ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুখভরে ডাকি প্রাণভরে ডাকি...

রুমানা নাওয়ার
🕐 ১:১৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০১, ২০২১

মুখভরে ডাকি প্রাণভরে ডাকি...

আমার মা যাকে আম্মা ডাকি মুখভরে প্রাণভরে। এ ডাকে কোনো খাদ নেই চাওয়া পাওয়ার হিসেব নেই। আছে শুধুই ভালোবাসা। আমার আম্মা মরজিয়ানা বেগম। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলায় পাইন্দং ইউনিয়ন এর বিখ্যাত তোরাবিয়া পরিবারে জন্ম। বাবা শহিদুর রহমান চৌধুরী মা জাহানারা বেগম। সাত বোন তিন ভাই এর মধ্যে আম্মার অবস্থান তৃতীয়। বড়ভাই আবু তাহের চৌধুরী অধুনা লুপ্ত স্টিল মিলের লেবার অফিসার ছিলেন। মেজভাই ডক্টর আবু আজম হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছোটভাই নাসের রহমান অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনতা এবং সোনালী ব্যাংক এবং বর্তমানে ডিএমডি হিসেবে এসআইবিএল এ কর্মরত।

আম্মার নানাবাড়ি ফরহাদাবাদ চুন্ন মিঞা চৌধুরী বাড়ি। নানার নাম হাজী চুন্ন মিঞা চৌধুরী। সমাজসেবী একনামেই পরিচিত। তার তিন ছেলে মৌলানা আফজাল হোসেন চৌধুরী নাজিরহাট কলেজ, নাজিরহাট কলেজিয়েট স্কুল, নাজিরহাট আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সুলতান আহমদ চৌধুরী জেনারেল ফিজিশিয়ান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। এবং দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী শিশু বিশেষজ্ঞ। তারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। সুলতান মাহমুদ চৌধুরী রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরম আস্থার এবং কাছের মানুষ ছিলেন। আমার নানি ছিলেন তখনকার দিনে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থী।

আমার মা আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মায়ের একজন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় সর্বদা উন্মুখ থাকা এক রমণী। নিজের জন্য ভাবতে দেখিনি কখনো। সন্তান সংসার স্বামী আত্মীয় পরিজন নিয়ে ব্যস্ত সমস্ত দিন পার করা এক অনন্য অসাধারণ মা আমার। চেনা অচেনা আত্মীয় অনাত্মীয় সবার জন্য আমার মা’র সমান চিন্তা।

আমার বড় চাচা (এহায়া মিঞা সিকদার সুন্দরী) আর বনেদি পরিবার দেখে মাকে ভ্রাতৃবধূ করে নিয়ে আসেন ঘরে। দীঘল চুল সুঠাম দেহের অধিকারী আমার মাকে বড় চাচা খুব স্নেহ করতেন। আমার একমাত্র ফুফু সংসারপনায় আনাড়ি আমার মাকে সব শিখিয়ে দেখিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী করে তোলেন। যৌথ পরিবারে প্রথম সংসার শুরু আম্মার। বড় চাচির সঙ্গে থেকে থেকে যৌথ পরিবার একান্নবর্তী পরিবেশে আম্মা ভড়কে না গিয়ে মানিয়ে নিয়েছিলেন সব। নতুন নতুন বাবার বাড়ি গেলে আর আসতে চাইতেন না নাকি আম্মা। আমার নানা বুঝতেন মেয়ের মনোভাব। হাজার হলেও নিজের রক্ত। পরম আদরের সন্তান শ্বশুরবাড়িতে বড় পরিবারে মানিয়ে নিচ্ছে হাজার কষ্ট হলেও। নানা তার মেয়েদের পড়াশোনা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আম্মা এবং বড় খালাকে (ফরিদা ইয়াসমিন) শহরে তাদের খালার বাসায় রেখে পড়াশোনা করান। নগরীর গুলএজাহার বেগম সিটি করপোরেশন স্কুলের ছাত্রী আম্মা, বড় খালা। তখনকার দিনে নারী শিক্ষার ঘোর বিরোধী সময়ে আমার নানা মরহুম শহিদুর রহমান চৌধুরী তার সাত মেয়ে তিন ছেলেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবীও ছিলেন। গরিব অসহায় মানুষকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অর্থনৈতিকভাবেও সাহায্য করতেন। তিনি মসজিদ, সবুজবাগ স্কুল এবং পাইন্দং হেদায়েতুল ইসলাম উলুম দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা এবং আরও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে প্রভূত জায়গা জমি দান করেছেন।

