ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অগ্নিকন্যা লীলা নাগ

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৯:০২ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ০৭, ২০২১

অগ্নিকন্যা লীলা নাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ, এ তথ্যটির সঙ্গে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। তার হাত ধরেই ঢাবিতে নারী শিক্ষার সূচনা হয়েছিল। ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংগ্রহশালায় লীলা নাগের ছবিসহ এ তথ্যটির উল্লেখ আছে। তবে শুধু এই একটি কারণেই নয়, লীলা নাগ পরিচিত তার ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবনের কারণে। তিনি একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, জনহিতৈষী ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সহকারী হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। লীলা নাগ ও তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

জন্ম ও পরিবার
উপমহাদেশে নারী জাগরণের পথিকৃৎ লীলা নাগ আসামের রবি গোয়ালপাড়ায় ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগত নাম শ্রীমতি লীলাবতী নাগ। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন বুড়ি বলে। বাবা গিরীশ চন্দ্র নাগ ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। মা কুঞ্জলতা ছিলেন গৃহিনী। লীলার বাবার বাড়ি ছিল মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁওতে। তাদের পরিবার ছিল মৌলভীবাজারের অন্যতম শিক্ষিত ও সংস্কৃতমনা একটি পরিবার। ১৯১৬ সালে বাবা অবসর গ্রহণ করার পর তিনি স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আসাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৩৯ সালে বিপ্লবী অনিল রায়কে বিয়ে করেন লীলা। বিয়ের পর তার নাম হয় লীলাবতী রায়। বাবা গিরীশ চন্দ্র নাগের চাকরি সূত্রে বাস ছিল আসামের গোয়াল পাড়ায়। কুসংস্কার মুক্ত, শিক্ষিত দেশপ্রেমী মায়ের হাতেই লীলা নাগ গান বাজনা, গৃহস্থালীর কাজকর্ম, হস্তশিল্প এবং সমাজকর্মের দীক্ষা নেন। কালের প্রথা এড়িয়ে মূলত তিনিই লীলাকে দূরে পাঠিয়ে পড়ালেখার পথ প্রশস্ত করেন। নিয়ম ভেঙে এই কুলবধূই উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন ‘মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় বড় হয়েছে, সে স্বাধীনমত যখন ইচ্ছে বিয়ে করবে।’

এছাড়াও বহু বিপ্লবীকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন তিনি। লীলার মা কুঞ্জলতা দেবী ছিলেন শ্রীহট্টের প্রথম রায় সাহেব, আসামের প্রথম বাঙালি সুপারিনটেনডেন্ট ব্রাহ্মসমাজ ভুক্ত তেজস্বী পুরুষ সিলেটের প্রকাশ চন্দ্র দেবের একমাত্র কন্যা। যিনি চাকরি জীবনে কখনও কোনো সাহেবকে বাড়ি গিয়ে সালাম প্রদান করেননি এবং হিন্দু ধর্ম মতে কন্যাও সম্প্রদান করেননি। গিরীশ ও কুঞ্জলতার বিয়ে ছিল তৎকালীন সামাজিকতার পরিপন্থী। প্রকাশ চন্দ্র দেব অবসর গ্রহণের পর গিরীশ চন্দ্রের বাড়িতেই ছিলেন এবং গিরীশ চন্দ্র সরাসরি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ না করলেও বাস্তবিক জীবনে এবং নাতনী লীলার জীবনে প্রকাশ চন্দ্রের বিশেষ প্রভাব ও ভূমিকা ছিল। লীলা নাগের অন্য তিন ভাই নির্মল, সুশীল ও প্রভাত তিনজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী ছিলেন এবং কারাবরণও করেছিলেন। নির্মল ও সুশীল অধ্যাপক ছিলেন এবং প্রভাত কুমার নাগ ছিলেন আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক।

লীলানাগের ঠাকুরদা গিরীশ চন্দ্র নাগের বাবা গঙ্গাগোবিন্দ নাগ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সহযোগী সম্বাদ-ভাস্কর পত্রিকার সম্পাদক সংস্কৃত প-িত গৌরীশংকর ভট্টাচার্যের সমসাময়িক এবং গৌরীশংকর ছিলেন পাঁচগাঁওয়েরই সন্তান। ফলে সমাজ সংস্কারের প্রভাব সরাসরি গঙ্গাগোবিন্দ এবং তার পরিবারেও পড়েছিল। তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চল অবকাঠামোগতভাবে তুলনামূলক অনুন্নত হলেও শিক্ষায় ছিল অনেক অগ্রগামী।

গিরিশ চন্দ্র কলকাতাতে পড়ার সময় বিপিন চন্দ্র পাল, সুন্দরী মোহন দাস, সীতানাথ দত্ত, তারা কিশোর চৌধুরী প্রমুখ প্রখ্যাত মনীষীদের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরীক্ষায় সব সময়েই প্রথম স্থান অধিকারী গিরীশ চন্দ্র ১৮৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রথম শ্রেণিতে আইন পাস করে আইন পেশায় জড়িত হন। কিন্তু কিছুদিন পরেই আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন। মহকুমার সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও গিরীশ চন্দ্র বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে স্বদেশীসহ স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। মাতৃভূমির টানে তার বাড়ি পরিণত হয় বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে। তার বাসাতেই বিপ্লবী অনিল দাস বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯১২ সালের ১২ ডিসেম্বর লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর বোমা নিক্ষেপকারী বিখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে তিনিই কৌশলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাই সাজিয়ে জাপান পাঠাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন অনুযায়ী প্রথম ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু ভারতীয় সরকারের লবণ করের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৮৭৪ সালে সিলেটকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে অসমীয়া সমাজ, শিল্প ও সংস্কৃতির চাপে স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়। মূলত তখন থেকেই সিলেটের বঙ্গভুক্তির আন্দোলন শুরু হতে থাকে এবং সিলেটের জনমানসে জেগে উঠা স্বাতন্ত্রবোধের প্রভাবে সিলেটিরা অন্তর্মুখী হতে থাকেন।

বৃহত্তর সিলেট জেলার পশ্চাৎপদতার সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকেই তিনি সিলেটের বঙ্গভুক্তি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। লীলা নাগের সামাজিক সংঘঠনের অর্থের যোগানদাতা ছিলেন তিনি। একামাত্র মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরির পরিবর্তে দেশকর্মী হওয়ার ইচ্চাকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন বলেই তিনি পুলিশ কমিশনার কোঠামকে স্বগর্বে বলেছিলেন, ‘মেয়ে দেশের কাজ করছে।’ চাকরি সূত্রে গিরীশ চন্দ্র বিভিন্ন স্থানে বসবাসের পর ১৯১৬ সাল থেকে ঢাকার বকশীবাজারে স্থায়ী হন এবং ঢাকার সমাজে গঠনমূলক সমাজ চিন্তার ধারক-বাহক হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পান। সামাজিক ভূমিকার জন্য তিনি ‘মেম্বার অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোট’ নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালের ২৪ আগস্ট রায় বাহাদুর গিরীশ চন্দ্র নাগ পরলোক গমন করেন।

শিক্ষা জীবন
বাবার কর্মস্থল আসামের গোয়াল পাড়ায় পাহাড়ঘেরা বাঙালি বিচ্ছিন্ন অসমীয় পরিম-লে লীলা নাগ তার মা কুঞ্জলতা এবং মাতামহ প্রকাশ চন্দ্রের কাছে বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করে কিছুদিন দেওঘরের এক পাঠশালায় গমন করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই কলকাতা ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে ভর্তি হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯১১ সালে ইডেন হাইস্কুলে ভর্তি হলে জীবনের শুরুতেই তিনি পরিবার থেকে বর্হিমুখী হয়ে পড়েন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি হোস্টেলে থেকেই পড়ালেখা করেন। তৎকালীন সময়ে সকল প্রকার জড়তামুক্ত মেয়ে হওয়ার কারণে ইডেন হাইস্কুলের শিক্ষকরা সহজেই তাকে নারী নেত্রীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল জয়, যুগান্তর-অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ ও রুশ বিপ্লবের ঘটনা কিশোরী লীলার মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৫ টাকা বৃত্তি লাভ করেন।

