ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাস্তব ও কল্পদৃশ্য

শফিক হাসান
🕐 ২:৫৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৬, ২০২১

বাস্তব ও কল্পদৃশ্য

হিরণ্ময় হিমাংশু ওরফে তালুকদারের গদ্যকবিতা যে এতটা বোকা বানাবে, বুঝতে পারলে অন্য কিছু পড়ার চেষ্টা করতাম। অন্তত পাহাড় থেকে মাটিতে পড়ার কসরত চালানো যেত! এটাও জানি, চাইলেও পারব না। গদ্যকবিতার ফাঁদ এড়িয়ে যাব কোথায়!

তালুকদার অনেকদিন পর ফেসবুকে কবিতা পোস্ট দিলেন। পড়ে মনে মনে বাহ্বা দিলাম, অনেকদিন পর ভালো কিছু লিখেছেন। এ কবিই কাব্যশ্রী পদক পাওয়ার যোগ্য। সংশ্লিষ্টরা যথার্থ কবিকে পুরস্কৃত করতে পারেন। মনে মনে পিঠ চাপড়ে দিলাম তালুকদারের, সহজবোধ্যে ফিরেছেন বলে। এর আগে দুর্বোধ্য কবিতা লিখে অনেকেরই বিরক্তিভাজন হয়েছেন। গালিও খেয়েছেন প্রচুর। তালুকদারের কাব্যগুরু দিনাজপুরের মনীষী একটি শব্দ লেখেন তিন লাইন জায়গা ব্যয় করে!

পরদিন হাসনাত মোবারক মারফত জানলাম, তালুকদার মারাত্মক অসুস্থ। শয্যাশায়ী। ফল নিয়ে দেখতে যাওয়া আবশ্যক।
খবরটা উড়িয়ে দিলাম। কাল রাতেই তো চমৎকার কবিতা পড়েছি। সেই তিনি কখন অসুস্থ হলেন! হাসনাত জানালেন, ওটা গদ্যকবিতা নয়, অ্যাকসিডেন্ট ও রোগের বিবরণ!

কী শুনলাম! গদ্যকবিতার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া জরুরি। যেটা কেবলই বিভ্রান্তি ছড়ায়, সেই বগিজগির পাঠক না হওয়াই ভালো!

তালুকদারবিষয়ক জটিলতার এখানেই শেষ নয়। একদিন বাসে চড়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইল যথারীতি। তালুকদার বললেন, ‘কবি!’

ছোকরা কন্ডাক্টর হকচকিয়ে গেল। ছাত্ররা অর্ধেক ভাড়া দেয়। অছাত্ররা ভাড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য ‘ছাত্র’ পরিচয় দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো পরিচয় শুনতে হয় না। কবি-ভাড়া চালু হলো কবে? তালুকদারের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে কন্ডাক্টর বলল, ‘তাইলে কবি-ভাড়াই দ্যান!’

এমন না-হক আবদারে চেতে গেলেন তালুকদার- ‘টাকা দিমু কোইত্থে? জানোস না ব্যাটা, কবিগো কাছে টাকা থাকে না!’

রাষ্ট্রে সাম্যাবস্থা থাকলে কবিরা কীভাবে মূল্যায়িত হতেন, এমন কথার তুবড়ি ছুটতে থাকে। বাদানুবাদে সুবিধা করতে না পেরে কন্ডাক্টর গেল ড্রাইভারের কাছে- ‘ওস্তাদ, এক কবি উঠছে। হেয় নাকি ভাড়া দিব না!’

ড্রাইভারও চেতল- ‘ওইসব কবি-ছবি তোলোস ক্যান?’

কন্ডাক্টর রাগ-উত্তেজনার যুগপৎ মিশ্রণে বলল, ‘হালায় যে কবি আগে বুঝমু ক্যামনে!’

তালুকদার-পর্ব আপাতত শেষ। নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাই।

আমাদের বাসায় একজন কবি আসবেন। এমন না যে বাসায় আগে কোনো কবি আসেননি। এহসান হায়দার, অরবিন্দ চক্রবর্তী এসেছেন কয়েকবার। পরবর্তীকালে আরও কেউ কেউ। নূরজাহান রোডে বাসাটির নাম ‘স্মৃতিরেখা’। এই স্মৃতিরেখা এত মানুষের স্মৃতিধন্য তাহলে চিন্তা কেন! চিন্তাটা এজন্য, কবি এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে চান। তিন রুমের ফ্ল্যাটে আমরা ১০ জন সদস্য। প্রথম রুমে মাসুদ রানা, আমি এবং আরেকজন। সেই ‘আরেকজন’ চলে গেছেন। শূন্যস্থান পূরণ করতে আসছেন কবি মহোদয়।

চিন্তার কারণ থাকত না- যদি লোকটা কবি না হতো! মাসুদ ভাইয়ের চিন্তার শেষ নেই; রাতে ভালো ঘুম হয় না! উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছেন। এখন মাসুদ ভাইয়ের কাজ হচ্ছে, দুর্ভাবনায় ভোগা আর গজগজ করা- ‘শালা কেমন কবি হবে, কবিদের মতো কবি নাকি মানুষের মতো কবি! যদি সত্যিকারের কবি হয়, তাহলে সমূহ বিপদ!’

বিপদ ডেকে এনেছে আমাদের বন্ধু তাহিয়া পাপড়ি। তার অনুরোধ নাকচ করতে পারেননি মাসুদ ভাই। ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়ে এখন ধরতে পারছেন না, ছাড়তেও পারছেন না! কবি-বিষয়ে মাসুদ ভাইয়ের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমারও ভালো অভিজ্ঞতা নেই তেমন। দুজনেই পোড়খাওয়া।

প্রতিদিন সকালে ও রাতে মাসুদ ভাই আর আমি বাসায় একত্র হই। শূন্যস্থানের দিকে তাকিয়ে (যে জায়গাটায় কবির ওঠার কথা) দীর্ঘশ্বাস ফেলি। অসহায়ভাবে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। সুখের দিন কি তবে ফুরিয়ে এলো? অঘটনের নানা ভবিষ্যৎ চিত্র ভেসে ওঠে চোখে। কতভাবেই না আমরা কল্পনার রঙে রাঙাই-

প্রথম কল্পদৃশ্য : কোনো একদিন কবি বাজারে গেছেন। সওদাপাতি, চাল-ডাল না এনে নিজেই লাপাত্তা! ফোনকল রিসিভ করছেন না। রাতে বাসায় ফিরে কৈফিয়ত দিলেন- ভুলেই গিয়েছিলাম আজ আমাদের কবি সম্মেলন ছিল!

কেউ একজন বোঝানোর চেষ্টা করবে- আমরা নয়জন লোক সারাদিন অভুক্ত...! কবি বিরক্ত হয়ে বলবেন, আরে ধুর! কবিতার চেয়ে খাওয়াটাই বড় হলো!

দ্বিতীয় কল্পদৃশ্য : এক রাতে গোটা বিশেক অপরিচ্ছন্ন লোক বাসায় এসে হাজির। রুমমেট কবির সঙ্গে তারা শুরু করলেন ফ্লোর টেবিল বৈঠক। আলোচনার বিষয় : বিগত বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি। গ্যাজানো, হৈ-হুল্লোড় চলবে রাতভর। থেকে থেকে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া আর গাঁজার কটু গন্ধ নাকে ধাক্কা দেবে। অন্য সদস্যরা ঘুম-ঘুম চোখে দরজা আলতো ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করবে, গভীর রাতে হট্টগোল কীসের।

তৃতীয় কল্পদৃশ্য : বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হয় ১০ তারিখের মধ্যে। এক মাসে এমন হবে- ২৫ তারিখ চলে যাচ্ছে, কবির তাড়না নেই। টাকার জন্য নিরন্তর তাগাদা দিতে থাকলে উল্টো একসময় বিরক্ত হয়ে কবি মাসুদ ভাইকে বলে দেবেন- এবার আপনিই চালিয়ে দিন। নতুন কিছু কবিতার বই কিনে টাকা খরচ করে ফেলেছি। পারলে আমার ফোনে অল্প এনে দিয়েন!
এভাবে পরপর তিন মাস! যেহেতু রেফারেন্স মাসুদ ভাই, তিন দুগুণে ছয় হাজার টাকা তাকেই পরিশোধ করতে হবে! বাড়িওয়ালা এধরনের সমস্যার কথা শুনবেন কেন! বিত্তবানরা কি জানে কবিদের কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়। এসব সামলাতে সামলাতে মাসুদ ভাইয়ের নিজের অবস্থাও তলানিতে পৌঁছে।

এরকম আরও কল্পদৃশ্য আশঙ্কা হয়ে উঁকি দেয়। ভাবতে ভাবতে মাসুদ ভাই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন! জল্পনাকল্পনা শেষ হয় একদিন। বাক্স-পেটরা নিয়ে কবি বাসায় ওঠেন। কী আশ্চর্য, এত ভালো-গোছানো রুমমেট অতীতে কখনোই পাইনি। মাসুদ ভাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সেই ভদ্রলোক কবির নাম তুষার প্রসূন।

কবিতা যতটুকু আনন্দ দেয়, কবিরা দেন ঢের বেশি! ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনকে নিয়ে অনুষ্ঠান ছিল পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার হলে। স্মরণসভা, আলোচনা, কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান। উপস্থাপক নিবেদিত কবিতা পড়ার জন্য জনৈক কবির নাম ঘোষণা করলেন। হুঁশিয়ারি দিলেন, কোনো ভূমিকা কিংবা বগিজগি চলবে না, শুধু আবৃত্তিটুকু। অনেকেই আছেন, মূল বক্তব্য যতটা, তারচেয়ে বেশি দেন ভূমিকা!

কবি মঞ্চে উঠে শুরু করলেন প্রাচীনকালের ইতিহাস! তারা ভাসানী পরিবারের মানুষ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল পরিবারের, আর সেই ভাসানীরই শিষ্য আবদুল মতিন। কবি বলে চলেন নিরন্তর...। পেছন থেকে উপস্থাপক মৃদু গুঁতা মারলে সহকারী উপস্থাপন চাপা গর্জন করেন। কিন্তু কবি কার পরোয়া করেন! অব্যাহত চাপ সামলাতে না পেরে কবি একসময় বলে উঠলেন, এমন করলে তো হবে না! আমাকে বলতে দিতে হবে। আমি রাষ্ট্রীয় কবি, কবির মর্যাদা বুঝতে হবে!

উঠেছিলেন কবিতা পড়তে, শেষমেশ কবিতা না পড়ে অসমাপ্ত বক্তব্য দিয়ে পুনরায় নিজ আসন অলঙ্কৃত করলেন। এরপর যে কবি মঞ্চে উঠলেন তার কবিতার শিরোনাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। ১৩ মার্চ ২০১২ সালে শিল্পকলা একাডেমির ক্যান্টিনে কোন মেয়ের সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল, মোগলাই পরোটা খেতে খেতে কীভাবে সেই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন- অনুপুঙ্খ বিবরণ। সুন্দর একটা লাইনও বললেন, ‘আমি জন্মগ্রহণ করেছি একবার, তুমি আমাকে বিজয়ী করেছ বারবার’। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এমপি। হাসি ঠেকাতেই কি তিনি বিপরীত দিকে তাকিয়ে ছিলেন! নিজে দমফাটা হাসি সংবরণ করেছি অনেক কষ্টে!

সাহিত্য সম্পাদক কর্তৃক কারও কবিতা ছাপা হওয়ার নেপথ্যে অনেক রকম ফিকির ও বাণিজ্য থাকে। দুলাভাই নাজির হুসেন যখন দু’হাতে কবিতা লেখা শুরু করলেন, আমার কাজ ছিল কবিতাগুলো বিভিন্ন কাগজে পাঠানো। দুলাভাই ক্ষমতাধর কেউ নন, আমিও কাউকে তোয়াজ করে চলি না। কবিতা আর ছাপা হয় না! মাস দুয়েক পর এক সম্পাদক কল করলেন আমাকে- ‘ভাই, কবিতাটা কি ছাপতে হবে?’

ভড়কে গেলাম। এটা কেমন কথা! বললাম, ‘বেশি খারাপ হলে ফেলে দেওয়াই ভালো। তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, কবিতাগুলো ছাপা না হলে আমার বোনের সংসারে ভাঙন ধরবে না।’

অবশেষে কবিতা ছাপা হলো। কিছুদিন পর দুলাভাই জানালেন, সম্পাদক এবার গুচ্ছকবিতা ছাপতে চান! দুলাভাই খুশি হলেও আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে!

কে যে কখন কী হাসিলের জন্য কার কবিতা ছাপতে চান, বোঝা মুশকিল!

এরপর সংকলনে ছাপা হলো দুলাভাইয়ের কবিতা। সম্পাদক কল করে বললেন, ‘প্রকাশনা অনুষ্ঠানের ছবি ও খবর ফেসবুকে পোস্ট করেছি। নাজির হুসেনের নামও দিয়েছি। ফেসবুকে! কবিকে জানিয়ে দিও।’ বুঝলাম না, ফেসবুকে কেউ কারও নাম লিখলে সেটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে হয়!

বইমেলায় মোড়ক উন্মোচন শেষে একটি বই কিনে উপহার দিলাম দুলাভাইকে। রাতে বাসায় ফিরলে আপা বললেন, ‘আঁর জামাই কবি অই গেছে। আঁর আর কিছু লাইগদ ন!’

কবি-কবিতা নিয়ে আরও কত-শত গল্প; সহজেই ফুরোবার নয়! এরই মধ্যে নতুন একটি চরিত্র ফেঁদে বসেছি- মিজানুল হক। দুটি গল্প লেখাও হয়েছে। সময় ও সাহসের জোগান নিশ্চিত হলে মিজানুল হক নিশ্চয়ই ফিরবে আবার!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper