ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আম ও ছালা

অমল সাহা
🕐 ১:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০২১

আম ও ছালা

আম আনার খবর পাওয়া গেছে। গেলেই নিয়ে আসতে পারব। পাকা পাকা মিষ্টি আম নিয়ে বসে আছে ফরিদ খুড়ো। শুধু গিয়ে নিয়ে আসার অপেক্ষা। ফরিদ খুড়ো মানে ফরিদ কাকা আজ সকালেই ফোনে জানিয়েছেন, বাবলু আয় গাছের আম নিয়ে যা। আসার সময় একটা ছালা নিয়ে আসিস। আমার বাসায় আম নেওয়ার মতো ছালা নেই। ফরিদ কাকার বয়স এখন পঁয়ষট্টি। রিটায়ার্ড জীবন কাটাচ্ছেন। নিজের বাড়ির আশপাশে অনেক গাছ আগেই লাগিয়েছিলেন। আমি মহাখুশি। ছালা ভর্তি আম! এ যেন না চাইতেই ঘূর্ণিঝড়। মেঘবৃষ্টি বাদ। বউকে বললাম, শোনো, ফরিদ কাকা তো ছালা নিয়ে যেতে বলেছে আম আনার জন্য।

বউ শুনে এক ঝাড়ি মারল, যা তা বলো না। পাগল হয়েছ, এ যুগে আবার ছালা ভর্তি আম কেউ কাউকে দেয় নাকি? ওই বুড়ো দেবে ছালা ভর্তি আম! যাও গিয়ে দ্যাখ, শেষে আম ছালা দুটোই না যায়।

আমারও রাগ হলো, হুঁ নিজের বাপের বাড়ির কেউ হলে তো বলতে, যাও যাও, উনি খুব ভালো মানুষ গেলেই আম দিয়ে দেবেন।
—ঠিক আছে যাও। ছালা ভর্তি আম নিয়ে এসো। বলে অন্য ঘরে চলে গেল।

আমারও এক রকমের জেদ চেপে গেল, ছালাভর্তি আম আমি আনবই। কিন্তু ছালা পাই কোথায়? ঢাকা শহরে এই এক যন্ত্রণা। এই শহরে কোথায় ছালা পাওয়া যাবে কে জানে। অথচ ঢাকা ছাড়া অন্য যে কোনো মফস্বল শহরের সবখানেই একটা না একটা ছালাপট্টি আছেই।

আমাদের ছোট সংসার। আমি, আমার মা, বউ আর পুঁচকে একটা ছেলে। পনের কেজি চাল হলেই মাস চলে যায়। তাই বস্তায় চাল আনা হয় না। আমার এক বন্ধু আছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে চাকরি করে। কোন ডিপার্টমেন্টের জানি পরিচালক। ওকে ফোন করলাম, শোন মনির, আমার ছালার দরকার।

বন্ধু শুনেই লাফিয়ে উঠল, আরে তুই এ্যাদ্দিন পর। তরে কত দিন বললাম একদিন অফিসে আয়, তরে নিয়া রাস্তায় দাঁড়ায়া রং চা খামু। সেই ভার্সিটিতে থাকতে কালামের দোকানের চায়ের কথা মনে আছে, রাত আড়াইটার সময় চা? হা হা হা।

—ভাই, একটু বল আমি ছালা পাব কোথায়?

বন্ধু ফোনে বলল, শোন ছালা আমি তোকে জোগাড় করে দেব। কত ছালা লাগবে? তোকে একটা জুটমিলের সঙ্গে কানেক্ট করিয়ে দেব, তুই আমার কথা বলবি, আমার রেফারেন্স দিবি। তবে তোকে আমি একটা বুদ্ধি দিচ্ছি, যদি একবার কোনো বিদেশি কানেকশন ধরতে পারিস তাহলে ছালা এক্সপোর্ট করেই লালে লাল হয়ে যাবি।

বন্ধু সব কথা বলে এক দমে থামে।

আমি মরিয়া, বললাম, ভাই আমাকে একটা, মাত্র একটা ছালা জোগাড় করে দে।

এ কথা শুনেই বন্ধু কেমন যেন থ মেরে গেল। কথা বন্ধ। আমি বললাম, কী হলো?

বন্ধু বলল, ইয়ে মানে... এই তো মুশকিলে ফেললি, একটা ছালা কোথায় পাই বল তো? ছালা... একটা ছালা... ছালা। আচ্ছা আমি তোকে খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি। বলে ফোন কেটে দিল। আমি ফোন দিই বন্ধু আর ফোন ধরে না। বুঝলাম বন্ধুর আশা বাদ। মনে হয় ভয় পেয়েছে।

শেষে আমার আরেক বন্ধু প্রণবকে ফোন করলাম, অ্যাই ঢাকা শহরে ছালা কোথায় পাওয়া যায় রে?

—তোমায় আমি মালা দিব, ছালা কেন চাহিলে? প্রণব রসিকতা করে।

প্রণব আবার কবিতা লেখে। ওর কবিতা বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়। কিন্তু ওর ঠাট্টা এখন আমার ভালো লাগল না। আমি বললাম, জানলে বল না জানলে রাখি।

—আরে না না ছালার খোঁজই তো জানতে চাইছিস? এটা তো আর এমন কিছু না। এমন না যে পরশপাথরের খোঁজ চাইছিস।

আজ কী হলো! সবার মুখে কেন কথার এত ফুলঝুরি! আমি খানিকটা রেগেই বলি, জানলে বল...।

—আরে ভাই রাগ করছিস কেন? শোন, তুই পুরান ঢাকায় মৌলভীবাজারের শুকুর আলী লেনে যা, পেয়ে যাবি। আমি একবার বাসা শিফট করার সময় ওখান থেকে ছালা এনেছিলাম মালপত্র বাঁধা-ছাদা করার জন্য।

—শুকুর আলী লেনটা কোথায়? আমি জানতে চাই।

—তুই যাবি মৌলভীবাজারে। প্রথমে গুলিস্তান যাবি, সেখান থেকে চকবাজার তারপর চকবাজার থেকে বামে ঢুকবি। বামে ঢুকে সোজা তিন মিনিট হাঁটবি। পেয়ে যাবি মৌলভীবাজার। সেখান থেকে ধর ডাইনে ঢুকবি...।

ধ্যাত্তেরি! এবার আমি হাল ছেড়ে দিই। ফোন কেটে দিই। বন্ধু তখনো বলে চলেছে— এরপর ডাইনে ঢুকবি, তারপর বামে... মনে মনে বলি, কথা শুনে ভিজে গেছি ঘামে—

হঠাৎ বউ বজ্রের মতো হাজির হয়ে ঠাডা পড়ার মতো আমার সামনে একটা চটের ছালা ঝপাৎ করে ফেলে দিয়ে চলে যায় রকেটের মতো, এই নাও।

আমি স্বস্তির শ্বাস নিই। কোত্থেকে এলো? সে জবাব জানার কোনো প্রয়োজনও বোধ করলাম না। জানতে গেলেই আবার কোন গ্যাঞ্জাম এসে হাজির হয়। তাই আমি খুউব যতœ করে ছালাকে ভাঁজ করলাম। আরেকটা সমস্যা দেখা দিল। এক ছালা আম যা তা কথা নয়। একজনে আনব কী করে! ছালাতে ধরবে প্রায় দুই মণ আম। এমন না যে, মিনি ট্রাক ভাড়া করে নিয়ে আসব। তাহলে খাজনার চাইতে বাজনাই বেশি হয়ে যাবে। একজনকে নিয়ে যাওয়া দরকার। কাকে বলা যায়? প্রণবকেই বলব। কারণ ও শুধু কবিতা লেখে। বাপের একটা চারতলা বাড়ি আছে সেটার ভাড়া খায়। আর চাকরি পাল্টায়। আমি আবার বন্ধু প্রণবকেই ফোন করি, হ্যালো? তুই কি আমাকে সময় দিতে পারবি একটু?
প্রণব জানায়, খুব পারব। তার হাতে প্রচুর সময়।

আমি বললাম, আম আনতে যাব। এজন্যই তোর কাছে ছালার খোঁজ চাইছিলাম।

—ও আচ্ছা! তোকে আগেই বলে রাখি আমাকে নিয়ে গেলে কিন্তু ওয়ান থার্ড আম আমাকে দিতে হবে। জমি বর্গা সিস্টেম।

আমি বলি, আচ্ছা। তুই চল।

—আমাকে নারিন্দা থেকে উঠায়ে নিয়ে যাবি। ঠিক দশটায়।

—আচ্ছা। তুই রেডি থাকিস।

বের হওয়ার সময় মা’র কাছে বলতে গেলাম, মা, ফরিদ কাকার বাড়ি যাচ্ছি আম আনতে, উনি যেতে বলেছেন।

মা আমাকে মাথায় ফুঁ দিয়ে দোয়া করে বললেন, তুই যে এত বলদ আমি জানতাম না বাবা। ফরিদ ভাই দেবে তোকে আম! আচ্ছা যাচ্ছিস যা। বলে মা একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়েন। আমি দাঁড়ালাম না। আবার কী শুনি।

ফ্লাটের নিচে এসে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলাম। আমার গাড়ি আমি নিজেই চালাই। ছালাটা পিছনে রেখে গাড়ি স্টার্ট করি। প্রথম নারিন্দা যেতে হবে প্রণবকে ওঠানোর জন্য। তারপর নারায়ণগঞ্জ মাসদাইর। ফরিদ চাচার বাড়িতে। রাস্তায় তো আর সোজা চলা যায় না। ঠেলা, ধাক্কা, থামা সামলে ফাঁকফোকর দিয়ে গাড়ি রাজাবাজার থেকে নারিন্দা আনতে ঘণ্টা দেড়েক বেরিয়ে গেল। এরপর গাড়িতে উঠে প্রণব যা বলল তাতে আমার আক্কেলগুড়–ম! এটা তো আমার মনেই পড়েনি। প্রণব বলল, তোর আম চাচাকে ফোন করেছিস?

—আম চাচা? ও, ফরিদ চাচাকে? ভালো কথা মনে করেছিস, আচ্ছা দাঁড়া দেখি—। আমি গাড়ি স্লো করে ফরিদ চাচাকে ফোন করি, হ্যালো চাচা, আমরা আসছি। আম নেওয়ার জন্য।

—আরে মিয়া তোমাগো জন্য সকাল থেকে বইসা বইসা শেষে বের হইয়া আসছি। ছালা আনছ নি?
—এনেছি চাচা। আপনি এখন কোথায়?
—আমি তো ঢাকা মেডিকেলে। তুমি আসো, মেডিকেলে আসো। এক সঙ্গেই আমরা যামুনে।
এ তো এক মুশকিলে পড়ে গেল। কী আর করা গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিকেলে পৌঁছালাম। ফোন করে ফরিদ চাচার অবস্থান বের করি। ফরিদ চাচা দেখি অর্থোপেডিকসের আউটডোরে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখে বললেন, একটু দাঁড়াও। ধশ মিনিট।
ফরিদ চাচা সব সময় দ-কে ধ বলেন।

প্রণব আমাকে আড়ালে নিয়ে বলল, তুই দেখিস কপালে আজ দুঃখ আছে।
সেই ‘ধশ’ মিনিট শেষ হলো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমাদের ধস নেমে গেল। ফরিদ চাচা ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে বললেন, চলো, একটু ন্যাশনাল অর্থোপেডিকস ল্যাবে যাইতে হইব। কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে। স্যাম্পলটা দিয়ে আসি। কোনো অসুবিধা নাই তো? নাকি?
আমি বললাম, নাহ্ সব সুবিধা।
ফরিদ চাচা একবার আমার দিকে ঘড়েল চোখে তাকালেন, ঠাট্টা করছি কি না তা বোঝার জন্য।
প্রণব বলে, আমাকে ছেড়ে দে।
ফরিদ চাচা বলেন, আরে চলো চলো তুমিও আম নিয়ে আসবে। ফরিদ চাচা প্রণবকে আগে থেকেই চেনে।
প্রণব বলে, আমি তো ছালা আনিনি।
—সে নিয়ে চিন্তা করো না। জোগাড় হয়ে যাবে।

ন্যাশনাল অর্থোপেডিকস্ ল্যাব দারুস সালাম রোডে। গাড়ি নিয়ে আবার নেমে পড়লাম। সেখানে গিয়ে গিয়ে ফরিদ চাচা স্যাম্পল দিয়ে আসতে আসতে বেলা প্রায় বারটা বেজে গেল। আমরা পলাশী দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠে যাব। সেখান থেকে সোজা নারায়ণগঞ্জ। একেবারে সিরাতুল মুস্তাকিম।

কিন্তু না। সব সময় নিজের ইচ্ছামত সবকিছু চলে না। ফরিদ চাচা সাইন্স ল্যাবের কাছকাছি আসার পর বললেন, বাবলু বাবা, একটা মুরগির খাঁচা কিনতে হবে। তোর চাচি বলে দিয়েছে। ছাদে মুরগি পালবে। খুব শখ, ছাদে গিয়ে গরমাগরম মুরগির ডিম এনে আমাকে আদা পিঁয়াজ দিয়ে মামলেট ভেজে খাওয়াবে। একটু চাঁনখার পুলে চল। ওইখান দিয়া ফ্লাইওভারে উইঠ্ঠা যামুনে।

প্রণব বলে, বিষয়টা দারুণ হবে চাচা। সেই মামলেটটা হবে একদম প্রাকৃতিক। এজন্যই তো কবি বলেছেন, ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য। প্রণব উল্টাপাল্টা আন্দাজে বাণী ছাড়ে। আমার রাগ চড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি তেল তো এমনি এমনি গাড়িতে ভরে দেয় না! ব্যাটা এখন আমাকে জব্দ করার জন্য ফরিদ চাচার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অমলেটকে সুর মিলিয়ে বলছে, মামলেট।

প্রণব আগ বাড়িয়ে বলে, চল। চাঁনখার পুল হলো একটা ঐতিহাসিক জায়গা। বারবার যেতে ইচ্ছে করে। ঠিক যেন, একবার খেলে বারবার খেতে মন চায়-এর মতো। চাঁনখার পুলের ইতিহাস জানিস বাবলু, মোঘল আমলে...।

আমি বললাম, চুপ করবি! গাড়ি এবার চাঁনখার পুলের দিকে। আমার এখন মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ফরিদ চাচা চাঁনখার পুল থেকে চাচির হাতে গরমাগরম ডিম ভাজা খাওয়ার জন্য মুরগির খাঁচা কেনেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। চাচা খাঁচা কিনে এনেছে। ছোট্ট একটা খাঁচা। এ খাঁচায় কয়টা মুরগি ধরবে এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার আগেই প্রণব আলাপ জমায়, চাচা খাঁচাটা তো খুব ছোট হয়ে গেল না?

ফরিদ চাচা বলেন, একটা মুরগিই তো পালবে, ডিম তো শুধু আমি খাব।
—কিন্তু চাচা ডিম কি আর কেউ খায় না?
—খায়। পাইলে খায়।
প্রণব আমাকে বলে, ভাই যা বুঝতাছি, আমাকে ছেড়ে দে।
ফরিদ চাচা বলে, কী বুঝছ? যাইতে চাইছ ক্যান?
এবার আমি সুযোগ পেয়ে বলি, কেন? আম নিবি না? এতগুলো আম আমি আনব কেমন করে? চল।
আমি আবার চাচির জন্য একটু মিষ্টি কিনলাম। খালি হাতে যাব? তার ওপর আবার আম আনতে যাচ্ছি। আমরা গাড়িতে উঠে বসি। আর দেরি নয়। চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল। গাড়ি নিয়ে সাঁই সাঁই করে নারায়ণগঞ্জের দিকে ছুটি। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।

নারায়ণগঞ্জ শহরে বেশ তাড়তাড়িই এসে পড়ি। মাসদাইরের রাস্তাগুলো চিকন। অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে ফরিদ চাচার বাড়িতে পৌঁছালাম। কিন্তু সেখানে আবার আরেক সমস্যা। বাড়িতে ঢোকার পথে একটা গেট। গাড়িটা কোনোমতে ঢুকল। বের হব কীভাবে আল্লা মালুম। ফরিদ চাচা বাড়িতে ঢুকেই বেশ হৈ চৈ শুরু করে দিলেন, কে এসেছে দেখে যাও—

চাচি বাইরে এসে একবার দেখলেন। তারপর চলে গেলেন। এটা দেখে ফরিদ চাচা সান্ত¡না দেন, কিছু মনে করিস না, উনি এরকমই।
আমি বললাম, ঠিক আছে। কিছু মনে করলাম না। তাড়াতাড়ি আম দেন চলে যাই। ক্ষিধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।

একথা শুনে ফরিদ চাচা আঁতকে ওঠেন, আরে বলছ কী! আমার বাসায় আসছ না খেয়ে যাবে নাকি? আগে খাওয়া-দাওয়া তারপর আম।
আমি বলি, আজ থাক আম দেন আরেকদিন এসে খেয়ে যাব।
—না না, আগে খাওয়া-দাওয়া কর।
প্রণব বলল, এমন করছিস কেন? মুরব্বিদের কথা শুনতে হয়।
কী আর করা। হাত-পা ধুয়ে টেবিলে বসি। চাচাই এপর্যন্ত পানিটানি এনে দিয়েছে। খাওয়ার টেবিলে বসার পর চাচি পাথর মুখে ঠা-া ভাত আর ডালের বাটি নিয়ে আসেন। চাচির দোষ নেই। জানি চাচি চাচার যন্ত্রণায় অস্থির থাকেন। চাচা বলেন, আরে মুরগির বাটি আনো। মুরগির বাটি দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপি। লালমনিরহাটের মুরগির ঝোল। কেবল লাল রঙটাই দেখা যাচ্ছে। থকথকে মরিচ গোলা। চাচি সিলেটি রান্না রেঁধেছে। মুরগির টুকরা কোথায়?

প্রণব বলে, চমৎকার! চাচা! বলে ঝপাঝপ করে মরিচ গোলা নেয় তারপর ঘুটে ঘুটে একটা মুরগির টুকরা বের করে। আমার দিকে বাটি ঠেলে দিয়ে বলে, নে—
এরমধ্যে খানিকটা ঝোল আঙুলের ডগায় মাখিয়ে, কপাত শব্দ করে চেটে বলে, ফাটাফাটি! নে নে। ওর মুখে স্বাদের ফুলঝুরি।
আমি জানি হারামি আমাকে কী বিপদে ফেলতে চাইছে। আমিও বাধ্য হয়ে নেই। ভাত মেখে মুখে দেওয়ার পর আমার ব্রহ্মতালু অব্দি জ¦লে যায়। হায় আগামীকাল অরুণ প্রাতে নবপ্রভাতে কী জানি কী হাল হয়! আমার চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে নামতে লাগল। প্রণব ফরিদ চাচার সঙ্গে আলাপ জমায়, চাচা, নজরুলের ওই গানটা কেমন লাগে আপনার?
—কোন গানটা? ফরিদ চাচা গানের সমঝদার হয়ে ওঠেন। ভাবখানা এই যেন কত গান শোনেন!
প্রণব বলে, ঐ যে নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল?
—এটা পল্লীগীতি না? ফরিদ চাচা জানতে চান।
—হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রণব উৎসাহ জোগায়।
আমি কোনো রকমে বলি, এটা নজরুল গীতি।
প্রণব আমাকে বলে, আরে খাবারের সময় কথা বলিস না। খাওয়া শেষ কর।
খাব কী? আমি শেষ। প্রণব তেমন একটা মুখে দিচ্ছে না। আমার মুখে আগুন জ্বলছে।
খাওয়া শেষ করে সামনের ঘরে এসে বসলাম। হাত অব্ধি জ¦লছে। এমন সময় ফরিদ চাচা বললেন, দাঁড়াও আম নিয়ে আসি।
আমি বলি, ছালাটা নিয়ে আসি। আমি ছালা আনতে গাড়ির কাছে গেলাম। গাড়ির পিছনে ছালাটা রাখা।
ঘরে এসে দেখি ফরিদ চাচা কালো কালো গোটা দশেক দেশি আম নিয়ে বসে আছে। ছালা হাতে ঘরে ঢুকে আমার আক্কেলগুড়–ম!
আমি বলি, চাচা আপনি কিন্তু ছালা আনতে বলেছিলেন।
ফরিদ চাচা তোতলায়, আইজ এই কয়টাই নিয়ে যাও। আবার আসবা। একবারেই কি শেষ নাকি?
প্রণব পাশ থেকে বলে, তাই তো। চাচার বাড়িতে মানুষ কি একবারই আসে নাকি?
ফরিদ চাচা কৈফিয়ত দেয়, হে হে রাখছিলাম এক বস্তাই কিন্তু তোমার ভাই রিন্টু আমি বাসা থেকে যাওয়ার পর বাজারে নিয়া বেইচ্যা দিছে। দুষ্ট পোলাপাইন।
চাচি এবার ভিতর থেকে চিল্লিয়ে ওঠেন, এ্যাই মিথ্যা কথা বল কেন? এক বস্তা আম আবার আমাদের গাছে কবে ধরল? আম তো ছিল সের পাঁচেক। তুমি না যাওয়ার সময় বইলা গেলা বিক্রি করে ফেলতে? নিজেদের খাওয়ার আম নাই আবার দান!
ফরিদ চাচা ধমক দেয়, সব খালি আমার দোষ? এখন ওগো কী দেই?
প্রণব বলে, তাহলে আজ আসি চাচা। আজ আর দিতে হবে না। আম ধরলে আবার আসব। চল রে।
ফরিদ চাচা ভিতরে গিয়ে একটা বড় দোমড়ানো পলিথিন এনে কালাকুষ্টি নয়টা আম ভরে হাতে তুলে দেয়।
রাগে আমার গা জ¦লছে। আমি ছালা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ফরিদ চাচা পিছন থেকে বলে, আবার আইবি কিন্তু।
প্রণব বলে, অবশ্যই আসব। চাচা ছালাটা রেখে দিবেন নাকি? সামনের বছর তো আবার লাগবে।
আমি রাগে গরগর করতে করতে চাচাকে কিছু না বলে প্রণবকে বললাম, চল চল। বেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। প্রণবকে বললাম, তুই একটু দ্যাখ আগে গাড়িটা গেট দিয়ে বের করতে হবে। পিছনে যা। হাতের আমগুলো ধপাস করে পিছনের সিটে ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। প্রণব পিছনে গিয়ে বলতে লাগল, ডাইনে এই আরেকটু বায়ে... হ্যাঁ হ্যাঁ আরেকটু বাঁয়ে...।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গাড়ির বাম্পার গিয়ে ঠুকুস করে গেটের সিমেন্টের থামে লাগল। আমি হতদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পিছনে এসে দেখি গাড়ির বাম্পার এক পাশে খুলে গিয়ে ল্যাড়ল্যাড় করে ঝুলছে!
প্রণব আমাকে উল্টো ঝাড়ি দেয়, তোকে না বললাম ডাইনে ডাইনে...।
ফরিদ চাচা দৌড়ে এলেন, কী হইল? গাড়ি ভাইঙা ফেলছ? আহা! তিনি আমার বাম্পার দেখে বললেন, দাঁড়াও একটা ব্যবস্থা করতাছি।
উনি কী ব্যবস্থা করবেন? তিনি দৌড়ে দালানের ভিতর গেলেন এবং ফিরে এলেন হাতে দুইটা মোটা সুতলি নিয়ে। আমাকে বললেন, নেও এইটা দিয়া আপাতত গাড়ির লাঠিটা বাইন্ধা নেও পরে ঢাকা গিয়া ঠিক করে নিও।
প্রণব আগ বাড়িয়ে চাচার হাত থেকে সুতলি নিয়ে বাম্পার বাঁধতে বসে যায়। আমার পেট মোচড় দেওয়া শুরু করেছে। ফরিদ চাচার বাড়ির মুরগি মনে হয় পেটে গিয়ে আবার আস্ত হয়ে গিয়ে হাঁটাচলা শুরু করেছে। যা ঝাল ছিল!
নিয়ে এলাম আস্ত গাড়ি ফেরত নিচ্ছি ভাঙা গাড়ি। দুর্ভোগ আসে ছাপ্পড় মারি।

শনির আখড়ার কাছে এসে প্রণব বলল, কি রে পেটটা তো খুব ব্যথা করছে, যা মরিচ দিয়েছে মুরগির মধ্যে! কী ছাই রান্না।
এবার আমার পালা, খা খুব না স্বাদ লাগছিল তোর? আমার এখন ইচ্ছা করছে তোকে আবার ফরিদ চাচার বাসায় নিয়ে খাইয়ে আনি। হারামি!
প্রণব কোঁকায়, না রে ভাই, তোকে ডোবানোর জন্য ওটা বলেছি।
আমি বলি, পাপের ফল ভোগ কর।
আমারও যে পেটে বেদম মোচড় দিচ্ছে সে কথা বেমালুম চেপে গেলাম। অন্তত এ জায়গায় ও জানুক আমি ভালো আছি।
যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের কাছে এসে দেখি গাড়ির বেশ ভিড়। সামনে জ্যাম। লোকজন বলছে সামনে পুলিশ গাড়ি চেক হচ্ছে। গোপন সূত্রে পুলিশ নাকি খবর পেয়েছে মাদকের। পুলিশের কথা শুনেই কি না পেট আরও গুমরে ওঠে। যাক আমরা তো আর মাদক চালান দিই না। আমাদের যখন পালা এলো তখন দেখি একটা পুলিশের দল দাঁড়িয়ে আছে। একজন সার্জেন্ট বলল, নেমে আসেন। পিছনের বনেটটা খুলে দিন।

আমি নেমে পিছনের বনেট খুললাম। সেই ছালাটা পড়ে আছে। একজন কনস্টেবল ছালাটা দেখেই অনেক কিছু পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, স্যার একটা ছালা দেখতাছি। পাটের ছালা।

ততক্ষণে প্রণবও নেমে এসেছে।
ছালা আবার স্টিলের হয় নাকি? পুলিশ অফিসার দৌড়ে এলো। ছালাটাকে কনস্টেবল হাতে ঝুলিয়ে বলল, এই যে স্যার—
পুলিশ অফিসারটা যে পরিমাণ গাট্টাগোট্টা বুঝলাম এর সঙ্গে অন্তত ঠাট্টা করা যাবে না। অফিসার আমাকে বললেন, আপনার গাড়িতে ছালা কেন? কোথায় যাচ্ছিলেন? কী করেন?
আমি বললাম, আম আনতে।
—কী বললেন, আম আনতে? আম আনতে কেউ ছালা নিয়ে বের হয় নাকি? নাকি ফেনসিডিল ডেলিভারি দিতে? তারপর কনস্টেবলকে বললেন, অ্যাই গাড়িটা ভালো করে চেক করো। ছালাটা আমার কাছে দাও। অফিসারের হাতে ছালা দিয়ে কনস্টেবল গাড়ি চেক করতে লেগে গেল। সামনের সিটে কালাকুষ্টি আমগুলো দেখে কনস্টেবল বলল, স্যার এখানে কতগুলো আম দেখতাছি।
পুলিশ অফিসার প্রণবকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কী করেন?
—আমি কবি। কবিতা লেখি।
—কবিতা! কবিতা লিখে পেট চলে? ফাজলামির জায়গা পান না?
প্রণব পুলিশকে তাৎক্ষণিক যা মন চায় কবিতা শোনায়, বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়/ এমন লোক নাই দুনিয়ায়/ পুলিশরে পায় না ভয়, দেখলেন তো আমি কবি। বিলিভ মি।
অফিসার কেমন একটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের চোখে প্রণবের দিকে তাকায়। প্রণব বলে, আরেকটা শোনাব?
—না না, কবিতা শোনার সময় নাই। কনস্টেবল ততক্ষণে আমের পলিথিন নিয়ে এসেছে। কনস্টেবল এক লাইন বেশি বুঝে অফিসারকে বলে, স্যার আমগুলো কেটে দেখা দরকার। এরমধ্যে বাবাও থাকতে পারে।
অফিসার বললেন, কাটো—
আমার পেটে ঘূর্ণিঝড়ের মাতম। দাঁতে দাঁত চেপে আছি। আরেকজন কনস্টেবল কোথা থেকে একটা ছুরি এনে আমগুলো ঘচাঘচ বনেটের ওপর রেখে কাটতে লাগল। যা, আমগুলো গেল।
কিছু না পেয়ে কনস্টেবলটা বলল, স্যার কিছু নাই।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো কোনো ড্রাইভার বলছিল, দেন হালাগো চৌদ্দ শিকের মধ্যে হান্দাইয়া।
অফিসার আবার আমাকে ধরল, ছালা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?
—আম আনতে।
—আমি কিন্তু বিশ্বাস করলাম না। কী করেন?
—ব্যাংকে চাকরি করি।
—ছালাটা রেখে যান। আর গাড়ির নাম্বারটাও লিখে রাখছি। যদি কোনো সময় এই গাড়ি বাবাসহ ধরা পড়ে তাইলে কিন্তু আপনার কপালে খারাবি আছে।
যা, ছালাও গেল!
পাশ থেকে এক কনস্টেবল বলে, স্যার দুইটার একটা ছবি তুইল্যা রাখেন আপনের মোবাইল ফোনে।
অফিসারের কথাটা মনে ধরল। আমাদের দুজনকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পিট্টাশ পিট্টাশ শব্দ করে মোবাইলে ফটোও তুলল। প্রণব পোজ দিতে গিয়ে আবার মৃদু হাসছিল। অফিসার ধমক দেয়, আপনি আবার হাসছেন কেন?
—পেটটা ব্যথা করছে তো তাই, প্রণব জানায়।
অফিসার ভ্যাবাচ্যাকা খায়, মানে!
—কবি তো তাই সবকিছু উল্টাপাল্টা, প্রণব বুঝিয়ে দেয়।
অফিসার বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। দিশা না পেয়ে কনস্টেবলদের ধমক দেয়, ওই অন্য গাড়ি দেখো, যত্তসব পাগল ছাগল ধরে নিয়া আসছে!
আমরা কাটা আমগুলো ফেলে যাচ্ছিলাম দেখে একজন কনস্টেবল বলল, এই যে আম নিয়া যান।
আমার রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। বললাম, ওগুলো আপনাদের জন্য। আর দেরি করলাম না। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে দিলাম। একটানে যাত্রাবাড়ি থেকে নারিন্দা। প্রণবদের গলির সামনে এনে গাড়ি দাঁড় করালাম। প্রণব নামার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আবার কবে যাচ্ছি?
আমার মেজাজ আর মেজাজ নাই। সেটা এখন তাওয়ায় ভাজা কলাইয়ের মতো হয়ে রয়েছে। বললাম, উনি মরলে। ভাই তুই নাম। দূর হ।
প্রণব যাওয়ার সময় হাত নাড়ায়, টা টা। আম আনতে গেলে বলিস।
আমার আর কথা বলার প্রবৃত্তি ছিল না। গাড়ি স্টার্ট দিলাম। বাসায় গিয়ে আমার আরেক দফা বউকে সামাল দিতে হবে। কী খাওয়ায়েছে রে! কেন খেলাম? এই দার্শনিক প্রশ্ন তখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
বউ আমার খালি হাত দেখে বলল, আম কই?
—আনতে পারি নাই।
—ছালা?
—আমও গেছে ছালাও গেছে।
বউ ছালা নিয়ে একটা ঘোট পাকাবার আগেই আমি দৌড়ে টয়লেটে ঢুকে মানসম্মান রক্ষা করি।
রাতে প্রণবকে ফোন করলাম, কী রে কী অবস্থা?
—খালি আম যাচ্ছে। তোর?
—আমারও।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper