ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হার না মানা ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২১

হার না মানা ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী

বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের ব্যতিক্রমী রূপদর্শী প্রাকৃতিক ভাস্কর তিনি। নব্বই দশকের গোড়ায় শিল্পবোদ্ধাদের চমকে দিয়েছিলেন নিজের সৃজন সমাহার দিয়ে। কেটে ফেলা গাছের শিকড়, শুকনো ডাল আর তুচ্ছ সাধারণ উপকরণ দিয়ে চেনা আদল তৈরি করে অপ্রচলিত এক শিল্পধারাকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন ভাস্কর, হার না মানা লড়াকু মানবী তিনি। প্রিয়ভাষিণীর সংগ্রামী সেই জীবনের কথা তুলে ধরেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

জন্ম ও শৈশব
দেশভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম খুলনায় নানার বাড়িতে। তার বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং মায়ের নাম রওশন হাসিনা। বাবা-মায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী ছিলেন সবার বড়। খুলনায় তার জন্মস্থান নানা বাড়ির নাম ছিল ফেয়ারি কুইন বা পরীর রাণী। প্রিয়ভাষিণীর ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনে নানা বাড়ির প্রভাব অপরিসীম। নানা বাড়িতেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। এখানেই প্রকৃতির সঙ্গে মিলে-মিশে একাত্ম হওয়ার প্রথম সুযোগ ঘটে তার। খুব ছোট বেলা থেকেই অনেক বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন তিনি। তার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক ছিলেন খুলনার দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক এবং মা রওশন হাসিনা ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী। প্রিয়ভাষিণীর বাবা মায়ের জীবন কিছুটা এলোমেলো থাকায় জন্মের পর থেকে তিনি মায়ের সঙ্গে নানার বাড়িতেই থাকতেন। তার নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল ও শিল্পানুরাগী মানুষ। প্রিয়ভাষিণীর শৈল্পিক নামটিও তিনিই রেখেছিলেন। নানা বাড়িতে এক শৈল্পিক সাংস্কৃতিক পরিম-লে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। ফেইরি কুইন নামের সে বাড়ির সবাই কোনো না কোনোভাবে শিল্পের কোনো না কোনো শাখার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রিয়ভাষিণীর নানার সংস্কৃতিমনা এ পরিবারটির বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়, বাড়িটির এক ঘরে ক্যারাম খেলা চলতো তো আরেক ঘরে চলতো লেখালেখি, আবার আরেক ঘরে আবৃত্তি চলতো তো অন্য ঘরে বসতো গানের আসর। এমন একটি সবুজ শ্যামল পরিবারের শৈল্পিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে উঠতে তার ভেতরেও বেড়ে উঠতে থাকে শিল্পসত্ত্বা। পরবর্তী জীবনে ভাষ্কর হয়ে ওঠা হয়তো সেই সত্ত্বারই পরিপক্ক রূপ।

পাঁচ বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণী নানার পরিবারের সঙ্গে খুলনার ফেইরি কুইন নামের বাড়িটি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। সে সময় বালিকা প্রিয়ভাষিণীকে ভর্তি করা হয় টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে। এই নারী শিক্ষা মন্দির থেকেই তার শিক্ষাজীবন শুরু। তবে বেশিদিন তিনি থাকেননি সেখানে। দুই বছর পর ১৯৫৪ সলে প্রিয়ভাষিণীর নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ যুক্তফ্রন্টের শাসনামলে স্পিকার নিযুক্ত হলে নানার পরিবারের সঙ্গে প্রিয়ভাষিণীর ঠাঁই হয় মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। এখানে আসার পর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে ভর্তি করানো হয় সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। নানা বাড়িতে থাকাকালীন তিনি বহু গুণী মানুষের সহচর্য পান। এদের মধ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অন্যতম। মিন্টো রোডে তার নানার বাড়ির ঠিক তিন বাড়ি পরেই থাকতেন শেরে বাংলা। সেই সুবাদে খালাদের আঁচল ধরে বালিকা প্রিয়ভাষিণী মাঝে মাঝেই যেতেন শেরে বাংলার বাড়িতে। কিন্তু প্রিয়ভাষিণীর প্রিয় জায়গা নানা বাড়িতে বেশি দিন আর থাকা হয়নি তার। নয় বছর বয়সে তাকে তার বাবা খুলনায় নিজের কাছে নিয়ে আসেন।

শিক্ষা ও বৈবাহিক জীবন
খুলনায় এসে প্রিয়ভাষিণী প্রথমে বীণাপনি পাঠশালায় ভর্তি হলেও পরে সেখান থেকে খুলনা পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে তিনি এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইসএসসি ও পরে স্নাতক সম্পন্ন করেন। নানার বাড়িতে স্বাধীন ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে মুক্ত হরিণীর মতো ছুটে চলা প্রিয়ভাষিণী বাবার কাছে এসে বিবিধ শাসন ও নিয়ম-কানুনের বেড়াজালের সম্মুখীন হন। ততদিনে কেটে গিয়েছে কয়েকটি বছর। প্রিয়ভাষিণী তখন কিশোরী। তার ভেতরের স্বাধীনচেতা সত্ত্বাটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে। আর যেন বাবার কড়াকড়ি মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। কথায় আছে, অতি শাসনে সন্তান নষ্ট হয়, শাসনের বেড়ি ভাঙতে গিয়ে নিয়ে ফেলেন ভুল সিদ্ধান্ত। প্রিয়ভাষিণীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে। পরিবারের কড়াকড়ি থেকে মুক্তি পেতে ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৫ বছর ছয় মাস বয়সে একদিন প্রেমিককে বিয়ে করে বসেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল প্রিয়ভাষিণীর। কেননা তিনি ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, যে মানুষটি কিশোরী প্রিয়ভাষিণীকে ভালোবাসার বদলে দিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা।

তাছাড়া সংসারের অভাব অনটনও তখন নিত্যসঙ্গী ছিল তার। এ সময় তিনি স্কুলের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন পাটকলে। জীবন সংগ্রামের এই বৈতরণী পার হতে গিয়ে এক সময় বারবার মনে হয়েছে বড় ভুল করেছেন তিনি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না তখন। কেননা ততদিনে তার ঘরে এসেছে তিন-তিনটি সন্তান। ভুল মানুষটির প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও ভালোবাসার পুরোটা জুড়ে তখন তার সন্তানেরা। কী করে ভেঙে ফেলবেন তিনি এমন বাসা?

তাই মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন ফেরদৌসী। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়ে ওঠে না। অবশেষে ১৯৭১ সালে ভেঙে যায় তার সংসার। পরে ১৯৭২ সালে প্রিয়ভাষিণী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ আহমেদ ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। তার জীবন সংগ্রামে তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী ছিলেন তার স্বামী। তাদের ছয় সন্তান। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে।

কর্মজীবন
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। মাঝে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। তিনি ইউএনডিপি, ইউএনআইসিইএফ, এফএও, কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন এবং তা অবিরামভাবে অব্যাহত রাখেন। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ভাস্কর। তার শিল্পকর্ম বেশ জনপ্রিয়। মূলত ঘর সাজানো এবং নিজেকে সাজানোর জন্য দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান করা থেকেই তার শিল্পচর্চার শুরু। নিম্নআয়ের মানুষেরা কিভাবে অল্প খরচে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে সে বিষয়গুলো তিনি দেখিয়েছেন। ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুড়ি দিয়েই মূলত তিনি গৃহের নানা শিল্পকর্মে তৈরি করতেন।

প্রথম দিকে নিজের প্রতিভাকে গুরুত্ব সহকারে নেননি তিনি। নিতান্তই সময় কাটানো ও ভালোলাগা থেকেই তিনি বানাতেন এগুলো। কিন্তু পরবর্তীতে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের অনুপ্রেরণায় তিনি তার প্রতিভার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। এসএম সুলতানের সাহায্যেই ১৯৯৪ সালে বেঙ্গলে তার ভাস্কর্যের প্রথম প্রদর্শনী হয়। দেশে-বিদেশেও তার শিল্পকর্মগুলো সমাদৃত হওয়া শুরু করে। আর সমাজ সংসারের দেওয়া অপবাদ ও বিগ্রহের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রিয়াভাষিণী হয়ে ওঠেন ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী। তার শিল্পে উঠে আসে দ্রোহ, যাপিত জীবনের আনন্দ, বেদনা ও ভালোবাসা। তিনি দেশে-বিদেশে সমাদৃত হতে থাকেন একজন ভাস্কর হিসেবে। তার শিল্পকর্মের একে একে ১১টি একক প্রদর্শনীসহ বেশকিছু যৌথ প্রদর্শনী হয়। তিনি পান সম্মানের জায়গা, পান শ্রদ্ধার জায়গা।

