টিকা নিয়ে শঙ্কাকে ‘না’ বলুন
গোপাল অধিকারী
🕐 ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ০৬, ২০২১
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ সনটি সকলের জীবনেই বিষাক্ত হয়েছে। একুশ সনের স্বস্তির বার্তা যে করোনার টিকা আবিষ্কার হয়েছে। দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। করোনার সংক্রমণ রোধে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এসময় টিকাদান ব্যবস্থাপনার ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মের মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা হয়। যারা টিকা নিতে চান তাদের সবাইকেই এই অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। ৪০ বছর বা তদূর্ধ্ব যে কেউ টিকা নিতে পারবে।
করোনাভাইরাস সনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের মাঝে টিকা নিয়ে শুরু হয় সংশয়। টিকা আদৌ আবিষ্কার হবে কিনা, কবে পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আবিষ্কারের পর টিকা নেওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছিল নতুন সংশয়। সংশয়টা চতুর্মুখী বলেই মনে হয় আমার কাছে। টিকা নিলে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে, টিকা সহজলভ্য হবে কিনা, টিকার সুষম বণ্টন হবে কিনা, হলে কীভাবে হবে ইত্যাদি। ইতোমধ্যে অনেকে টিকা নেবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে হয়ত। এমন সিদ্ধান্তকে না বলায় আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়।
বাঙালি কৌতূহলপ্রবণ জাতি। তাই কৌতূহল আছে, থাকবেই। সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য সকলে সচেতন হোক এটা সকলেরই কাম্য। সচেতনতা সকলেরই থাকা দরকার তবে, অতি সচেতনতা কিন্তু কাজে আসে না। তাই সচেতনতার মাঝে অচেতনতার প্রবণতা আমাদের দূর করতে হবে। অসচেতন মানুষকে সচেতন করা যায় কিন্তু সচেতন যারা অসচেতন থাকে তাদের বোঝানো যায় না। সচেতন বা অচেতন যাই হোন না কেন টিকা নিতে সংশয় কাটাতে হবে। সংশয় কাটাতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
যেভাবে সচেতনতার মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়েছে তেমনিভাবে সচেতনতার মাধ্যমে টিকার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একই অসুখে একই ওষুধ খেয়ে কিন্তু সকলের আরোগ্য হয় না। সকলের একই রকম সমস্যাও তৈরি হয় না। তাই টিকা দিয়ে যদি সকলের একই সমস্যা হত তাহলে সেটা নিয়ে শঙ্কার কারণ ছিল। তাছাড়া সরকার তার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে অরক্ষিত টিকা নেবেন না, এই বিষয়ে মনে হয় কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। টিকা শুধু বাংলাদেশে নয় অনেক দেশেই দেওয়া হচ্ছে। তাই টিকা দেওয়া নিয়ে কোন সংশয় থাকার যৌক্তিকতা আপাতত দেখছি না। আসি প্রাপ্যতায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে।
শুরুতে ২৫ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার কথা হলেও এখন ৫০ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর আট সপ্তাহ পর আসছে আরও ৫০ লাখ ডোজ, তাও পুরো দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভ্যাকসিন মৈত্রীর আওতায় ভারত সরকার বাংলাদেশসহ বন্ধুপ্রতিম ৬ দেশকে টিকা উপহার দিয়েছে। বাংলাদেশকেই দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ডোজ। এবার উপহার হলেও পরবর্তীকালে সব টিকা কিনে নিতে হবে। বাংলাদেশে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়বে ৫ ডলার (৪২৫ টাকা)।
করোনা টিকার ডোজ নিতে হবে দুটি। প্রথম ডোজ নেওয়ার আট সপ্তাহ পর নিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ। প্রথম ডোজ বা দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর কিছু স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরকম কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় প্রতিটি টিকার ক্ষেত্রেই হয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো হালকা মাথাব্যথা বা শরীর ব্যথা, টিকা নেওয়ার স্থানে হালকা ফুলে যাওয়া বা লাল হয়ে যাওয়া, হালকা জ্বর এবং বমি বমি ভাব, শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, সন্ধিস্থলে ব্যথা। কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তাছাড়া টিকা গ্রহণের পর ৩০ মিনিটি টিকাস্থলে থাকতে হবে বলে জানানো হয়েছে। হয়ত বার্তাটিতে অনেকে সংশয়ে পড়ছেন তবে টিকা গ্রহণের আগ পর্যন্ত আপনি ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাবেন সেটাও ভাবতে হবে। টিকা আপনাকে আপনার কাছের মানুষদের ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করবে। টিকা গ্রহণের ফলে আপনার শরীরের প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যাবে। ফলে আপনি তখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।
আগে যেখানে যক্ষ্মা হলে রক্ষা ছিল না এখন সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ক্যান্সারকেও জয় করা সম্ভব হচ্ছে। টিকা আমাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিমুক্ত, সুস্থ ও নিরাপদ করেছে। কমিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর হার। বিভিন্ন টিকা আবিষ্কারের কারণে এখন শিশুমৃত্যুর হার কম। এককথায় টিকা আবিষ্কার আমাদের মাথাপিছু গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার টিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই আসুন টিকা নিয়ে আর শঙ্কা না করি। টিকা নিয়ে সংশয় দূর করি।
দেশে এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ চললেও এতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রথম ডোজ দেওয়ার আট সপ্তাহ পর শুরু হবে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কার্যক্রম। তখন প্রথম ডোজ গ্রহীতাদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কাজ যেমন চলবে, তেমনি তখনো নতুন করে অনেককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের সাপ্লাই-চেইন ঠিক রাখাটা একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তাছাড়া প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসাটাও একটি চ্যালেঞ্জ।
করোনাকালে সরকারি অনুদান চুরি, ভুয়া টেস্ট নিয়ে তুলকালামও হয়ে গেছে। সেসব কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি সরকারকে নিতে হবে। টিকার শঙ্কা তৈরি করতে কোনো পক্ষ যেন সুযোগ না পায়। টিকা নিয়ে কোনো অব্যবস্থাপনা থাকলে তা কাটিয়ে উঠে দ্রুতই বাংলাদেশে করোনার টিকা সুষম বণ্টন করে শঙ্কা কাটাতে হবে।
করোনা যেহেতু জাতীয় দুর্যোগ তাই জনগণ বিনামূল্যে টিকা পাচ্ছে কিনা নজরদারি বাড়াতে হবে। সহজে যেন টিকা নিতে পারে সেই দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ সহজ ও সাবলীল ব্যবস্থা টিকা গ্রহণে আরও উদ্বুদ্ধ করতে পারে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও টিকা ব্যবস্থাপনায় সঠিক নিয়মই সকল শঙ্কা কাটাতে পারবে টিকাদান কার্যক্রমের। সকলে মিলে ফটোসেশন নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকা নিই। সুস্থ থাকি, শঙ্কাকে ‘না’ বলি।
গোপাল অধিকারী : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]