ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাজারবাগের পীরের তদন্ত চেয়ে রিট

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

রাজারবাগের পীরের তদন্ত চেয়ে রিট

রাজারবাগের ‘পীর’ দিল্লুর রহমান এবং তার দরবার শরিফের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে। পীর ও তার অনুসারী চক্রের বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় নাকাল ৮ জন ভুক্তভোগীর পক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

রিট আবেদনকারীরা হলেন- মো. আব্দুল কাদের, মাহবুবুর রহমান খোকন, ফজলুল করিম, জয়নাল আবেদিন, মো. আলা উদ্দিন, জিন্নাত আলী, আইয়ুবুর হাসান শামীম, নাজমা আক্তার ও নারগিস আক্তার। পীরের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের চেয়ারম্যানকে আদেশ দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে এই রিট আবেদনে। আর আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে কারা কেন এসব ‘হয়রানিমূলক’ মামলা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিচালকের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আবেদনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।

আগামী রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটির শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী শিশির মনির। ‘হয়রানি ও অপদস্ত’ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে রুল চাওয়া হয়েছে এই রিট আবেদনে।

স্বরষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বিশেষ শাখা), অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপরাধ তদন্ত বিভাগ), ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ মহাপরিদর্শক, গেয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও রিট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার বাদীসহ ২০ জনকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।

আবেদনে বলা হয়েছে, ‘হয়রানি ও অপদস্ত’ করার জন্য রিট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ এসব মামলা করা হয়েছে। এতে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আবেদনকারীদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।

এর আগে পীর দিল্লুর রহমানের অনুসারী চক্রের ‘অস্তিত্বহীন’ বাদীদের মামলা চ্যালেঞ্জ করে গত ৭ জুন হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চন। সেই রিটের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট এসব ‘অস্তিত্বহীন’ মামলার বাদীকে খুঁজে বের করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা অনুযায়ী সিআইডি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিলে গত ৬ সেপ্টেম্বর সেটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

সে প্রতিবেদনে শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, মানবপাচারের মতো নানা অভিযোগে ৪৯টি মামলার পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পৃক্ততা উঠে আসে।

ওই প্রতিবেদন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম সেদিন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেব কী করেছেন দেখেন! সম্পত্তির জন্য তথাকথিত মুরিদ দিয়ে মামলা করিয়েছেন। পীর সাহেবের কেরামতি দেখেন!’

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এক বোন। তাদের বাবা চিকিৎসক আনোয়ারুল্লাহ ১৯৯৫ সালে মারা যান।

বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্ন সময় প্ররোচিত করেও মুরিদ করা যায়নি। কামরুল আহসান বাদল পেশায় চিকিৎসক।

রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনেই ৩ শতাংশ জমির ওপর তিন তলা পৈতৃক বাড়ি কাঞ্চনদের। পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হওয়ার পর কাঞ্চনের মা, ভাই-বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির বেশিরভাগ অংশ পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়।

কাঞ্চন ও বাদলের অংশও দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কিন্তু কাঞ্চন ও তার ভাই সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ‘হয়রানিমূলক’ মামলা দায়ের করেন।

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে জিআর (পুলিশি মামলা) মামলা ২৩টি এবং সিআর (নালিশি মামলা) মামলা ২৬টি। ইতিমধ্যে ১৫টি জিআর মামলা এবং ২০টি সিআর মামলায় কাঞ্চন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন।
বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন, যার মধ্যে আটটি জিআর এবং ছয়টি সিআর মামলা। পুলিশের

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলোর নথি পর্যালোচনা এবং বাদী ও ভিকটিমদের সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভিকটিমরা কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরিফের পীরের সহিত সম্পৃক্ত।’

এছাড়া ২০২০ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাজারবাগের দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীরা তাদের দরবার শরিফের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে আসছে মর্মে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছেন।’

রিট আবেদনকারী কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা দায়েরের পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীদের ‘অশুভ স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে’ জানিয়ে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয় সিআইডির প্রতিবেদনে।

 
Electronic Paper