ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিক্ষোভে উত্তাল

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১

বিক্ষোভে উত্তাল

কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল শনিবারও উত্তাল ছিল রাজধানী ঢাকা। বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা, ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ প্রকাশ, মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও লেখক মুশতাকের দাফন সম্পন্নসহ নানা ঘটনায় দিনভর তুলকালাম ছিল। লেখক মুশতাকের মৃত্যু, পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ।

সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের মামলা
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের মশাল মিছিল পরবর্তী সময়ে পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনায় পুলিশ সদস্যকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল দুপুরে শাহবাগ থানার ওসি মামুনুর রশীদ দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, শুক্রবার রাতের ঘটনায় পুলিশ সদস্যকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার সাতজন ও অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলা করেন শাহবাগ থানার এসআই মিন্টু মিয়া। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে এসআই শহীদুল ইসলামকে।

প্রসঙ্গত, ছয় মাসের বেশি সময় আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি অবস্থায় গত বুধবার লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান। এর প্রতিবাদে শুক্রবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা সন্ধ্যায় টিএসসি থেকে মশাল মিছিল নিয়ে শাহবাগে এলে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় তাদের ৩০ জন আহত হন। এদিকে পুলিশ দাবি করে, আন্দোলনকারীরা মশালের লাঠি দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে। তখন পুলিশ আত্মরক্ষার্থে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আন্দোলনকারীদের একটি গ্রুপ পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে ১২-১৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন- তামজীদ হায়দার, নজিব আমিন চৌধুরী জয়, এএসএম তানজিমুর রহমান, আকিব আহম্মেদ, আরাফাত সাদ, নাজিফা জান্নাত ও জয়তী চক্রবর্তী।

প্রগতিশীল ছাত্রজোট মিছিল নিয়ে এসে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে আধা ঘণ্টার মতো শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। এ সময় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়। বেলা ১টা ৫ মিনিট দিকে সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টিএসসি অভিমুখে যাত্রা করেন তারা। আগামী ১ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেন প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক আল কাদেরী জয়। নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদও জানান তিনি। আল কাদরী জয় বলেন, হামলা করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।

এদিকে প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ব?লেন, যে লিখতে জানে, কথা বলতে জানে, সরকার তাকেই ভয় পায়। আমরা চুরির খবর জানি, বলতে পারি তাই সরকার আমাদেরও ভয় করে। তাই ভয় পেয়ে মুশতাক আহমেদকেও জেলে ঢুকিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, জেল কর্তৃপক্ষ বলার চেষ্টা করছে অসুস্থ মুশতাককে আমরা নিয়ে এসেছি। আর তাজউদ্দীন মেডিকেলের ডাক্তার বলছেন আমরা মৃত অবস্থায় তাকে পেয়েছি। তাহলে মুশতাক কোথায় মারা গেছে? আল-জাজিরা খবর ছাপায় সেটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না, তথ্যমন্ত্রী জানেন না। তাহলে মুশতাক যে কারাগারে মারা গেল সেটা কি তারা জানেন? যদি না জেনে থাকেন তাহলে কেন তাদের চাকরি এখনো আছে? বলা হয়েছে মুশতাক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। অথচ তার পরিবারের কেউই জানত না, আগে তার হার্টের সমস্যা ছিল।

অনুষ্ঠানে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, আমরা এখানে সমবেত হয়েছি লেখক মুশতাকের হত্যার বিচার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে কালো আইন বাতিলের দাবিতে। ২৫ ফেব্রুয়ারি যেদিন মুশতাক মারা গেছেন সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি জঘন্য তম দিন। এই ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন কর্মকর্তাকে বিডিআর বিদ্রোহের নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

সমাবেশ আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল আলম বেপারী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রমুখ।

মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর আগে তার চিকিৎসায় কারও কোনো অবহেলা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী ও উম্মে হাবিবা ফারজানা।

এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তদন্ত কমিটি করেছে। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদারকে প্রধান করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানা গেছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম, ময়মনসিংহের কারা উপমহাপরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির ও গাজীপুর জেলা কারাগারের সহকারী সার্জন ডা. কামরুন নাহার। কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব আরিফ আহমদকে। কমিটিকে চার কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ
আইনি হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৩টি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনার। গত শুক্রবার মুশতাকের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই বিবৃতিতে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতরা সই করেন।

বিবৃতিতে জানানো হয়, আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী ঢাকাস্থ মিশন প্রধানগণ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আইনি হেফাজতে জনাব মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছি। আহমেদ গত ৫ মে, ২০২০ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) ধারায় বিচারপূর্ব আটক অবস্থায় ছিলেন। আমরা জেনেছি যে বেশ কয়েকবার তাকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে এবং আটকাধীন অবস্থায় তার প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে জনাব মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর বিষয়ে একটি দ্রুত, স্বচ্ছ, স্বাধীন এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে আহ্বান জানাচ্ছি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাসমূহ এবং এর প্রয়োগে আমাদের সরকারগুলোর যে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানের প্রতি বাধ্যবাধকতার সঙ্গে এই আইনের সামঞ্জস্য সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অব্যাহতভাবে আলোচনা চালিয়ে যাব।

মুশতাকের দাফন সম্পন্ন
শুক্রবার রাত পৌনে ১০টার দিকে রাজধানীর আজিমপুর গোরস্থানে লেখক মুশতাক আহমেদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এ সময় তার পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধব উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মুশতাক আহমেদের মরদেহ তার বাসায় নিয়ে আসা হয়। দাফনের আগে রাতে লালমাটিয়া সি ব্লকের একটি মসজিদে মুশতাক আহমেদের জানাজা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খুলনায় গ্রেফতার ১
খুলনা শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার দিনগত রাতে ভাড়া বাসা থেকে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা (ডিবি পুলিশ) তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর রাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, তার থানায় ডিবি থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজনের নামে মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় একমাত্র আসামি গ্রেফতার আছে।

 
Electronic Paper