১৯১৭ সালে লীলা নাগ বাংলার নারী অধিকার ও নারী রাজনীতির অন্যতম সূতিকাগার কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। বিখ্যাত নারী বিপ্লবী কামিনী রায়, অবলা বসু ছিলেন এ কলেজেরই বিদ্যার্থী। আইএ পড়ার সময় তিনি কলেজের সিনিয়র স্কুডেন্ট নির্বাচিত হন এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের স্নেহাশীষ লাভ করেন। ১৯১৯ সালে এখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন এবং মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পান। পরবর্তীতে সেই টাকা তিনি শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করেন। ১৯১৯ সালে বেথুন কলেজেই লীলা নাগ ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। এ সময়ে তিনি নিজেকে আরও ফুটিয়ে তুলেন এবং বিপ্লবী চেতনাও জাগ্রত হতে থাকে। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো কলেজের কাজকে গতিশীল করার জন্য ছাত্রী ইউনিয়ন নামে সংগঠন গঠন, কলেজের পূর্বতন ছাত্রীদের সঙ্গে যোগযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রি-ইউনিয়ন নামক সামাজিকতার প্রবর্তন, কলেজের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বড়লাট পতœীকে ছাত্রীদের নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানানোর অপমানজনক প্রথার বিলুপ্তিতে প্রধান ভূমিকা রাখা। মূলত তার প্রতিবাদেই এ অপমানজনক রীতি বিলুপ্ত হয়। সেদিন অসহযোগে প্রবলভাবে আলোড়িত লীলা নাগ জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘পড়ালেখা বা কলেজ ছেড়ে দিলেই স্বাধীনতা আসবে না।’ লীলা নাগের বয়স ছিল তখন মাত্র ১৭ বছর। ১৯২১ সালে মেয়েদের মধ্যে ইংরেজি অনার্সে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। পুরস্কার হিসেবে লাভ করেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদকসহ একশ টাকা। পরের ঘঠনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইনী জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে ফাঁকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষার নিয়ম ছিল না। লীলা নাগ প্রবল ইচ্ছা শক্তি এবং সাহসিকতায় সকল বাধা উপেক্ষা করে ১৯২১-২৩ সেশনে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাস স্থাপন করেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।

তখনও ঢাবিতে সহশিক্ষার প্রচলন ছিল না। তার জেদ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বেন। মেয়েরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না এই মর্মে লীলা চ্যান্সেলর ও ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করে নিজের কেস প্লিড করেন। তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টজ লীলার মেধা ও আকাঙ্খা বিবেচনা করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন। তার ভর্তি ক্রমিক নম্বর ছিল ২৫। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
অবশ্য লীলা একাই সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন না। সেই শিক্ষাবর্ষে (১৯২১-২২) ঢাবির অর্থনীতি বিভাগে বি.এ (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হন আরেকজন ছাত্রী সুষমা সেনগুপ্ত। সুষমা ছিলেন সেই সময় ঢাবির আইনের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মেয়ে। সুষমা সেনগুপ্তের নিজস্ব স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘আইএ পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেল। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হলো। বিএ পড়তে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সে বছর লীলাও এমএ ক্লাসে ভর্তি হলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা দুজন প্রথম ছাত্রী। এক কমন রুমে বসতাম দুজন। ক্লাসে যাবার সময় অধ্যাপক আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন।’ অর্থাৎ প্রথম ছাত্রী হওয়ার তকমা লীলা নাগ ও সুষমা সেনগুপ্ত দুজনকেই দেওয়া যায়।

সংগ্রামী জীবন
লীলা নাগ কর্মজীবনে মহিয়সী ছিলেন, বিপ্লবী হিসেবেও তিনি পরিচিত। অপরদিকে সুষমা সেনগুপ্ত একজন সাধারণ ছাত্রী ছিলেন। বি.এ পাস করার পর তিনি আর পড়াশোনা করেছেন কিনা তাও জানা যায় না। তাই লীলা নাগ এককভাবে বারবার এসেছেন আলোচনায়, লাভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীর মর্যাদাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন রেজিস্টার থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। এরপরের তিন শিক্ষাবর্ষে আর কোনো ছাত্রী ভর্তি হয়নি। ১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে তৃতীয় ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন ফজিলাতুন্নেসা। এরপর ১৯২৭-২৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্রীরা আসতে শুরু করেন। ১৯২১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৭১১ জন ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই লীলা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও ঋষি রামানন্দের সাহচর্য লাভ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি ইংরেজিতে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী। শিক্ষাজীবন শেষ করে লীলা নারী শিক্ষার প্রসার ও স্বদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্রতী হন। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্য ১২ জন সংগ্রামী সঙ্গী নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন দীপালি সংঘ। এ সংঘের মাধ্যমে তিনি দীপালি স্কুল ও আরও ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষা ভবন নামেও দুটি স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ পরবর্তীতে নাম বদলে হয় কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল, আর নারীশিক্ষা মন্দির নাম হয় শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। ঢাকার আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। বিয়ের পর লীলা কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি দীপালি ছাত্রী সংঘ ও মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্রও গড়ে তোলেন। বিপ্লবী পুলিন দাসের নেতৃত্বে মেয়েরা এখানে অস্ত্র চালনা ও লাঠিখেলা শিখতেন।

দীপালি সংঘ তৈরির আগে থেকেই লীলা বিপ্লবীদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলেন। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলো সুভাষ চন্দ্র বসুর চারপাশে সমবেত হতে থাকে। স্বামী অনিল রায়, আরেক বিপ্লবীকে নিয়ে লীলাও উপস্থিত হন সেখানে। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস বলার সময় লীলা মঞ্চে ওঠেন। তার বিপ্লবী জীবনের পথ এর মাধ্যমে প্রশস্ত হয়।

লীলা নাগের রক্তেই মূলত মিশে ছিল বিপ্লবের প্রেরণা। পাবিারিকভাবেই লাভ করেছিলেন দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার স্পৃহা। কালক্রমে সেই স্পৃহাই বিপ্লবে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এমএ, ইংরেজি প্রথম বর্ষের ছাত্র অনিল রায়ের সঙ্গে লীলার পরিচয় বিপ্লবী জুটিতে পরিণত করে এবং পরবর্তীতে একডোরেই জীবন অতিবাহিত করেন। অনিল রায়ের কর্মকৌশলে লীলা নাগ ক্রমেই তার কর্মপ্রবাহ সক্রিয় করে তোলেন। প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীসংঘ এবং বিখ্যাত দীপালী সংঘ। প্রথা ভেঙে বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। ১৯২৩ সালে সুষমা সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন দীপালী সংঘ। ঢাকার বকশীবাজারের বাড়ি থেকেই এর কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের সঙ্গে ছিলেন ঠাকুর পরিবারের ইলা রায়, ব্যারিস্টার পিকে বসুর মেয়ে কমলা বসু ও মনোরমা বসু, আচার্য ডা. নেপাল রায়ের মেয়ে লতিকা রায় ও লীলা রায়, অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের মেয়ে বীণা দত্ত এবং অমলচন্দ্র বসুর স্ত্রী শ্রীমতি সরোজ বসু। ঢাকার মহিলা সমাজে দীপালি সংঘের প্রভাব ছিল ব্যাপক। যেমন- ঢাকায় ১৯২৩ সালে দীপালী হাইস্কুল নামে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিন বছর বিনা বেতনে শিক্ষাদান করেন। বর্তমানে এটি কামরুননেসা হাইস্কুল নামে পরিচিত। ১৯২৪ সালে আরেকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন যার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। ১৯২৮ সালে স্থাপন করেন ঢাকার বিখ্যাত নারী শিক্ষা মন্দির। যা বর্তমানে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় নামে পরিচিত। পরে বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়, শিক্ষায়তন, শিক্ষা ভবনসহ বেশ কয়েকটি হাইস্কুলসহ ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেইসঙ্গে বয়ষ্ক শিক্ষাকেন্দ্রসহ দীপালি ভা-ার, ছাত্রীনিবাস, ব্যয়ামাগার, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, নারী রক্ষা ফান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে দীপালি সংঘের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন দীপালি ছাত্রী সংঘ। এ কাজে লীলার সঙ্গে ছিলেন প্রীতিলতা, রেণুকা সেন, হেলেনা দত্ত, অশ্রুকনা সেন প্রমুখ। দীপালির এ প্রীতিলতাই বিখ্যাত নারী বিপ্লবী, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে মাস্টারদা সূর্যসেনের সঙ্গী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় দীপালি সংঘের কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে লীলা নাগকে শান্তি নিকেতনে আসার আহ্বান জানান। এ প্রস্তাব কিছুটা গর্বিত হলেও স্পষ্টবাদী, নিজ নীতিতে অটল লীলা নাগ সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলন এবং গোপন বিপ্লবী সংগঠন দুই দিকেই লীলা নাগ ছিলেন সমান পারদর্শী। ১৯২৮ সালে অনিল ও লীলা শ্রীসংঘের বিস্তারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করেন। মৌলভীবাজারে মনমোহন ভট্টাচার্য, অনিল দাস, নরেশ সূত্রধর, সূর্যমণি দেব, শশীন্দ্র দত্ত, অজিত দত্ত, সুকুমার নন্দী, (লীলা নাগের ভাতিজা) সুধীর নাগ, সিলেটের ফনীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয়মাধক গুপ্ত, নরেশ চক্রবর্তী, সত্যব্রত দত্ত, বিনয় মজুমদার, রথীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ ছিলেন শ্রীসংঘের প্রাণপুরুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনগর অঞ্চলের অনেক তরুণ সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িয়ে পড়েন। মূলত রাজনগর-পাঁচগাঁও অঞ্চল কর্মকারদের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং তাদের তৈরি অস্ত্র বিপ্লবীদের জন্য বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

সাংবাদিকতা
প্রকাশ্য রাজনীতি ও সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেও লীলানাগ সাংবাদিকতাকে লালন করেছিলেন হৃদয়ে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটান উপমহাদেশে প্রথম নারী মুখপত্র মাসিক জয়শ্রী পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। যার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এর সরাসরি সমর্থক এবং ‘জয়শ্রী’ নামকরণ তিনিই করেন। উপমহাদেশে নারী সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রীর মাধ্যমে লীলা নাগ প্রথম বাঙালি নারী সাংবাদিক হিসেবেও ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সহ-সম্পদক ছিলেন যৌথভাবে শকুন্তলা দেবী এবং রেণুকা সেন, প্রকাশক ছিলেন সুধীর কুমার নাগ। এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদপট আঁকেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য শ্রীযুক্ত নন্দলাল বসু। সে সময় জয়শ্রীর ক্ষুরধার সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলোই ছিল সরকারের জন্য বজ্রাঘাততুল্য। ফলে প্রকাশের অল্পদিনেই লীলানাগ গ্রেফতার হন এবং সহকর্মীরা জয়শ্রীকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন।

জয়শ্রীর দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা যখন রবি ঠাকুরের আর্শীবাদ বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়। জয়শ্রীতে কবিগুরুর সরাসরি সমর্থন থাকায় সব সংখ্যাতেই তার কোনো না কোনো লেখা প্রকাশিত হতো। এ ‘জয়শ্রীতেই দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক লিখিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নটীর পূজা’র গানগুলোর স্বরলিপি প্রথম প্রকাশিত হয়। সে সময়কার সচেতন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার (ঐতিহাসিক), বিনয় সরকার, ড. মেঘনাদ সাহা, আশাপূর্ণা দেবী, অমলেন্দু দাসগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী, জীবনানন্দ দাস প্রমুখ জয়শ্রীতে নিয়মিত লিখতেন। যখনই জয়শ্রীর জয়জয়কার চারদিকে তখনই রাজরোষের কারণে ১৯৩১ সালের ২৮ অক্টোবর পুলিশি অভিযানে বন্ধ হয়ে যায় জয়শ্রীর প্রকাশ। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন লীলা নাগ। সৃষ্টি হয় আরেক ইতিহাস। কেননা তিনিই হলেন ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী।

১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৭ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত লীলা ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ী, মেদিনীপুর জেল ও হিজলী বন্দিশালায় আটক ছিলেন। পরবর্তীতে আরও অনেকবার কারাভোগ করতে হয় তাকে। জেল থেকেই লীলা সাঙ্গঠনিক সংহতিকে অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড করে বৈপ্লবিক সংঘাত পরিচালনার প্রয়াস চালান। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় লীলা পুরোদমে কাজে নামেন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর অনিল-লীলা দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাসের উদ্যোগ নেন। তিনি তখন বিপ্লবীদের কল্পলোকের রানী। ১৯৩৮ সালে পুনরায় সকলের আনন্দবার্তা নিয়ে মাসিক জয়শ্রী প্রকাশিত হয় এবং রাজনৈতিক ও বিপ্লবী কার্যকলাপ আরও প্রসারিত হতে থাকে। নেতাজির অনুরোধে তার প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পাদনার ভার নেন লীলা। পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু রক্ষা ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারা। এ সময় কবি সুফিয়া কামাল কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলে লীলা নাগ তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৫১ সালে ভারত সরকার প্রণীত উদ্বাস্তু উচ্ছেদের বিলের বিরোধিতা করে আবারও গ্রেফতার হন লীলা।

শেষ জীবন
১৯৫২ সালে লীলা নাগের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য ও বহুদিনের আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন লীলা। তবে কম সময়ের মধ্যেই শোক কাটিয়ে স্বদেশের বৃহত্তর স্বার্থে পুনরায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে পুলিশ লীলা নাগকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৬ সালে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে কলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তার বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে যায়। এভাবেই আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন লীলা নাগ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

 
Electronic Paper