ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম মনীষীদের অবদান-৪

বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা (পর্ব-২)



মুহাম্মাদ নাঈমুর রহমান সা’দ
🕐 ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১

বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা (পর্ব-২)

সারা থেকে দীর্ঘ তিন মাস যাত্রা করে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে গজনি পৌঁছেন তিনি। যাত্রাপথে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ শহর সমরকন্দ এবং আফগানিস্তানের কিছু সময় কাটান। ১৩৩৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবে পৌঁছেন ইবনে বতুতা। পাঞ্জাবে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ইবনে বতুতার আগমন বার্তা মুলতানের গভর্নর এবং দিল্লির বাদশাহর কাছে পৌঁছানো হয়। তখন দিল্লির বাদশাহ ছিলেন মোহাম্মদ শাহ। ভারতে এসে ইবনে বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেন।

ইরাক ও পারস্য

১৭ নভেম্বর, ১৩২৬ সালে ইবনে বতুতা মক্কা থেকে ইরাকগামী একটি কাফেলার সঙ্গে যোগ দেন। এরপর নাজাফে হযরত আলী (রাঃ) এর মাজার জিয়ারত করেন। মাজার জিয়ারত শেষে কাফেলাটি ইরাকের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু ইবনে বতুতা কাফেলার সঙ্গে যোগ না দিয়ে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরার দিকে রওনা দেন। বসরা থেকে তিনি যাত্রা করেন পারস্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্পাহানের দিকে। ইস্পাহান থেকে তিনি রওনা দেন শিরাজ শহরে। সে সময় শিরাজ শহরটি মোঙ্গলদের আক্রমণে বিপর্যস্ত ছিল। এরপর ১৩২৭ সালের জুনে তিনি বাগদাদে এসে পৌঁছেন।

ইবনে বতুতার বর্ণনানুযায়ী, ১২৫৮ সালে চেঙ্গিস খাঁর নাতি হালাকু খানের সৈন্যরা বাগদাদ আক্রমণে করে। কিন্তু তখনও আক্রমণের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল বাগদাদ শহরে। তিনি বাগদাদের সম্রাট আবু সাঈদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি সম্রাটের রাজকীয় কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়ে সিল্ক রোড হয়ে তাবরীজ শহরে যান। জুলাই মাসে তিনি পুনরায় বাগদাদের উদ্দেশে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে মসুল, সিজরা, মারদিন শহরগুলো ভ্রমণ করেন। পথিমধ্যে একটি আশ্রমে তিনি কুর্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। কুর্দিদের কাছ থেকে তিনি বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা উপহার পান। এখান থেকে আরেকটি কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়ে মক্কায় এসে দ্বিতীয়বার হজ করে পরবর্তী তিন বছর মক্কায় অবস্থান করেন।

মধ্য এশিয়া

মক্কায় হজ পালন শেষে আরো এক বছর অবস্থান করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন ভারতবর্ষের সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে চাকরি করবেন। ১৩৩৬ সালে কাফেলার খোঁজে তৎকালীন আনাতোলিয়া বর্তমানে তুরস্কের দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে ব্যবসায়ীরা সচরাচর ভারতের উদ্দেশে ব্যবসা করতে যেত।

১৩৩৪ সালের শেষের দিকে কন্সট্যান্টিপোলে পৌঁছোন। এটাই ছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের বাইরে ইবনে বতুতার প্রথম সফর। তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল শহরের বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন। তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন সেন্ট হেলেনা গির্জায় কথা। এ গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন আসাফ, বেরেচিয়াহর ছেলে। তিনি ছিলেন হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর ভাতিজা। গ্রিকদের যত গির্জা আছে সেন্ট হেলেনা তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চারদিক দিয়ে দেয়ালে ঘেরা গির্জাটি একটি ছোট শহরের মতো মনে হয়। কিছুদিন কনস্ট্যান্টিনোপল থাকার পর ইবনে বতুতা আস্ত্রখানে ফিরে এসে দেখেন সুলতান তুঘলক তার রাজধানীতে সারাতে চলে গেছেন। তার রাজধানীতে গিয়ে সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতবর্ষ এবং চীনের উদ্দেশে রওনা করেন।

ভারতবর্ষ

সারা থেকে দীর্ঘ তিন মাস যাত্রা করে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে গজনি পৌঁছান তিনি। যাত্রাপথে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ শহর সমরকন্দ এবং আফগানিস্তানের কিছু সময় কাটান। ১৩৩৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবে পৌঁছান ইবনে বতুতা। পাঞ্জাবে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ইবনে বতুতার আগমনবার্তা মুলতানের গভর্নর এবং দিল্লির বাদশাহর কাছে পৌঁছানো হয়। তখন দিল্লির বাদশাহ ছিলেন মোহাম্মদ শাহ। ভারতে এসে ইবনে বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেন।

বাংলাদেশ ভ্রমণ

ইবনে বতুতা তার বিখ্যাত গ্রন্থে তৎকালীন বাংলা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তার বর্ণনা থেকেই বের হয়ে আসে তৎকালীন আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজব্যবস্থা, মানুষের জীবনাচরণ এবং রাজনৈতিক কাঠামো।
ইবনে বতুতা ৯ জুলাই, ১৩৪৬ সালে বাংলায় এসে পৌঁছান। তিনি প্রথমে বাংলার যে অংশে প্রবেশ করেন তার গ্রন্থে তিনি সেই জায়গার নাম উল্লেখ করেছেন সাঁদকাও (চাটগাঁও) সেখান থেকে তিনি কামরূপের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন। তার গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, একটানা ৪৩ দিন সাগরে ভেসে আমরা বাংলাদেশে এসে পৌঁছালাম। সবুজে শ্যামলে ঘেরা বিশাল এক দেশ। এখানে প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিস এত সস্তায় পাওয়া যায় যা অন্য কোথাও আমি দেখিনি। তবে দেশটির কিছু হতাশাব্যঞ্জক দিক রয়েছে খোরাসানের (আফগানিস্তান) লোকেরা দেশটিকে বলে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা জাহান্নাম।

ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায় তৎকালীন বাংলাদেশ ১ দিরহাম দিয়ে আটটি মুরগি পাওয়া যেত। এছাড়া এক দিরহাম দিয়ে ১৪টি কবুতর পাওয়া যেত। দুই দিরহামে পাওয়া যেত একটি ভেড়া। দাস-দাসী কিনতে পাওয়া যেত এক স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও কম মূল্যে।

তৎকালে এখানকার শাসক ছিলেন সুলতান ফখরউদ্দিন। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার প্রধান উদ্দেশ ছিল হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। শাহজালাল (রহ.) এর পাহাড় থেকে অনেক দূরেই দুজন অনুচরের সঙ্গে দেখা হয় ইবনে বতুতার। তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, শাহজালাল (রহ.) আদেশ দিয়েছেন পশ্চিম থেকে একজন পর্যটক তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন।

সারা যেন তাকে স্বাগত জানিয়ে তার দরবারে নিয়ে আসেন। অথচ ইবনে বতুতার সঙ্গে শাহজালালের (রহ.) ইতিপূর্বে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি এবং তার আগমনের কোনো খবরও তিনি শাহজালাল (রহ.)-কে দেননি। এখান থেকে ইবনে বতুতা শাহজালাল (রহ.) এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে অবগত হন। শাহজালাল (রহ.) ইবনে বতুতাকে একটি ভেড়ার পশমের পোশাক উপহার দেন। ইবনে বতুতা তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,
শাহজালাল (রহ.) একটি পাহাড়ে বসবাস করতেন। দুধ এবং মাখনের জন্য সেখানে ছাগল পুষতেন। তার সহযোগীরা ছিল সবাই সুঠাম দেহের অধিকারী। তারা কেউই এদেশীয় ছিল না।

এরপর সেখান থেকে সোনারগাঁ আসেন তিনি। সেখানে কিছুদিন থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তার বর্ণনা মতে, সাঁদকাও আসা থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা উদ্দেশে রওনা দেওয়া পর্যন্ত প্রায় দুই মাস বাংলায় অবস্থান করেন (১৩৪৬ সালের জুলাই ও আগস্ট)।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৩৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মক্কায় এসে পৌঁছান। মক্কায় হজ সমাপ্ত করে ওই বছরই ফেজ হয়ে নিজের দেশ তাঞ্জিয়ারে পৌঁছান। তাঞ্জিয়ারে পৌঁছানোর পর তিনি জানতে পারেন তার মা ইন্তেকাল করেছেন। জীবনের পরবর্তী অংশগুলোতেও তিনি তার ভ্রমণ থামিয়ে রাখেননি। আল-আন্দালুজ, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, সাহারা মরুভূমি, মালিসহ সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন।

মুহাম্মাদ নাঈমুর রহমান সা’দ
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 
Electronic Paper