ফিরে আসা
ক্যাম্প পালিয়ে তিনি হায়েনাদের কবল থেকে বাঁচলেও সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণা নিয়মিত তাড়া করে ফিরছিল ভাষিণীকে। তিনি এতটাই বিষাদগ্রস্থ ছিলেন যে তখন আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও ভয় পেতেন।

ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাইরে এসে তিনি যে দৃশ্য অবলোকন করলেন তা ছিল আরও ভয়াবহ। তার মনে হলো সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। সবাই এমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে যে, সেই চাহনিতে পরিষ্কারভাবে উঁকি দিচ্ছে অচ্ছুৎ, কুলটা, বোঝা জাতীয় বিশেষণগুলো। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর কোথাও কোনো জায়গাই যেন তার জন্য না। এমনকি নিজের বাড়িও যেন তখন তার কাছে অপরিচিত স্থান। তার বাড়ির প্রগতিশীল চর্চাকারী সদস্যরাও কেমন যেন নড়ে উঠেছিলেন তাকে দেখে। তাদের মাঝেও কেমন যেন অনীহা কাজ করছিল তার প্রতি। সম্ভ্রম হারানোর গ্লানি তাড়া করে বেড়ানো ফেরদৌসী পরিবারের সদস্যদের এমন আচরণে আরও কুকড়ে যান। সবার কাছে এমন পরিত্যক্তা হয়ে যখন মৃতের মতো জীবনযাপন করছিলেন, ঠিক তখন তার কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে, তাকে মানুষের মতো ভালোবাসতে পাশে এসে দাঁড়ান এক মহামানব। তিনি প্রিয়ভাষিণীর দ্বিতীয় স্বামী। নাম আহসান উল্লাহ। আর কেউ সেদিন প্রিয়ভাষিণীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও রণাঙ্গনের এই বীর যোদ্ধা তার সবটুকুই দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে আহসান উল্লাহর সঙ্গে বিয়ে হয় প্রিয়ভাষিণীর। তারপরও তার বারবার মনে হত, যুদ্ধে যে নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে সেই লজ্জা তো সেই নারীর নয়, সেই অপরাধ তো সেই নারীর নয়। তবে কেন তাকে অপরাধী হতে হবে? তাকে কেন থাকতে হবে পরিত্যক্তা হয়ে? এসব ভাবতে ভাবতে আর যেন পারছিলেন না। এক সময় সিদ্ধান্ত নেন জনসম্মুখে তিনি তার সব হারানোর কথা প্রকাশ করবেন, ত্যাগের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু এতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা ছিল। ভয় ছিল আবার নতুন করে সর্বহারা হওয়ার। এমনকি নিজের সন্তান-সন্তুতিরও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সর্বহারা প্রিয়ভাষিণী হারাতে হারাতে হারানোর ভয়টাকে আর প্রশয় দেননি। অবশেষে দীর্ঘ ৩০ বছর পর জনসম্মুখে একাত্তরের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে প্রিয়ভাষিণী প্রকাশ করেন তার ওপর পাকবাহিনীর চালানো পাশবিক নির্যাতনের ইতিহাস, পতাকার জন্য তার সর্বস্ব ত্যাগের গল্প। নিন্দিত নন্দন বইয়ে তিনি তুলে ধরেন দুর্বিষহ সেইসব স্মৃতিকথা। তার লেখনীতে যেমন উঠে এসেছে একাত্তরের লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা, তেমনি উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। রাজনৈতিক পালা-বদলে উপেক্ষিতা বীরাঙ্গনাদের মতোই নিভৃতচারী ছিলেন দীর্ঘকাল।

