ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বস্ত্রবালিকাদের প্রেম দাও

অরিত্র দাস
🕐 ১২:২৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১

বস্ত্রবালিকাদের প্রেম দাও

ভোরের সূর্য উদিত হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই যাদের ব্যস্ত মৌমাছির মতো ভনভন করে রাগ-পায়ে সম্মুখের পানে ছুটতে দেখা যায় এবং সন্ধ্যেবেলায় সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তে, ছোট একটি মলিন ঘরের দিকে ক্লান্ত-দুঃখ-বিষণœভরা মুখ নিয়ে যাদের ফিরতে দেখা যায় তাদের নাম বস্ত্রবালিকা। অথচ তাদের চোখে-মুখে নেই কোনো উদ্বেগ। নেই ভোগ-সুখের অপরিমেয় বাসনা। আছে শুধু নির্বাণের গাঢ় আকাক্সক্ষা। দুরন্ত এই পৃথিবীতে, যান্ত্রিক এই নগরীতে মাঝে মাঝে চলন্ত গাড়ি চলন্ত ট্রেনেরও কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু বস্ত্রবালিকাদের দু-চাকার শরীরবাহী বাহন যেন কখনই থামে না। তাদের চলার পথে কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, পুলিশের সিগন্যাল নেই, রোদ নেই, মেঘ নেই, তাদের ছুটে চলা বহমান নদীতে কোনো ভাটা নেই। সেখানে আছে অবিরাম জোয়ার। জোয়ারের প্রতিকূলতায় অত্যন্ত সন্তর্পণে ছুটে চলা তারা এক একজন নির্ভীক বস্ত্রনাবিক।

জীবনযুদ্ধে তারা এক একজন পরাক্রমশীল বিক্রমশীল যোদ্ধা। তাদের জীবনে একটাই ঋতু-বর্ষাকাল। তাদের পঞ্জিকায় একটাই মাস-শ্রাবণ। তাদের একটাই ধর্ম-পরিশ্রম। তাদের চোখে বিস্মৃত একটাই স্বপ্ন-তিনবেলা ভাত। তাদের একটাই উৎসবের দিন- যে দিনটিতে তারা ন্যায্য মজুরি পায়। তাদের একটাই আনন্দ- বেঁচে আছি তো! তারা যখন থেমে যায় তখন সমগ্র বাংলাদেশই যেন থেমে যায়। তারা যখন দৌড়ায় সমগ্র দেশ তাদের সঙ্গে দৌড়ায়। তারা যখন কাঁদে তখন বাংলাদেশও কাঁদে। তারা যখন হাসে তখন বঙ্গমাতা হাসে। তাদের সুই ফোটানো হাতের আঙ্গুলে আন্দোলিত হয় অর্থনীতি। কিন্তু হিংস্র বাস্তবতার এই পুঁজিবাদী অর্থলোলুপতার সমাজে, তাদের হাসিমুখ দেখতে পারে না কতিপয় ধনলিপ্সু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী।

তারা চায় নারীর সস্তা শ্রম, নারীর শেষ রক্তবিন্দুর সঙ্গে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা। কোনো নারীর চোখের দিক তাকালে বোঝা যায়, সে সুখে আছে নাকি অসুখে। বেদনাহত বস্ত্রবালিকাদের ভরাটহীন চোখের পাতায় বাংলা বর্ণমালায় সারিবদ্ধভাবে লেখা থাকে- ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট, অভাব, অসুখ, দরিদ্রতা, বেদনা এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়ার তীব্র জ্বালা। ওই চোখে তাকানো যায় না। তাকানো গেলেও স্থির থাকা যায় না। অস্থির করে তোলে তাদের নিদারুণ অসহায় জীবনপ্রবাহ। যেখানে সহায় হওয়ার মতো এ বঙ্গদেশে কোনো সহায়ক ব্যক্তি যেন নেই!

রজনীগন্ধার বোঁটার মতো ঈষৎ নত হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় বস্ত্রবালিকারা। ডানে বামে সামনে পেছনে কোনোদিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধ হয় না তাদের। পাশে কোনো সুপুরুষ বিশাল তার পৌরুষ বাহু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোন রূপসী কন্যাটি কী রঙের পোশাক পরেছে, কে কতখানি মুখে পাউটার মেখেছে তা দেখার সময় নেই। তাদের সময় নেই দামি প্রসাধনী নিয়ে চিন্তা করার। তাছাড়া কোনো পুরুষ লাল চোখে তার দিকে তাকাল কিনা, শিষ দিল কিনা, সরস আলোচনা করল কিনা ও ভালোবাসার প্রেমপত্র-নিয়ে সামনে এলো কিনা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না বস্ত্রবালিকারা। তারা চিন্তিত তিনবেলা খাওয়ার পয়সা নিয়ে। তাদেরও একটি শরীর আছে, শরীরের অবাধ্য চাওয়া আছে কিন্তু এগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এসব নিয়ে ভাবে দামি শার্ট, ব্রান্ডের ঘড়ি, দামি পারফিউম ও ব্রান্ডের জুতা পরিহিত রঙিন ঝলমলে পরিবারের ছেলেমেয়েরা।

যারা নিরুদ্যমভাবে ব্র্যান্ডের পণ্য এবং বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর মধ্যে কাটিয়ে দেয় তাদের সম্ভাবনাময় জীবন। এদিক থেকে বস্ত্রবালিকারা তথাকথিত আধুনিক বিত্তবান সমাজের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অধিক মাত্রায় সভ্য প্রগতিশীল বাস্তবতাবাদী এবং আধুনিক। তাদের মনের গহিনে একটাই প্রতীতি- সমুখে দুস্তর শান্তি পারাপার, ভাসাও দুপায়ের তরণী, যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছানো চাই কারখানার আঙ্গিকে, সঙ্গে নিয়ে অফুরন্ত মনোবল তার।

কণ্ঠশিল্পী জেমস ২০০৫ সালে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ অ্যালবামে বস্ত্রবালিকাদের নিয়ে একটি গান গেয়েছেন। এ গানে নগরবাউল জেমস বস্ত্রবালিকাদের সামগ্রিক অসহায়তা, অমানুষিক কষ্টের স্থির চিত্র সুরের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। সেখানে বস্ত্রবালিকাদের নাম দিয়েছেন দিদিমনি- লাল টুকটুক সেলাই দিদিমনি। আমাদের সেলাই দিদিমনিদের কেউ ভালোবেসে লাল গোলাপ দেয় না। যে চাওয়া, তাতে প্রেম থাকে না, মায়া থাকে না। থাকে লোভ। যখন বিভিন্ন প্রতিকূলতায় পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে, তখন বাধ্য হয় কিছু বিষয় মেনে নিতে।

প্রতিটি মানুষ চায় তাকে কেউ ভালোবাসুক। সপ্তাহে না হোক, মাসে অন্তত কেউ একজন বলুক- ভালো আছ তো? সে দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দিদিমনিরা এগুলো আশাও করে না। তারা আশা করে, রাত পেরিয়ে আগত নতুন দিনটি যেন একটু ভালো কাটে। তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারে, কোনোভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে চায় তারা। চায় সন্তান মানুষ করতে। তাদেরও স্বপ্ন আছে, আছে বুকভরা না বলা কথা। আছে পুরুষের প্রতি ক্ষোভ। কথা দিয়ে কথা না রাখার ক্ষোভ। তারপরও তারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নতুন জীবনের উপলক্ষে পা বাড়ায় নতুন উদ্যমে। শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধের মূলনীতি হলো- ‘শ্রমিকের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসম্পাদন এবং সম্পাদিত কাজ অনুযায়ী শ্রমের মূল্য পরিশোধ’। আমাদের সমাজে যারা সব থেকে পরিশ্রমী তাদের পারিশ্রমিকই সবচেয়ে কম। বৃক্ষকে যেমন প্রতিনিয়ত আলো জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তেমনি একটি রাষ্ট্রের গতিশীল চাকা শ্রম ও অর্থ দিয়ে চলমান রাখতে হয়। বাংলাদেশে কাজটি অনেকাংশে করছে বস্ত্রবালিকারা। তাদের জীবন কারখানা নামক বন্দি সেলাই ঘরে আবদ্ধ এবং আবদ্ধ বস্তির ভাঙা নড়বড়ে পকেট রুমে। তাদের জীবনে সুখ নেই, বন্ধু নেই, অনুভূতি নেই, প্রেম নেই, রাগ নেই। তাদের জীবনে আছে শুধু সেলাই মেশিনের শব্দ। তাদের যদি এ সমাজ এবং সমাজের মানুষ প্রেম দিত তবে তাদের এতটা দুঃখ থাকত না। তারা এই আশা নিয়েই বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে বস্ত্রে সুই লাগাত, মানুষ তো আমাদের ভালোবাসে। এই সমাজে বস্ত্রবালিকাদের সঙ্গে আমরাও বাস করি কিন্তু কখনো তাদের ডেকে বলি না- খেয়েছ তো? পরিবারের সবাই ভালো আছে তো? আমরা অনেকেই তাদের মনে করি অন্য গ্রহের অধিবাসী। তাদের নিচু শ্রেণি ভেবে একঘরে করে রাখি। সত্যিকার অর্থে আমরাও কি মানুষ হতে পেরেছি, উঁচু শ্রেণির মানুষ? মানুষের মতো মানুষ? মানুষ যদি কেউ হয়ে থাকে তবে পৃথিবীর খেটেখাওয়া পরিশ্রম করা দারিদ্র্যের আঁধারে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা জীবন প্রদীপগুলোই মানুষ। ভোগ-বিলাসিতায় পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার হেতু জানা যায় না। আর জন্মের তাৎপর্য যদি জানা না গেল তবে মানুষ হওয়ার তাৎপর্য কী? আগুন যেমন স্বর্ণকে পুড়িয়ে নিখাদ করে তোলে; তেমনি দুঃখ, কষ্ট, পরিশ্রম মানুষকে নিখাদ সোনার মানুষে পরিণত করে।

বর্তমান ব্যয়বহুল সমাজব্যবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে অবস্থানরত একজন শিক্ষার্থীর টিউশনের পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দৈনন্দিন খরচসহ মাস চলতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে একজন গার্মেন্ট কর্মী আট হাজার টাকায় কীভাবে নিজে চলে, সংসার চালায় এবং বাড়ি ভাড়া দেয়? আমার বোধগম্য নয়। এর উত্তর বাংলাদেশের কোনো অর্থনীতিবিদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে কি না জানি না। প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের এই শিল্পে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। বলতে গেলে আশি শতাংশ নারী। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু শ্রমিকদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তা এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় নিতান্তই কম। তাই ঈদে সুষ্ঠু, সচ্ছল ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য তাদের প্রাপ্ত অধিকারটুকুই দেওয়া হোক।

অনেক সময় গার্মেন্ট মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে চায় না। সরকার এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবে বলে আশা করি। গার্মেন্ট শিল্প যেন বাংলার অসহায়, নিপীড়িত, অভাবগ্রস্ত বস্ত্রশিল্পীদের কাছে শেষ ভরসার আশীর্বাদ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তাহলেই বাংলাদেশের নারীর দুঃখ অনেকাংশে লাঘব হবে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন দিয়েই নারীর স্বাধীনতা দাবি করা সমীচীন নয়। নারীরা পেশায় কথায় চলাফেরার চিন্তায় মননশীলতায় যোগ্যতায় পরিশ্রমে ও পারিশ্রমিকে স্বাধীন হলেই কেবল নারীর মুক্তি সম্ভব। যে বালিকাটি ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে না খেয়ে পয়সার অভাবে পায়ে হেঁটেই ছুটছে কারখানার উদ্দেশে, চোখ আর হাত জীর্ণ করে সেলাই করছে আধুনিক সভ্যতার শক্তিশালী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিতগুলো; তার সঙ্গে বাংলাদেশ যেন অন্যায় অবিচার আচরণ না করে। একজন বস্ত্রবালিকা/ বস্ত্রমিস্ত্রি যেন সহজাতভাবে হাসিমুখে এ মাটির দেশে মানুষের মর্যাদায় বেঁচে থাকে, বস্ত্রক্রীতদাসী হয়ে নয়।

অরিত্র দাস : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper