ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তবুও বাংলা, তবুও বাঙালি

রায়হান উল্লাহ
🕐 ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০১৮

বাংলা ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা। অঞ্চলটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত। এ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকা এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বাংলা ভাষাতে কথা বলা হয়। এ অঞ্চলের প্রায় ২২ কোটি স্থানীয় মানুষ ও পৃথিবীর মোট ৩০ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। বাংলা বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে চতুর্থ। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত এ ভাষাতেই রচিত।

বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির কাছে শুধু একটি ভাষাই নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু। অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকের মতে গৌড়ী প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে গৌড়ী প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর গৌড় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি।
ইতিহাস বলে, বাংলা ভাষা প্রায় ১৫০০ বছর পথ অতিক্রম করে আজকের এ আধুনিক পর্যায়ে এসেছে। এর আগে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। নানা ঘটনা পেরিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) পুলিশের গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। পরে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করে।
বাংলা ও বাঙালির এমন সব ইতিহাস, ত্যাগ, সংগ্রাম এবং আনন্দ আমরা কতটুকু ধরে রেখেছি? পাকিস্তানের ক্রুব্ধ ও জিঘাংসার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যারা আমাদের মায়ের বুলিকে স্বীকৃতির পথ করে দিয়েছেন তাদের কতটুকু সম্মান দিয়েছি আমরা? প্রশ্নেরা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। সমান্তরালে দুলছে বাংলাকে হেয় করার প্রবণতা। এখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনেক স্থানে বাংলা সঠিক মর্যাদা পাচ্ছে না। এ স্বাধীন দেশে এটি হওয়ার কথা ছিল না।
একুশ শতকের আধুনিকতা আমাদের নামেই বাঙালি করে রেখেছে। আমরা এখন বিদ্যা শিখি না। যা কিছু শিখি তা বাঁচার তাগিদে উপার্জনের জন্য। ফলে আমাদের সঠিক ও শুদ্ধরূপে বাংলা শিখা হয় না। বৈশ্বিক অস্থিরতায় এখন খুব সহজেই সব ভাষা গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। আর এ সুযোগে এখনকার ছোট শিশুটির কানের কাছে ভাসছে নানা ভাষার উচ্চারণ। ফলে সে বুঝছে না কোথায় তার সংস্কৃতি। এক সময় সে সহজেই এমন কিছু বলে ফেলছে যা জাতির হিসেবে পূর্ব প্রজন্ম, অভিভাবক বা বাবা মায়ের লজ্জার। কিন্তু এ লজ্জা আমরা মাখছি না। সবাই ছুটছি বেঁচে থাকার কৌশল খোঁজায়। এ খোঁজাখুঁজি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে অন্য অস্থিরতায়। আমাদের চারপাশে এখন দুলছে অসংখ্য ফাঁদ। যা গ্রাস করছে সংস্কৃতিকে। আমরা বুঝছি না খুব নিকটেই বা বর্তমানেও আমাদের উত্তর প্রজন্ম ‘আমার সোনার বাংলা’ বা ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ বা ‘আমি বাংলায় গান গাই’ এমন সব শিকড়ের গান বা নিজের সত্তা ভুলে অন্য কিছু গাবে।
যুগের অস্থিরতা বা চলমানতায় আমরা দেখছি নির্ভরযোগ্য কিছু ক্ষেত্রেও এখন বাংলা অবহেলিত। এর মাঝে আছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর; আছে গণমাধ্যম। সামাজিক ক্ষেত্রেও বাংলা অবহেলিত। পরিতাপের বিষয় গণমাধ্যম এখন গুবলেট বাংলিশ বলছে। সহজ-সরল বাংলা ব্যবহার না করে তারা নানা ভাষার শব্দের মধ্যে মাধুর্যতা খুঁজছে। আর এ খোঁজাখুঁজির বেলায় এখন আমরা ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলার শরণাপন্ন হচ্ছি। দিবসের মতো বাংলা এখন বাৎসরিক হয়ে যাচ্ছে। কষ্টের বিষয় তাও বছরে একবার এক মাসের জন্য। তাতেই হাঁসফাস করছি আমরা অনেকে। পুরো এক মাস বাংলাপ্রেমিক হতে হয় লোক দেখানো চলে। অন্যেরা কী বলবে?- এ ভাবনার আশ্রয়ে! এ সময় আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছি বাংলাকে ভালোবাসার প্রবণতায়। বাকিটা সময় পুরোটা জীবন আমরা এগোচ্ছি অন্য ভাষার হাত ধরে। ভাষার প্রতি ভাষার কোনো ঈর্ষা বা বিদ্বেষ নেই। তারপরও যখন নিজেরটা ভুলে যাই তখন পরের ওপর দোষ চাপবেই।
