ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সমকাল ও মহাকালের যুগলবন্দি লেখমালা

অর্বাক আদিত্য
🕐 ২:৫৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২২

সমকাল ও মহাকালের যুগলবন্দি লেখমালা

সভ্যতার বিনির্মাণ একদিনে হয়নি। হয়ও না। অনেক যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীর অবদানের ফসল আজকের সভ্যতা। সমাজ সভ্যতার জন্য সক্রেটিসের আত্মদান যেমন সত্য, যেমন সত্য রবীন্দ্রনাথের প্রেম; তেমনি কিছু সত্য এখনো ঘটে চলেছে। যদিও সময়টা স্বার্থবাদিতার। মোহজর্জরিত।

সবাই ব্যক্তিগত আখের গোছানোর ধান্ধায় সর্বদা ব্যস্ত। সময়, সমাজ, সভ্যতা নিয়ে ভাবার মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যারা ভাবেন তারা সংখ্যালঘু। শহীদ ইকবাল; এই সংখ্যালঘুগণের অন্যতম। মর্মরিত উষাপুরুষ যেভাবে বলেন, ‘এমন কোনো কাজ নেই, যা শহীদ ইকবাল করতে পারতেন না কিন্তু মানুষকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে, সময় সমাজকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এক মহান ব্রতে, যেখানে ব্যক্তিগত কিছু না পাওয়া আছে, কিন্তু আত্মতৃপ্তি রয়েছে।’ সারা জীবনটাই ভেবে যাচ্ছেন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে। বিশ^বিদ্যালয়পড়–য়া একজন তরুণ কী করে সঠিক পথটা দেখবেন, সেই পথটা দেখাচ্ছেন। একজন মহৎশিল্পীর কাছে যেমন পৃথিবীর পার্থিব ধনসম্পদ চাওয়া-পাওয়া যেমন তুচ্ছ, নির্মোহ মানুষকে যেমন হতে হয়, ঠিক সেই শিক্ষাটাই তিনি দিয়ে যাচ্ছেন।
কাজী মামুন হায়দার শহীদ ইকবাল সম্পর্কে যেমনটি বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য, আমাদের প্রেরণা।’ এসব কথা বলার একটা কারণ আছে। শহীদ ইকবালের পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে লেখমালা শহীদ ইকবালকে নিয়ে ক্রোড়পত্র করেছে। লেখমালা’র রুচিজ্ঞান সম্পর্কে যারা অবগত আছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, সিলেকটিভ কাজ করে যাচ্ছে লেখমালা। এর আগে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও ক্রোড়পত্র করেছে। লেখমালা’র ১২তম সংখ্যাটি প্রকাশ পেয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ। সেখানে ক্রোড়পত্রের সঙ্গে নিয়মিত আয়োজন রয়েছে। আছে করোনাকালের কবিতা, গুচ্ছ কবিতা, পা-ুলিপি এবং করোনাকালের গদ্য। মোটকথা একই সঙ্গে মলাটবন্দি হয়েছে সমকাল এবং মহাকাল। সমকাল এই অর্থে যে সময়টা চলছে মহামারীর, পুরো পৃথিবীজুড়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনটা স্থবির হয়ে পড়েছে, তাহলে কি অস্বাভাবিক চলছে? তাহলে কেমন চলছে, তারই উপস্থাপনা ঘটেছে কবিতায় ও গদ্যে। গত শতকের আশির দশকের শক্তিমান কবি হাফিজ রশিদ খানের ‘করোনাকালের একগুচ্ছ কবিতা’ দিয়ে শুরু এ সংখ্যার লেখমালা। নিয়মিত বিভাগের অন্যান্য পার্সেভশনে আছেন তরুণ কবি গালিব রহমানের অপ্রকাশিত পা-ুলিপি ‘সে এবং উদ্বাস্তু কোরক’; করোনাকালের গদ্যে আছেনÑ আরেক শক্তিমান কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, বীরেন মুখার্জী, হাসানআল আবদুল্লাহ, তুষার প্রসূন, নূর-ই আলম সিদ্দিকী, বঙ্গ রাখাল, রহিম আবদুর রহিম এবং এস এম মুকুল। এরা সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। যেখানে মানুষই প্রধান হয়ে উঠেছে।
