মনোবৃত্তির অনুসরণ জঘন্যতম পরিণাম: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
পর্ব-১
ড. সৈয়দ মাকসুদুর রহমান
🕐 ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২১
মনোবৃত্তি শব্দ বিশেষ্য পদ মনের ক্রিয়া, স্মরণ, চিন্তন বিচার সংকল্প ইত্যাদি; চিত্তবৃত্তি, মনের ভাব। মনোবৃত্তি অনুসরণ একটা জঘন্যতম অপরাধ। স্বাভাবিকভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যায় এ রোগের কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষেধক আবিষ্কার হযনি। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে এ রোগের চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। এ ব্যাধি যেখানে লক্ষ্য করা যায় সেখানে সামগ্রিক বিপর্যয় ঘটে। যদি আত্মার অনুসরণ ইলমের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তবে সে অহংকারী হয়ে যায়। আর যদি জুহূদ এর সঙ্গে হয় তাহলে সে প্রদর্শনকারী হয়। আর যদি আহকাম সম্পর্কিত হয় তবে সে জালিম হয়। যদি ইবাদতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তবে সে বিদআতী হয়। এই জন্য কোনোভাবেই মনোবৃত্তির অনুসরণ করা উচিত নয়।
মনোবৃত্তি অথবা আত্মা বা নফস মহান আল্লাহর এক বিস্ময়কর ও রহস্যময় সৃষ্টি। মানব জন্মের সঙ্গে তার রূহ বা আত্মা কিভাবে দেহে সংযুক্ত হয় বা প্রবেশ করে তা আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করছেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃগর্ভে আছে। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- আত্মা দেহকে সঞ্জীবিত করে তোলে এবং দেহে গতি সঞ্চার করে। অন্যদিকে দেহ ছাড়া আত্মার স্বরূপ অনুভূত হয় না বা জানা যায় না। দেহ-মন একীভূত হয়ে থাকলেও এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই- আত্মামুক্ত স্বাধীন স্বতন্ত্র এবং স্বীয় বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান। দেহ ছাড়াও আত্মা থাকতে পারে- তবে আত্মা ছাড়া দেহ অচল নির্জীব এবং নিরেট জড় পদার্থ মাত্র। মূলত আত্মা আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির এক নিয়ামত। এ আত্মা যখন পরিচ্ছন্ন হবে তখন তার সমস্ত দেহ পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। আর যদি এখানে কোনো বিপর্যয় হয় তাহলে সমস্ত দেহ অপরিচ্ছন্ন হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : অর্থ : হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই অবগত। (সূরা নিসা ৪:১৩৫)
আত্মার পরিচয় : আত্মা শব্দটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ জীবাত্মা, পরমাত্মা; ব্রহ্মাত্মা। কোনো জীবের অংশ যা কোনো শরীর নয়। দেহ যখন জীবিত থাকে, তখন এর ভিতরে একটি আত্মা থাকে। আর মৃত্যুর সময় আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। এখানে মনের আশা আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- অর্থ : তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না। (সূরা আরাফ ৭:৩)
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- অর্থ : বলে দাও, হে মানব মণ্ডলি। তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, সমগ্র আসমান ও জমিনে তার রাজত্ব। একমাত্র তাঁকে ছাড়া আর কারও উপাসনা নয়। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর উপর তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর ওপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহর এবং তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। তাঁর অনুসরণ করো যাতে সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার। (সূরা আরাফ ৭:১৫৮)- আরবি ভাষায় ইত্তেবাউল হওয়া শাব্দিক অর্থ ব্যাখা করা হয়েছে তা হলো-
আত্মার অনুসরণ দ্বারা উদ্দেশ্য : এখানে আত্মার অনুসরণ বা অনুসরণ বলতে বোঝানো হয়েছে এমন কাজ করা যে কাজ শরীআত অনুমোদন করে না। মনে যা ইচ্ছা করে তাই করে। কোনো বিধান ও শৃঙ্খলা মানে না। ‘মানুষের সব ক্রিয়াকাণ্ডের মূলে রয়েছে মন বা আত্মার সক্রিয় ভূমিকা। শরীর বা দেহ আত্মার নির্দেশ পালন করে থাকে। আত্মার হুকুম তামিল করার জন্য সে সদা প্রস্তুত থাকে। মনে সুপ্রবৃত্তি মানুষকে ন্যায়, সৎ ও সঠিক পথ নির্দেশ করে অন্যদিকে কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্যায়, অসৎ ও বিপথে পরিচালিত করে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না।
নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয়-আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা ইউসুফ ১২:৫৩) সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাধারণত নফস বা আত্মার গোলাম। মন যা চায় তাই করে। নফসের কামনা বাসনা পূরণ করাই তাদের জীবনের একমাত্র সাধনা। এজন্য চেষ্টার কোনো কমতি দেখা যায় না। বরং এ বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দ্বিধা করে না। নফসের গোলামী পথভ্রষ্ট হওয়ার একটি প্রধান উপায়। যারা আল্লাহ তা’আলা ও তার রাসূলুল্লাহ (সা.) হুকুমের খেলাপ নিজেদের নফসের খেয়াল খুশিমতো জীবনযাপন করে তাদের চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট কেউ হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
‘(হে রাসূল তুমি ওদের) বলো- তোমরা সত্যবাদী হলে আল্লাহর নিকট হতে এক কিতাব আনয়ন করো; যা পথনির্দেশের দিক দিয়ে এই দুই (কিতাব অর্থাৎ তাওরাত ও কুরআন) হতে উৎকৃষ্টতর হবে, (যদি পারো তাহলে) আমি সেই কিতাব অনুসরণ করব।’ (২৮:৪৯)
প্রফেসর ড. সৈয়দ মাকসুদুর রহমান, চেয়ারম্যান, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।