সুন্দরী বিদূষী স্ত্রীকে নিয়ে আব্বার খুব অহংকার ছিল। আমাদের পুরো বাড়িতে আম্মা আস্তে আস্তে তার জ্ঞান প্রজ্ঞা দিয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া আনলেন। নামে দামে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নিলেন ধীরে ধীরে। চম্পা, কলি, শাকেরা, চেমন আরা ভাসুর জার সন্তানদের সবার নাম রাখা থেকে শুরু করে প্রাগ্রসর সব কাজ আম্মাই করতেন। নতুন বিবাহিত জীবন আব্বা ও চাকরিসূত্রে পুরো সপ্তাহ বাইরে আম্মা ও মনপ্রাণ উজাড় করে করতেন এসব কাজ। আমার বড় জেঠী মা আম্মাকে সাহায্য করতেন সব কাজে ( ফকির চাচার মা, আবুল বড়দার মা)। নানির কাছে গেলে আর ফিরতে মন চাইত না তার।

আম্মার প্রথম সন্তান জন্ম নিল বাবার বাড়িতে। আমার নানি নাতনিকে কোলে নিয়ে নাম রাখলেন মিলন। মিলনের বারতা হয়ে আসল যেন সে। চাঁদ মুখের মতো সুন্দর মেয়েকে নিয়ে আম্মার নতুন জীবন আব্বার। আব্বার ও আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার অবস্থা। আমার ফুফুও ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। ফুফুর মতোই দেখতে সুন্দর হয়েছে আম্মা আব্বার প্রথম সন্তান। তারপর একে একে জন্ম নিলাম আমরা সব ভাইবোন। সবাই সমান আদর স্নেহে মানুষ হয়েছি। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম বা বেশি না। বড় ভাইয়ার (আবু জাফর মাহমুদ) প্রতি আম্মার যে আবেগ মেজো ভাইয়া (সাজ্জাদ মাহমুদ) আর মুরাদের প্রতিও সমান আবেগ তার। বড় আপার (মিলন) জন্য যে ভালোবাসা নীলু আপা রিটা আপা ঝুমা আমার জন্যও তার একই রকম ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া। আর এখন তো সব আদর স্নেহ মায়া রূপান্তর হয়েছে তার নাতি নাতনিদের কাছে। তাদের না দেখে আম্মা থাকতে পারেন না। ছেলের বউরা আম্মার বন্ধুর মতো। শাহিনা মুশাররাত মৌসুমি, রুবিনা ইয়াসমিন সুমী, মাফরুহা মারিয়া তিন বউ আম্মার কাছে তার মেয়ের মতো তাদের কাছে সব কিছু শেয়ার করেন। ভালোবাসেনও মায়ের মতো করে। বউরাও শাশুড়ি অন্তপ্রাণ। বাড়ির সব বউরা আম্মার পরম সজ্জন মেয়ের মতো। তারা ও শাশুড়ি মা’র অনুরাগী। মেয়ের জামাইরা আমার মায়ের স্নেহমায়া ভালোবাসায় আকুল হন। আসলে সবাইকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখাই যেন আম্মার কাজ।

আমার মা পরম দানশীল মহিলা। পারিবারিকভাবে এ গুণটা পেয়েছেন তিনি। গরিব অসহায় নিরন্ন মানুষকে সাহায্য করেন অকাতরে। এলাকার অসহায় মানুষের আস্থার নাম আমার মা। খাওয়াতে ভালোবাসেন মানুষকে। সে কাছের দূরের যেই হোক। না খেয়ে খালি মুখে আমাদের ঘর থেকে কেউ ফেরত গেছে তার নজির নেই। নিজ এলাকায় লোকের মুখে মুখে ফেরে তার এসকল গুণের কথা।

মা বাবার আদর শাসন ভালোবাসা থাকলে সে পরিবারের ছেলেমেয়েরাও সেভাবে বেড়ে ওঠে। জানতে শিখে পরিবারের বন্ধনটা কী ? বুঝতে শিখে এর মহত্ব গুরুত্ব। সন্তানরাও সেভাবে মানুষ হয়, চলতে শিখে।

একটা পরিবারের বন্ধন মজবুত হয় মা-বাবার কারণে। যে পরিবারে মা শক্ত হাতে দশ দিক সামলে সন্তানদের মানুষ করেন সে পরিবারটা শক্ত ভীতে দাঁড়িয়ে যায়। আর তার সঙ্গে দরকার পারিবারিক বন্ধন। মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা এসব যেখানে থাকে সেখানটায় বন্ধনটাও দৃঢ় হয়। আমার মা আমাদেরও সে মন্ত্রণায় উদ্দীপিত করেছেন। তার মায়া দিয়ে ছায়া দিয়ে মমতার বাঁধনে আজও আমাদের আগলে রেখেছেন। জীবনের এ নির্ভার সময়ে এসেও আমার মা সন্তানের চিন্তায় পরিবেশ প্রতিবেশীর চিন্তায় উদ্বেলিত থাকেন। পাড়া প্রতিবেশী সবার পরম আপনজন তিনি। সবার মঙ্গল কামনায় উন্মুখ থাকেন সবসময়। বাড়িতে গেলে দেখে যান আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা। আদর আপ্যায়নেও তিনি সেরা। অনেককে তো বলতেই শুনি- উনি না থাকলে আর বাড়িতে কেউ থাকবে না নাকি মন খুলে কথা বলার।

আমার আম্মা এমনই একজন মহিলা। যিনি শুধুই ভালোবাসতে জানেন মায়া বিলাতে জানেন। গরিব অসহায় মানুষের কাছে তিনি দানশীল এক মানবী। যখন যাকে দেন প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত দেন। গরিব আত্মীয় পরিজন, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে তিনি পরম আস্থার নাম। খাওয়াতে দিতে আম্মার জুড়ি মেলা ভার। সেটা যখন যেভাবে হোক। দেওয়াতেই তার আনন্দ। সবাই কে নিয়ে আঁকড়ে বেঁচে থাকাতে তার আনন্দ। সবার দুঃখ সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাতে তার আনন্দ। আব্বার মৃত্যু আম্মাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল।

জীবনের পরম পাওয়া মানুষটিকে হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসলেন আমার মা। আব্বা মারা যাওয়ার দশ বছর হতে চলল একটা দিনও দেখিনি তাকে চোখের পানি না ফেলতে। প্রায় প্রতি রাতে আব্বাকে স্বপ্নে দেখে দেখে দিন কাটে আম্মার। আমাদের বলেন আর কাঁদেন। আব্বা কখনো চা খেতে চান আবার কখনোবা এটা সেটা খুঁজে দিতে বলেন আম্মাকে।

হারানোর শোক আম্মার বেশি। তেরো চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়ে রিবনকে হারিয়ে পাগলিনীর মতো হয়ে গিয়েছিলেন। সারাক্ষণ মেয়ের স্মৃতি হাতড়ে কান্না করতেন। আমার মা দুঃখিনী মা সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে অন্য আর সব সন্তানকে বুকে জড়িয়ে থাকেন সবসময়। চোখের আড়াল হতে দেননা কাউকে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য তার সমান চিন্তা। সবাই তার সন্তান আর পুরো দেশটা যেন তার পরিবার। খুবই রাজনীতি সচেতন আম্মা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শে বিশ্বাসী। দেশ ও দশের চিন্তায় উদগ্রীব আমার মা আসলেই দেশপ্রেমিক এক নারী। এমন মায়ের সন্তান হতে পেরে সত্যিই গর্ব অনুভব করি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আল্লাহর কাছে চাওয়া আমার মা যতদিন আমাদের মাঝে থাকেন সুস্থ সুন্দর হয়ে যেন বেঁচে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা আম্মাকে নেক হায়াত দান করুন।

রুমানা নাওয়ার : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

 
Electronic Paper