জিতু মামার বদলি বৃত্তান্ত
শিমুল শাহিন
🕐 ৪:৪৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৫, ২০২১
কয়েকদিন আগে জিতু মামা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারি চাকরি, তার ওপর পুলিশ বিভাগে; সবার খুশির অন্ত নেই। সবার মতো জিতু মামাও বেজায় খুশি, কারণ তার দেশসেবা করার দীর্ঘদিনের স্বপ্নটা পূরণ হতে চলেছে। এরই মধ্যে মামা ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন তিনি তার চাকরির প্রথম কর্মস্থল হিসেবে পেতে চান রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বা বান্দরবান।
কথার কথা নয়, তিনি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগও করে ফেলেছেন। তাদের অনুরোধ করে জিতু মামা বলেছেন সম্ভব হলে তাকে যেন খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি বা বান্দরবান এলাকাতেই পোস্টিং দেওয়া হয়। জিতু মামার সঙ্গে আফরোজা মামির বিয়েটা চাকরি হওয়ার কিছু আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দুই পরিবারের মধ্যে সিদ্ধান্ত ছিলÑ জিতু মামা কোনো একটা চাকরিতে ঢুকলেই ভালো একটা দিন দেখে বিয়ের অনুষ্ঠানটা সেরে নেওয়া হবে।
পার্বত্য অঞ্চলে জিতু মামা স্বেচ্ছায় পোস্টিং চাচ্ছেন শুনেই তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠলেন আফরোজা মামি। অবশ্য তিনি বারবার জিতু মামাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। আফরোজা মামি একসময় আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র শিক্ষার্থী ছিলেন। জিতু মামা আর উনার সম্পর্কের শুরুটা আমার হাত ধরেই। এ সূত্র ধরেই তাদের ভিতরের টুকটাক সমস্যার সমাধান আমাকেই দিতে হয়। সেজন্যই তাদের মধ্যে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে সেটা আমার কাছে খুব বেশি গোপন থাকে না। জিতু মামার পোস্টিং সংক্রান্ত ঝামেলা ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আফরোজা মামির মতো আমিও মামাকে নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি। জিতু মামা আর আমার বয়সের ব্যবধান খুব একটা বেশি নয়। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি বলে জানি জিতু মামা কতটা একগুঁয়ে।
আফরোজা মামি নিতান্ত বাধ্য হয়েই তাই শরণাপন্ন হয়েছেন দুই পরিবারের মুরব্বিদের। জিতু মামার পরিবারের সদস্যরাও মামার এরকম গোয়ার্তুমির কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। নানি একমাত্র ছেলে এতদূরে চলে যাবে ভেবে মুষড়ে পড়েছেন। কিন্তু জিতু মামার সেসবেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, উল্টো গোঁ ধরে বসে আছেন। কারও কথাতেই তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছেন না। তার এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী তা জানার জন্য দুই পরিবারের লোকজন আজ রাতে এক হয়েছে। আফরোজা মামির বাড়ি থেকে সবাই এসেছে মামাদের বাড়িতে। বসার ঘরে নানাজানের সঙ্গে আমার আব্বা-আম্মা ও আফরোজা মামির বাড়ির সবাই একত্রিত হয়েছেন। হালকা চা চক্রের পর কথা উঠল জিতু মামার পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। মামা এমনভাবে শক্ত হয়ে বসে আছেন, যেন মনে হচ্ছে তার পেটে গ্রেনেড মারলেও মুখ দিয়ে কথা বের হবে না।
