ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মরণঘাতী ধূমপান

বিশ্বে কমছে দেশে বাড়ছে

রহমান মুফিজ
🕐 ১১:০৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০১৮

ধূমপান বিষপান, ধূমপান ক্যান্সারের কারণ, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়-এমন নানা ধরনের সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়েও দেশে ধূমপায়ী কমানো যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন, সামাজিক সচেতনতামূলক কাজও কম হচ্ছে না। তারপরও ধূমপায়ীর হার কেন ঊর্ধ্বমুখী? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখনই। কারণ কেবল ধূমপান কিংবা তামাক সেবনের কারণে দেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে এক লাখ ৬২ হাজারেরও বেশি মানুষ। গবেষণা বলছে, বিশ্বে এ সংখ্যা বছরে ৭০ লাখেরও বেশি। এ তো গেল প্রত্যক্ষ ধূমপান বা তামাক সেবনের হিসাব। পরোক্ষ ধূমপানেও কম মানুষ মারা যাচ্ছে না বিশ্বে। এ সংখ্যা ৯ লাখের মতো। হিসাব বলছে, প্রতি এক সেকেন্ডরও কম সময়ে বিশ্বে তামাক সেবন বা ধূমপানের কারণে মারা যাচ্ছে ১ জন লোক। টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ এমন গবেষণাই হাজির করেছে।

গবেষণা বলছে, নিছক কৌতূহলের কারণেই অধিকাংশ মানুষ কম বয়সে আসক্ত হয়ে পড়ছেন ধূমপানে। স্বাস্থ্যগত কোনো উপকারের বদলে ক্ষতিকর দিক নিশ্চিত জেনেও ধূমপানে জড়িয়ে পড়ছে দেশের অধিকাংশ কিশোর ও তরুণরা। দৈনন্দিন জীবনে এটাকে অনেকে স্রেফ বিনোদন হিসেবেও গ্রহণ করছেন।

তামাক বা ধূমপানবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত রয়েছে ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট)। তাদের গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন ৩৫.৩% শতাংশ মানুষ। সংখ্যায় তিন কোটি আটাত্তর লাখ। এর মধ্যে পুরুষ রয়েছেন ৪৬% এবং নারী ২৫%। এর মধ্যে ধোঁয়াযুক্ত তামাক অর্থাৎ ধূমপায়ীর হার ১৮% বা এক কোটি বিরানব্বই লাখ। আর ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার ২০.৬% বা ২ কোটি বিশ লাখ।

ডাব্লিউবিবি তাদের গবেষণায় দেখাচ্ছে, তামাক ব্যবহারের কারণে বছরে ১২ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগের চিকিৎসা, অকালমৃত্যু, পঙ্গুত্বের কারণে বছরে দেশের অর্থনীতিতে ৫ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। অপরদিকে তামাক খাতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে বছরে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তামাক ব্যবহারের ফলে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি এক সেমিনারে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক বলেন, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। হৃদরোগে আক্রান্তদের অধিকাংশেরই বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ধূমপানের কারণেই এ বয়সী মানুষের হৃদরোগ দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, হৃদরোগ বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে পৃথিবীব্যাপী মহামারী বা ‘প্যানডেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মত্যুবরণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এই মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এবং ইউএস ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ২০১৭ সালের এক যৌথ সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ধূমপায়ীরা সিগারেট-বিড়ির আগুনে পুড়িয়ে ছাই করছেন ৮০ হাজার কোটি টাকা। এটা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৪ শতাংশ। সে সমীক্ষা বলছে, বিশ্বের যে ১৩টি দেশে সবচেয়ে বেশি সিগারেট-বিড়ি, জর্দা, গুল ও সাদাপাতার মতো ক্ষতিকর তামাক পণ্য উৎপাদিত হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষস্থান দখল করে আছে। আর তামাক বা ধূমপান সেবীদের স্থানে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যেও অন্যতম। সম্প্রতি চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এ কয়েকশ’ বিজ্ঞানীর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সে প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে- চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন। এর পরপরই যে দেশগুলোর নাম চলে আসে সেগুলো হচ্ছে- ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, জাপান, ব্রাজিল ও জার্মানি। ১০ দেশ মিলে যে ধূমপায়ীর সংখ্যা দাঁড়ায় তা বিশ্বের মোট ধূমপায়ীর ৬৩ শতাংশেরও বেশি।

দ্য ল্যানসেটের প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের কোনো কোনো দেশ উচ্চ করারোপ, সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবার্তা এবং প্রচারণার মাধ্যমে সিগারেটে আসক্তি কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও কিছু দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি চালানোর পরও ধূমপায়ীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। গবেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ নীতির কারণে ধূমপান বা তামাকের ব্যবহার কমে যাওয়ায় সেসব দেশের তামাক কোম্পানিগুলো নতুন বাজারের খোঁজে নেমেছে। সে ক্ষেত্রে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই উৎকৃষ্ট বাজার হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশেও তামাকশিল্পে ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে জাপানের বৃহত্তম এবং অন্যতম শীর্ষ সিগারেট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জাপান টোব্যাকো। তারা বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের সিগারেট তৈরির সব ব্যবসা কিনে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, আকিজ গ্রুপের সিগারেট কোম্পানি কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে জাপান টোব্যাকো এ যাবৎকালের মধ্যে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে একক বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ করবে। এ বিনিয়োগই নির্দেশ করছে-বাংলাদেশে সিগারেটের বাজার কত বড় এবং দিন দিন এ দেশে কী হারে ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের এমন সুযোগই প্রমাণ করছে ধূমপানে নিরুৎসাহের ক্ষেত্রে সরকারের অনীহার বিষয়টি। যদিও সরকারি সূত্র বলছে, আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জিং কাজটি করতে গেলে যে পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন তা দেখতে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ও তামাকবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সৈয়দা অনন্যা রহমান খোলা কাগজকে বলেন, বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকের ভয়াবহ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। তামাকমুক্ত দেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ০৫%-এ নিয়ে আসতে হবে। তামাকমুক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আগে বাংলাদেশেকে আরও দুটি আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২৫% এবং সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৩০% তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে তামাক কোম্পানিগুলোর কূটকৌশল। তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মুনাফা অর্জনের জন্য নীতি প্রণয়ন ও আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ট ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিগত দিনে তামাক কোম্পানিগুলোর অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপের কারণে আইন প্রণয়ন ও সংশোধনে বিলম্ব, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ছবিসহ যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সর্তকবাণী প্রদান ও সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে।

তামাকের ব্যবহার কমাতে হলে তামাক কোম্পানির প্রভাব প্রতিহতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন উল্লেখ করে অনন্যা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসির আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন করতে হবে। এফসিটিসির এ শক্তিশালী আর্টিক্যালটির বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিগুলোর সুরক্ষায় গাইড লাইন প্রণয়নের পাশাপাশি তামাক কোম্পানির কার্যক্রম বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

 
Electronic Paper