার কাছেই আছে। সমস্যা হলো, মোবাইল ফোন নেই তার। দেশে কেবল ইটের দলার মতো মটোরোলা মোবাইল এসেছে। আরেকটা কী মোবাইল যেন এসেছে। সাইজে ছোট। নকিয়া না যেন সুখিয়া। তার একটা এই সুখিয়া মোবাইল চাই-ই। একটি নকিয়া ফোন কিনে সেলিম শুরু করে দিল তার অভিনব স্বপ্নের রিহার্সেল। গলায় কাপড় পেঁচিয়ে পাড়ার যে ছেলেটির মোবাইল ফোন ছিল তাকে কল দিয়ে সুললিত কণ্ঠে বলল, হ্যালো...।
মিষ্টি-মধুর হ্যালো ডাক শুনে কত যুবক যে রাতারাতি সেলিমের কণ্ঠের প্রেমে মজে গেল তার ইয়ত্তা নেই। সেলিমের ঠিকানায় প্রতিদিন হাজারো দামি দামি গিফট আসা শুরু হয়। ক্যামেরা, টিভি, কাপড়-চোপর, ঘড়ি, গহনা ছাড়াও কত কী! সেলিম অবশেষে আয়ের একটি দারুণ উৎস পেয়ে গেল।
কথায় আছে না, গিরির একদিন, চোরের দশদিন। সেলিমের ব্যবসা জমজমাট। একদিন গভীর রাতে সেলিম গলায় কাপড় পেঁচিয়ে কথা বলছে। হুট করে তার দুলাভাই দেয়াশলাই নেওয়ার জন্যে ঘরে ঢুকে পড়ে। কণ্ঠ শুনে দুলাভাই সন্দেহ করে, শ্যালকবাবু ঘরে কোনো মেয়ে ডেকে এনে গল্প করছে হয়তো। সেলিম দুলাভাইকে বিশ্বাস করাতেই পারছে না, ঘরে আর কেউই নেই। সেলিম পড়ে গেল মহাবিপদে। দুলাভাইয়ের হাত থেকে নিস্তারের জন্যে আপন ভেবে গোপন আয়ের কথাটি বলেই ফেলল। দুলাভাই তো নতুন ধান্ধা পেয়ে মহাখুশি। সেলিমের পার্টনার বনে গেল তার আপনজনও। একে সুখী হয়। দুয়ে হয় খুনোখুনি। তিনে মহামারীর রূপ নেয়। গুণিজনের কথা। জানাজানি হলে সেলিমের কপালে আর টানল না। হ্যালো ব্যবসা গেল...। গ্রাম্য সালিশ, বিচার, শাস্তি, জরিমানা সব হতে হতে সেলিমের নাম হয়ে গেল হ্যালো সেলিম। প্রতিবার বিচার-সালিশ আর শাস্তির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আয়োজনের সঙ্গে শপথ করে, আর করবে না এসব।
আবার মোবাইল ফোন নিয়ে কারও ফুসুর-ফুসুর দেখলেই তার হ্যালো খেলায় মেতে ওঠার নেশা ধরে যায়। তখন মনে মনে বলে, কে যে এই হ্যালো রোগ নিয়ে এলো! তাকে পেলে ঢেঁকির গর্তে ফেলে ধান কুটার মতো করে কুটে ফেলতাম!

 
Electronic Paper