একাত্তর ও প্রিয়ভাষিণী
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবনের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, মিশে আছে বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবন কাহিনী। তিনি একাত্তরের ভয়াবহ নির্যাতন সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দি-দানকারী। ট্রাইব্যুনালে রাজাকার ও তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালে প্রথম সংসার ভেঙে যাওয়ার পর প্রিয়ভাষিণী ভাবলেন, এবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন। নিজ হাতে জীবনকে তিনি সাজাবেন, গোছাবেন ও রাঙিয়ে তুলবেন। কিন্তু হায়, ভাগ্য যেন এবারও প্রতিকূলে ছিল তার। একবার জীবন সাজাতে ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, আর এবার যখন জীবন সাজাবেন বলে স্থির করলেন তখন জাতির জীবন টালমাটাল! বাতাসে লাশ আর বারুদের গন্ধ। বিপন্ন মানবতা, অধিকার আদায়ের দাবিতে গর্জে উঠেছে বাঙালি। ফেরদৌসীর পরিবারের সবাই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার ভাইয়েরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন আর তাদের বাড়িতে তার মায়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। যোদ্ধাদের খাদ্য, ওষুধ সবই সরবরাহ করা হতো সেখানে। আর এই যুদ্ধই প্রিয়ভাষিণীর জীবনে নিয়ে আসে এক অবর্ণনীয় বিভীষিকা।

এটি ছিল অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। একদিন রাত তিনটার সময় হঠাৎই তার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত মেয়েটি এসে তাকে জানায়, পাকবাহিনী তার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। প্রথমে তিনি আমলে নেননি কথাটি। কেননা তখন ওরকম গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামা এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিনই খান সেনারা কাউকে না কাউকে এভাবে তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু মেয়েটি জানালো, ওরা তার বাড়িটিই ঘিরে ধরেছে এবং সম্ভবত তাকেই চিৎকার করে নামতে বলছে। এবার যেন একটু নড়ে বসলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে দেখলেন বাড়ির সামনে ছয়টা গাড়ি, নেমে আসছে খানসেনারা। বুঝলেন, টার্গেট এবার তিনিই। তাকে দেখা মাত্রই ওরা বলে উঠলো, ‘আমরা ফেরদৌসীকে চাই, ফেরদৌসী উপর থেকে নামো।’ সাক্ষাত যম যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন নিস্তার পেতে মানুষ কত বুদ্ধিই না খাটায়। ফেরদৌসীও তেমন পাক হায়েনাদের হাত থেকে নিস্তার পেতে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলে বসলেন, ‘ফেরদৌসী এখানে নেই, সে খুলনা গিয়েছে।’ কিন্তু লাভ হলো না কোনো। কেননা ওদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় দুজন পাঞ্জাবি প্রিয়ভাষিণীকে আগে থেকেই চিনতো। সেই রাতে প্রিয়ভাষিণী কাজের মেয়েটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার কথা বলে একদিন সময় নেন।

পরদিন ওরা আবার আসে। ধর্মের নামে যুদ্ধে নামা অমানুষগুলোর অধিকাংশই সেদিন ছিল মদ্যপ। প্রিয়ভাষিণী নিজের পোশাক পরিবর্তন করার সময় চাইলে তারা তো দেয়ই না, বরং কু-ইঙ্গিত করে বলে, ‘আমরা তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেবো।’

পাকবাহিনীর দুই দোসর হত্যার মিথ্যা অভিযোগে ওরা নিয়ে চলে প্রিয়ভাষিণীকে। গাড়িতেই সেদিন পাকবাহিনীর হাতে গণধর্ষণের স্বীকার হন তিনি। প্রিয়ভাষিণীর আর্তনাদে সেদিন ওদের মন গলেনি। খানসেনাদের অকথ্য গালাগালি ও পাশবিক নির্যাতন আর প্রিয়ভাষিণীর আর্তচিৎকার একসঙ্গে বয়ে নিয়ে ক্যাম্প অভিমুখে ছুটতে থাকে জলপাই রঙের জিপটি।

ক্যাম্পে নিয়ে তাকে বাঁশের বেড়ার এক খুপরি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। হায়েনার ক্যাম্পে গিয়ে প্রিয়ভাষিণী অবলোকন করেন পাকবাহিনীর অমানুষিক বীভৎসতা। সেখানে অসংখ্য নারীকে তিনি দেখতে পান। তাদের কেউ ছিল অর্ধনগ্ন, কেউ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অসংলগ্ন আচরণও করছিল। প্রিয়ভাষিণী বুঝতে পারেন হায়েনাদের পাশবিক অত্যাচারের ফসল এটা। নির্যাতনের ফলে মেয়েগুলো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ক্যাম্পের এমন ভয়ার্ত পরিবেশ প্রিয়ভাষিণীকে ভয়ে কুকড়ে দেয়। তিনি এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে ছোটবেলায় মায়ের থেকে কারও কাছে মাথা নত করতে না শেখা প্রিয়ভাষিণী যাকে-তাকে পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও।’ তার অবস্থা তখন এতটাই অসহায় ছিল যে পাকবাহিনীর এক আফিসার তাকে দেখে মর্মাহত হয়ে পড়ে। পরে ওই কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।

প্রিয়ভাষিণীকে নিয়ে ‘অপ্রিয়’ ভাষণ
শফিক হাসান

তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। যদিও উপলক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল কয়েকবার। তাই বলে একেবারেই যে স্বচক্ষে দেখিনি বিষয়টাও এমনও নয়। কৌতূহল ছিল নামটা নিয়েÑ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। নামটা বাবা-মা রেখেছিলেন নাকি নিজেই সংস্কার করে নিয়েছিলেন কিছুটা! প্রিয়ভাষিণী কারও নাম হতে পারে, তাও ১৯৪৭ সালেÑ চিন্তা করে থই পাই না। এটা ঠিক, বাবা-মা মার্জিত রুচির হলে সেটারই প্রভাব পড়ে সন্তানের নামকরণসহ জীবনাচরণে। বলাবাহুল্য, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আমার পছন্দের নাম। এটা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু ২০১৪ সালের বইমেলায় যখন তার আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয়, চমকে গিয়েছিলাম। নন্দনও নিন্দিত হয়! তার চিন্তা ও শিল্পবোধের পরিধি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা জন্মাল।

মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নারীর মতো তিনিও পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হন। এই অতুল ত্যাগের জন্য অনেকেই বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে তাকে। সম্ভবত ২০১৪ সালের দিকে শাকিলা সুমী এলেন আমার কার্যালয়ে। কথায় কথায় প্রশ্ন করলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা।

হেসে বললাম, যোগাযোগ না থাকলে হতে কতক্ষণ! শাকিলা আপা জানালেন, তিনি প্রিয়ভাষিণীর খুব ভক্ত। দেখা করতে চান একবার। বিশেষ করে একাত্তরের উত্তাল প্রেক্ষাপট নিয়ে তার অনেক প্রশ্ন। কথা দিলাম, সাক্ষাৎকার নিতে যাব প্রিয়ভাষিণীর। তখন সঙ্গে নেব। পরিচিত একজনের কাছ থেকে ফোন নম্বর সংগ্রহ করলাম। যতবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা মনে করি, শাকিলা সুমীর কৌতূহলের কথা মনে পড়ে। সন্তান হয়ে কীভাবে মাকে নির্যাতন বিষয়ে প্রশ্ন করব? চোখের সামনে যখন বীভৎস সব দৃশ্য ভেসে বেড়াতে শুরু করে, সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসি। বলা ভালো, পালিয়ে বাঁচি নিজের কাছ থেকেই!

এর কয়েক বছর দ্বিতীয়বার সামনাসামনি যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হল। কিন্তু ‘পিছলে’ গেল এবারও। ঢাকার একটি সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার বই ‘চিকিৎসা সেবায় শাহলা খাতুন’। শাহলা খাতুন জাতীয় অধ্যাপক, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘ধাত্রী’। নিজের পরিচয়ই এমন বহুধা বিস্তৃত তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বোন এমন পরিচয় বাহুল্য। যা হোক, জীবন ও কর্মভিত্তিক বইটির প্রকাশনা উৎসব হবে এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে। এবার অতিথি বাছাইয়ের পালা। পছন্দের মানুষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে কল করে আবেদন জানালাম। তিনি শাহলা খাতুনকে চিহ্নিত করলেন ‘পঞ্চাশ বছরের ডাক্তার’ বলে। তারও খুব পছন্দের মানুষ শাহলা আপা। তবে শর্ত দিলেন গাড়িতে করে তাকে অনুষ্ঠানে নিতে হবে, শেষে পৌঁছেও দিতে হবে। শর্ত মেনে নিলাম।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত থাকবেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের সব আয়োজন সম্পন্ন। শেষ মুহূর্তে প্রকাশক জানালেন, অনুষ্ঠানটি আরও কিছুদিন পরে করতে চান। সংশ্লিষ্টরা বিরক্ত, আমি বিব্রত। জানি না, কোথায় কী সমস্যা ছিল। তবে সেই অনুষ্ঠান এখনো হয়নি! দ্বিতীয়বারের মতোও ছিটকে পড়লাম প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গ থেকে।

তার সবকিছুই দেখতাম মুগ্ধতা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’কে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সেখানে যৌথ বিবৃতি দিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও। আলোর সঙ্গে অনেক ধূলিকণাও আসে। রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত চলচ্চিত্রটিকেও সেই ধূলিকণা হিসেবেই দেখতে অনুরোধ জানানো হল। আমার কেন যেন মনে হল, বাক্যটি ফেরদৌসী আপারই লেখা!

ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে পেয়েছিলাম শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। বক্তা ও উজ্জীবক হিসেবে তার উপস্থিতি ছিল অনন্য। কপালে ইয়া বড় যে টিপ পরতেন, সেটাও মুগ্ধতার বড় উৎস। মনে হত, জাতীয় পতাকায় সবুজের মাঝখানে লাল যে বৃত্তটা, সেটাই ধারণ করেছেন তিনি। কপালটা যেন পতাকার সবুজ অংশ। এভাবেই আমি মা, মাটি, জন্মভূমির সঙ্গে ফেরদৌসী আপাকে দেখতে ভালোবাসি। তাকে ঘিরে আমার যে আক্ষেপগুচ্ছ, শ্রদ্ধারাশি সেটাও যেন সম্পর্ক-সূত্র স্থাপনকারী!

শেষ জীবন
আজন্ম দেশপ্রেমিক প্রিয়ভাষিণী যেন এক আজন্ম যোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ নয় মাস হলেও তার যুদ্ধ ছিল যেন আমরণ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত অবধি তিনি সরব ছিলেন দেশবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালে দেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তিনি তখন ছিলেন সেই দাবিতে জ্বলে ওঠা শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের একনিষ্ঠ সৈনিক। এ কারণে তাকে বেশ বৈরী আবহাওয়াতেই জীবন কাটাতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো নিয়মিত পেছনে লেগে থেকেছে তার। কখন রটিয়েছে কুৎসা, আবার কখনও দিয়েছে প্রাণনাশের হুমকি। কিন্তু ভয়ভীতি দেখিয়ে কি আর দুই লাখ বীরাঙ্গনার প্রতিনিধিত্ব করা প্রিয়ভাষিণীকে দমিয়ে রাখা যায়? জীবনের এতো ক্লেদ, এতো নিষ্ঠুরতার পরও উঠে দাঁড়িয়েছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। মানুষের কাছ থেকে এতো পাশবিক আচরণ পেয়েও ফিরে গেছেন মানুষের কাছেই, জীবনের কাছেই। তার জীবনের শত নিষ্ঠুর নির্মমতাই পরবর্তীতে তার জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে। শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে। এছাড়াও তিনি হিরো বাই দ্যা রিডার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন (ডিসেম্বর ২০০৪); চাদেরনাথ পদক;
অনন্য শীর্ষ পদক; রৌপ্য জয়ন্তী পুরস্কার (ওয়াইডব্লিউসিএ);
মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়।
২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সুলতান স্বর্ণপদক পান ভাস্কর শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক জটিলতায় ভোগার ২০১৮ সালের ৬ মার্চ রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালের সিসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছিলেন, ‘সকল বীরাঙ্গনা নারীকে জাতির পক্ষ থেকে বলব- যারা সে দিন নীরবে যুদ্ধ করেছেন, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে, অসহায়ত্বের মধ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া উচিত।’
তার সেই দাবি, তার সেই লড়াই-ই পুনঃ পুনঃ উজ্জীবিত হয়ে উঠুক সকল জানা অজানা বীরাঙ্গনাদের কণ্ঠে।

 
Electronic Paper