ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সারা বছরই থাকবে ডেঙ্গু

প্রয়োজন সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
🕐 ৩:৫১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০২১

সারা বছরই থাকবে ডেঙ্গু

করোনার অতিমারীতেও এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক। এ রোগ ভয়াবহ আকারে ছড়ানোর কারণ কী, এডিস মশা ও ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং জনগণের করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী ড. কবিরুল বাশার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খোলা কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু হয়েছিল ২০১৯ সালে। জুন, জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর- এ চার মাস ডেঙ্গু মৌসুম। তবে এবার অক্টোবরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের মৌসুম পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতি বছর অক্টোবরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে আসে। কিন্তু এ বছর অক্টোবরেও বৃষ্টিপাত হওয়ায় এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। ফলে এ মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। এখন থেকে বাংলাদেশে সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গু রোগী থাকবে। কেননা, এডিস মশার প্রজননের যে উপযুক্ত তাপমাত্রা, তা শীতকালেও বিদ্যমান থাকে। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হলে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়বে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়বে। বৃষ্টিপাত কম হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম থাকবে।

ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু কত সালে?
১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। তখন ডেঙ্গুকে বলা হতো ঢাকা ফিভার। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। এরপর প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু এডিস মশার কামড়ে হয়। এডিস মশার দুটি প্রজাতি রয়েছে। একটি হচ্ছে এডিস এলবোপিকটাস আর একটা এডিস ইজিপটাই। এ ইজিপটাই মশাই হচ্ছে ৯৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগের বাহক। ঢাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ এই এডিস ইজিপটাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জনসংখ্যার আধিক্য অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। এ বিষয়ে আপনার কী মন্তব্য?
ঢাকা শহরে বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা বা জরিপ করে দেখেছি, অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে এডিস মশার নিবিড় সম্পর্ক আছে। এডিস ইজিপটাই মশাকে নগরের এবং গৃহপালিত মশা হিসেবে ধরা হয়। ইংরেজিতে ডমিস্টিক মসকিউটো বলে। যে মশা ঘরের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে, বিশেষত বাড়ির পাশে, বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে। নির্মাণাধীন ভবন এডিস মশার প্রিয় আবাসস্থল। ঢাকা শহরে অনেক ভবন নির্মাণে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যা এডিস মশার প্রজননের সুযোগ তৈরি করে। মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?
মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। এ সমন্বিত ব্যবস্থাপনার চারটি অংশ রয়েছে। তা হলো-
১. পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ : পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার কারণে মশার জন্ম হয়। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে মশাকে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ জলাধার পরিষ্কার এবং বিভিন্ন পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
২. জীবজ নিয়ন্ত্রণ : উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। উদাহরণস্বরূপ গাপ্পি মাছের কথা আমরা জানি, যার মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে অল্প খরচে টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কপিপোড এবং এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহারও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। এ জাতীয় জীবজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
৩. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ : মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট ডোজ এবং কত দিন পর পর কোন মাত্রায় ব্যবহার করতে হবেÑতারও একটি নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক কীটনাশকের ব্যবহার করলে অবশ্যই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক জনগণের কাছে সহজলভ্য হতে হবে। যেন মানুষ সহজেই এ কীটনাশক কিনে তার বাড়ি ও আশপাশে মশক নিধনে ব্যবহার করতে পারে।
৪. জনগণের অংশগ্রহণ : জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

সিটি করপোরেশনের মশকনিধন ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ রয়েছে। সিটির মশকনিধন প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
সমন্বিত মশকনিধন ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকে নির্দিষ্টসংখ্যক জনবল দিয়ে কাজ সম্পাদন করার প্রয়াস নিতে হবে। যেমন-
১. এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান : একটি ব্লকের জন্য একজন এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান থাকবে, যিনি তার ব্লকের প্রতিটি বাড়ির মশাবাহিত রোগের খবর রাখবেন। তার ব্লকে কোথায় মশা জন্মানোর স্থান আছে সেটি কিউলেক্স মশা, না এডিস মশা-সে রেকর্ড তার কাছে থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তার ব্লকের মানুষকে সচেতন করা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব তার টিমের থাকবে।
২. স্প্রেম্যান : প্রতিটি ব্লকে দুজন করে স্প্রেম্যান থাকবেন, যারা সকালে লার্ভিসাইড এবং বিকালে এডাল্টিসাইড স্প্রে করবেন। প্রতি তিন দিন পরপর অবশ্যই একটি এলাকায় লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড স্প্রে নিশ্চিত করতে হবে। এটি নিশ্চিতকরণের দায়িত্বে থাকবেন একজন ওয়ার্ড সুপারভাইজার। তিনি আঞ্চলিক কীটতত্ত্ববিদকে রিপোর্ট করবেন।
৩. ক্লিনার : প্রতি ব্লকে ক্লিনার থাকবেন। ক্লিনারের কাজ আটকে যাওয়া ড্রেন, ডোবা, নর্দমার পানি প্রবাহিত রাখা। আবদ্ধ পানিতে মশা জন্মে। সঙ্গে সঙ্গে তার টিম ব্লকের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পাত্র যেখানে এডিস মশা জন্মানোর আশঙ্কা আছে সেগুলো পরিষ্কার রাখা। এ কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময়োপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জাম ও কীটনাশক নির্দেশিকা এ গাইডলাইনে থাকবে।

মানুষের শরীরে হুল ফুটানো কি মশার জীবন-মরণের বিষয়?
মজার তথ্য হলো পুরুষ মশা কিন্তু রক্ত খায় না। স্ত্রী মশা রক্ত খায়, যখন তার পেটে ডিম আসে। কারণ রক্ত না খেলে তার ডিম বাচ্চাতে রূপান্তরিত হয় না। এজন্য বাচ্চা ফোটার জন্য মা মশা রক্ত খায়। স্ত্রী মশার পেটে গড়ে ১৫০-২০০টি ডিম থাকে। যখন সে মনে করবে এই ডিমের ব্ল্যাড প্রোটিন ফুল হয়েছে, তখন সে রক্ত নেওয়া বন্ধ করে দেবে।

২০১৯ সালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে লন্ডন থেকে ‘ভদ্র মশা’ আমদানির চিন্তা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কি?
এটি ল্যাবে তৈরি করা এক ধরনের মশা। ওলবাকিয়া নামক একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সংক্রমিত করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিলে সেগুলো প্রকৃতিতে যে মশা আছে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য গ্রহণ করার আগে গবেষণা দরকার। বাংলাদেশেই এ মশা তৈরি করা সম্ভব। মশা আমদানি করে দেশের টাকা খরচ না করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের দেশেই এ কাজ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে কত প্রজাতির মশা রয়েছে?
বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুই ধরনের মশা ঢাকা শহরে খুবই প্রভাবশালী। একটি এডিস অপরটি কিউলেক্স। মশার প্রতিটি প্রজাতির প্রজনন, আচরণ ও রোগ বিস্তার ক্ষমতা ভিন্ন। সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আলাদাভাবে নিতে হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকে কীভাবে দেখছেন?
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সেন্টার তৈরি করতে পারে, যেটির নাম হতে পারে বাংলাদেশ ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার। এ সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। এ সেন্টারে বছরব্যাপী মশা, অন্যান্য বাহক ও কীটনাশক নিয়ে গবেষণা হবে এবং তারাই নির্দেশনা দেবে কখন কোন কীটনাশক কোন বাহকের জন্য ব্যবহৃত হবে। বাহকের আচরণ এবং নতুন নতুন বাহকের ক্ষেত্রে কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে, সেটির দায়িত্ব তাদের ওপর থাকবে। এই সেন্টারে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দিতে হবে। এই সেন্টার দেশব্যাপী মশা ও অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের বাহকের আচরণ, প্রজনন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। সঙ্গে সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণের আধুনিক সরঞ্জাম ও কীটনাশক সরবরাহ কররে।

এই মুহূর্তে ডেঙ্গু চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সেটি করার আগে ওই হাসপাতালগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং ডেঙ্গু পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অবস্থা বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল। বিশেষায়িত হাসপাতালের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালেও ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা জরুরি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিবার কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে?
আমাদের জানা উচিত, কীভাবে আমরা আমাদের পরিবারকে ডেঙ্গুমুক্ত রাখতে পারব। ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সফল হয়নি। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি। সপ্তাহে অন্তত একদিন আপনার বাড়ি এবং বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখতে হবে, কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমে আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে তা পরিষ্কার করতে হবে। যদি পাত্রটি এমন হয় যে পানি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না তাহলে সেখানে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার বা লবণ ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। নগরে এডিস ইজিপটাই মশা জন্মানোর জন্য অন্যতম স্থান ড্রাম, টায়ার, বালতি, যে কোনো ধরনের মাটির পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা, কিউরিংয়ের পানি জমার স্থান বিশেষ করে বেজমেন্ট। মনে রাখবেন, আপনার-আমার বাড়ির আশপাশে পানি জমে থাকা পাত্রে এডিস মশার জন্ম হয়। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে ডেঙ্গুমুক্ত থাকা যাবে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
খোলা কাগজ পরিবারের জন্য শুভ কামনা।

 
Electronic Paper