একপর্যায়ে নানা জিতু মামাকে তার সিদ্ধান্তের সপক্ষে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মামা সোজাসাপ্টা বললেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ওখানে যেতে চাচ্ছি। এমন তো না ওখানে মানুষ চাকরি করে না, সবাই এলিয়েন!’ মামার এমন উত্তরে কেউই সন্তুষ্ট হলেন না। সবাই বিভিন্নভাবে তাকে বোঝালেন, কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। হঠাৎ মুখ খুললেন আফরোজা মামি। বাড়ির হবু বউ বলে ঘরের কোনায় চুপটি করে বসেছিলেন এতক্ষণ। কাঁদো কাঁদো স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি ঠিক বুঝেছি ওর ওখানে যেতে চাওয়ার কারণ!’ আফরোজা মামি কথা বলতেই ক্যামেরার মতো সবার দৃষ্টি পড়ল তার ওপর। সবাই বলে উঠল, ‘কী কারণ?’ আফরোজা মামি নানির দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আম্মা, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনার ছেলের ভার্সিটিতে পড়ার সময় ওইদিকের একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। নিশ্চয়ই এখন পুরনো প্রেম জেগে উঠেছে। তারই টানে সে ওখানে যেতে চাচ্ছে।’
সবাই হায় হায় করে উঠল। আফরোজা মামির দিক থেকে সবগুলো দৃষ্টি সরে এসে পড়ল জিতু মামার ওপর। আফরোজা মামির মুখে এমন কথা শুনে হা হয়ে গেছেন মামাও। সবার অনুসন্ধিৎসু চেহারা দেখে তিনি বললেন, ‘প্রেম ছিল না, তবে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে দীর্ঘদিন কথা নেই। আর আমার ওদিকে যাওয়ার কারণটাও আদৌ সে নয়।’
নানি অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকালেন মামার দিকে। তারপর রাগীস্বরে বললেন, ‘তাহলে? কোনো একটা নির্দিষ্ট কারণ দেখাও, নয়তো বউমার সন্দেহটা অমূলক নয় ধরে নেব।’
জিতু মামা বেশ বিপাকে পড়লেন। কয়েকদিন ধরে তিনি এ বিষয়ে একদম ‘নো টক’ মুডে ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন তার মুখ বন্ধ রাখার আর কোনো সুযোগ নেই, নইলে সবাই ধরে নেবে আফরোজার কথাই ঠিক।
নিতান্ত বাধ্য হয়ে জিতু মামা চিকন গলায় বললেন, ‘আসলে ছোটবেলায় সিনেমাগুলোতে দেখতাম, কিংবা পেপার পত্রিকায় প্রায়ই পড়তাম পুলিশকে সবসময় হুমকি দেওয়া হয় খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি বা বান্দরবানে বদলি করে দেওয়ার!’
কপালে কিঞ্চিত চিন্তার ভাঁজ ফেলে মুখ খুললেন আফরোজা মামির বাবা রহমান সাহেব। তিনি বললেন, ‘সে তো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসারদের ওখানে পাঠানো হয়। তোমার মনে ঘুষ-দুর্নীতির বদমতলব নেই তো বাবা?’
তার দিকে তাকিয়ে জিতু মামা উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই না!’
‘তাহলে?’
যোগ করলেন মামা, ‘ওখানে যে শুধু দুর্নীতিবাজদের পাঠায় বা পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয় সেটাও তো না। কোনো পুলিশ সৎ থাকলে তার দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতনরাও তাকে সেসব জায়গায় বদলি করে দেওয়ার হুমকি দেয়! ফলে ধীরে ধীরে সৎ পুলিশটিও দুর্নীতি মেনে নিতে বাধ্য হয়!’
‘সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু সেটার সঙ্গে তোমার ওখানে যাওয়ার কী সম্পর্ক?’ মুখে একটুকরো মুচকি হাসি এনে মামা বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম একজন সৎ পুলিশ অফিসার হব। কিন্তু সৎ থাকতে গেলে কোনো না কোনো সময় আমাকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলির ভয় দেখান হতে পারে। তাই আমি আগেই ওখানে যেতে চাচ্ছি, যাতে ভবিষ্যতে বলতে পারি- আমাকে ওখানে বদলির ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, আমি স্বেচ্ছায় একসময় ওখানে পোস্টিংয়ে ছিলাম।’
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228