আমাদের চারপাশে এখন অন্য ভাষার ছড়াছড়ি। কিছু ক্ষেত্রে উপহাসের মতো বাংলার নামকে অন্য ভাষায় চিহ্নিত করে রাখছি আমরা। আমরা বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগোব, কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। এখন আমাদের প্রজন্ম চেনে না অতুলপ্রসাদ, প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। তারা ঠিকই চেনে অন্য অনেককে। আমরা কোথায় এগোচ্ছি?
পৃথিবীর কোনো জাতি নিজ শিকড় কেটে ফেলছে না। আমরা কাটছি। কাটছি যে তাই বুঝছি না। বিষয়টি এমন গাছে উঠে আপনার আকড়ে ধরা ডালই আপনি কাটছেন। বুঝতে পারছেন না। যখন কিছুই করার থাকবে না তখন বুঝবেন। বুঝেও তখন লাভ নেই।
আমাদের গণমাধ্যমের অনেক শাখায়, সচরাচর পারস্পরিক কথোপকথনে এমন কিছু বলছি যাকে ঠিক কোনো ভাষাই বলা যাবে না। একে বলা যাবে সব ভাষার অস্থিরতা। এমন অস্তিরতার খোঁজ দিতে রক্ত দেননি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা বীরেরা। প্রাণের ভয় না করে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের মায়ের বুলিকে পাকিস্তানিদের কাছে তুলে ধরেননি একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
এমন করে আমরা কী পেলাম? যেখানে বর্তমান গণমাধ্যমের আসংখ্য শাখায় এমন উচ্চারণ ও শব্দ ব্যবহার হচ্ছে যাতে মনে হবে এরা এ যুগের নূরুল আমিন। দুঃখের বিষয় তার বাড়িও ছিল বাংলাদেশে। আমরাও এ দেশের হয়ে, নিজের আশ্রিত ডাল কোপাচ্ছি। যখন ধপাস করে ভূতলে পড়ব তখন চেতনা ফিরবে কী করলাম?
আমাদের শেখার জায়গাটি ছোট করে ফেলছি আমরাই। আমরা এখন আর গান করি না; সং করি। ফলে আমরা সঙ সেজে বসে আছি। আমাদের শিল্পীরা এখন হয়ে যাচ্ছেন আর্টিস্ট। পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে এক্সাম। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাচ্ছে ভার্সিটি। আমরা হয়ে যাচ্ছি অদ্ভুত পিপল। যে পিপল ফুড খাই। ভাতকে বাত বলে ভাষার রোগ সৃষ্টি করছি। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আর পড়ে না ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর...’। তাদের আমরা জীবিকা নামক আজব জুজুতে চাপিয়ে দিচ্ছি ‘হিং টিং ছট’। বর্তমান প্রজন্মকে এখনই বাংলার কোনো শব্দকে ইংরেজির আশ্রয়ে বুঝাতে হয়। তাদের বলতে হয় রুম মানে কক্ষ। লিসেনার মানেই শ্রোতা। টিচারই হলেন শিক্ষক।
তারা অন্যেরটা আগে জানছে। কিছু ক্ষেত্রে কোনোটাই জানছে না। ফলে কথা বলছে অনেক ভাষার মিশ্রণে। একেই এরা যুগের আধুনিকতা হিসেবে জানছে। তারা যোগ্য হচ্ছে না কিছুর। তারা স্মার্টনেসের আশ্রয়ে ব্যক্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। তারা প্রজন্ম হিসেবে জেনারেশনে কমফোর্ট ফিল করে। তবুও নিজের ও অভিভাবকের অযোগ্যতায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। অভিভাবক কি তা তারা বুঝে না। বুঝে গার্ডিয়ান। আর অভিভাবকও গার্ডিয়ান হয়ে থাকছেন। মা-বাবার পর প্রথম আশ্রয় শিক্ষক এখন আর তাদের চোখে আপা নন। হয়ে গেছেন ম্যাম। বিদ্যালয় বা পাঠশালাও তারা চিনে না। তারা চিনে স্কুল। নিজেরটা চিনে সব না চিনলেও দোষের ছিল না। অথচ তারা নিজের পরের কিছুই চিনছে না। সৃষ্টি করছে ভাষার জঞ্জাল। তৈরি হচ্ছে জিএফ, ওএমজির মতো উদ্ভট সব কথামালা। কথামালা অবশ্য তাদের বোঝানো হয় নাই। তারা কনভারসেশনে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস রাখে না। রাখে বিলিভ।
রাষ্ট্র, সমাজ ও উত্তর প্রজন্মের অক্ষমতায়, যুগের ভুল আশ্রয়ে তারা এখন কী রাখে প্রশ্নসাপেক্ষ। অবশ্য প্রশ্ন ও উত্তর তারা দিতে প্রস্তুত না। তারা কোশ্চেন ও আনসারে সীমাবদ্ধ। এমন করে তাদের ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় ঠেকছে ও ঠেকবে তা ভাবা দুষ্কর। তাদের চোখে তারা এমন জেনারেশন যা কিছু দুঃসাধ্যকে ডিফিকাল্ট দেখে। বিনিময়ে অসংখ্য অক্ষমতা নিয়ে আমরা দেখি একজন ধীরেন্দ্রনাথের দুঃখ। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের আজন্ম কষ্ট।
আমরা তাদের মুখে কী তুলে দিচ্ছি? তাদের কোনো অনাগত গালাগালিতে রেখে যাচ্ছি? ধৃষ্টতা ঠেকলেও বলি, বাঙালি হয়ে বাংলার আশ্রয় নিতে না পারাদের গালাগাল দেওয়াই শ্রেয়। এবং তাদের মুখে কথোপকথন না হয়ে যে খিচুরি কনভারসেশন হয় তাকেও গালাগালিই বলা উত্তম!
এমন উত্তমের বেলায় ওল্ড জেনারেশন হিসেবে বলছি, সব নিয়েও আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি, আমার আমিকে চিরদিন এ বাংলায় খুঁজে পাই।   

রায়হান উল্লাহ : কবি ও সাংবাদিক
[email protected] 

 
Electronic Paper