এবার আসি ক্রোড়পত্রে, যেটি আমাকে সর্বাধিক হর্ণ করেছে, আকর্ষণ করেছে বা যে উপলক্ষটির কারণে লেখমালা প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলাম এবং প্রকাশের পরপরই সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করেছি। শহীদ ইকবাল একই সঙ্গে সাহিত্যের অধ্যাপক, ছোটকাগজ সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। ক্রোড়পত্র অংশে তার সমগ্র সত্তাটিকে ধরার প্রয়াস করা হয়েছে এবং বোঝা যায় সম্পাদকের এ বিষয়ে আন্তরিকতার অভাবও ছিল না। প্রথমে মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন বস্তুনিষ্ঠ অথচ সংক্ষিপ্ত করে আলোচনা করেছেন, প্রাবন্ধিক শহীদ ইকবালের এবং তার বিষয় নির্বাচন নিয়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে শহীদ ইকবালের তিনটি বইয়ের কাটাছেঁড়া করেছেন। এরপরে আছেন অনিরুদ্ধ কাহালি, প্রকৃতপক্ষে সমগ্র শহীদ ইকবালকে অনুধাবন করে, সবচেয়ে কার্যকরী আলোচনাটি তিনি করেছেন। শহীদ ইকবালের ‘বিশ শতকের রূপকথার নায়কেরা’ নিয়ে, ভাষা ব্যবহার, কাহিনি বিন্যাস এবং শহীদ ইকবালের কথাগুলো যে নিজের কথাই হয়ে উঠেছে, যেমনভাবে বড়শিল্পীদের কাজ সর্বজনীন করা সেটিই তিনি খুঁজে পেয়েছেন। সংগঠক হিসেবে, ‘চিহ্ন’ সম্পাদক হিসেবে একই সঙ্গে কাজ এবং কাজটিকে উপর্যুক্ত মানুষের কাছে পৌঁছানোর বিষয়ে তার সততার কথা আলোচনা করেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক, সবেমাত্র শহীদ ইকবাল বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন, সেই সময়ে, যখন ইলিয়াসকে নিয়ে বাজারে একটা কাজও নেই দু-একটা প্রবন্ধ হয়তো কেউ কেউ লিখছেন, বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্য তখন তাকে নিয়ে কাজ করা, দুঃসাহসই বটে। সেই কাজটি কীভাবে সহায়ক হয়ে উঠেছিল তৎসময়ে তারই ফিরিস্তি দিয়েছেন।
গৌতম গুহ রায়, সুহৃদ শহীদ ইকবাল এবং ‘বিশ শতকের রূপকথার নায়কেরা’র ভেতরের যে মননশীল শহীদ ইকবাল সেটিকে তুলে ধরেছেন। মোস্তাক আহমেদ শহীদ ইকবালের সমগ্র কাজ নিয়েই উপশিরোনামায় লিখেছেন। এবং স্বীকার করেছেন, শহীদ ইকবালের সবচেয়ে ঈর্ষণীয় কাজ ‘বাংলাদেশের সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’। মাসুদার রহমান এবং নিত্য ঘোষ অন্বেষণ করেছেন উপন্যাসের ভেতরে আন্তরিক শহীদ ইকবালকে। এর পরই রয়েছে লেখমালা’র সম্পাদক কবি মামুন মুস্তাফার নেওয়া শহীদ ইকবালের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ‘প্রকৃত সাহিত্যই প্রকৃত অবমুক্তি’ শিরোনামায় সংযুক্ত হয়েছে। সেখানে লেখালেখি, সংগঠন, তরুণদের নিয়ে ভাবনা, সময়ের প্রকৃত সন্তান কারা, এই সময়ে রাজনীতি কেমন চলছে, মানুষের জীবনমান প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে।
ঝকঝকে ছাপা, আইয়ুব আল আমিনের করা নান্দনিক প্রচ্ছদ এবং সর্বোপরি লেখমালা’র ছোট্ট পরিসরে বড়কে ধরার যে আগ্রহ সেটি যেকোনো পাঠককে চমৎকৃত করবে।

 
Electronic Paper