ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্বাধীনতা-পূর্ব থেকে চিকিৎসাকর্মে বাংলাচর্চা

হাফিজ উদ্দীন আহমদ
🕐 ১২:৫১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১

স্বাধীনতা-পূর্ব থেকে চিকিৎসাকর্মে বাংলাচর্চা

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে সরকারি ভাষা হিসেবে শুধু উর্দুর পরিবর্তে বাংলাও স্বীকৃতি পায়। উর্দুর পাশাপাশি ডাকটিকিট, মুদ্রা, পোস্টকার্ড ইত্যাদিতে বাংলায় শিরোনাম লেখা, সিনেমার উর্দু টাইটেলের পাশাপাশি বাংলায় টাইটেল লেখা বা দু’একটা বাংলা সংলাপ ঢুকিয়ে দেওয়া, ব্যাস এ পর্যন্তই তা ছিল। কিন্তু এটুকু পথ আসতেও বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন থেকে তা ছিল বহু দূরে। মাতৃভাষার সংগ্রামের এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম লগ্নের পর থেকেই। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকায় ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ লীগ স্থাপিত হয় এবং সেখানে প্রস্তাব নেওয়া হয় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের বিধিসঙ্গত ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করতে হবে। এটা পাঠ করেছিলেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। 

৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসায় মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলবল নিয়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবিও পেশ করেন তিনি। শেখ মুজিব তখন মুসলিম লীগ করতেন। এ সময় ভাষাসহ ২১ দফা দাবি নিয়ে যে পুস্তিকা বের হয় তাতে তার নাম ছিল। তমদ্দুন মজলিশের ভাষা সংগ্রামের সঙ্গেও তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৮ সালের প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের সময় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্সে সংবর্ধনায় জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে জানালে প্রথম এ দেশের সচেতন শিক্ষিত সমাজের টনক নড়ে। তিনি অবশ্য ঘোষণা দিলেন প্রদেশগুলোতে প্রাদেশিক ভাষা চলবে। ২৪ মার্চ ১৯৪৮ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি আবার এ কথা বলেন। জিন্নাহ নিজে বাংলা তো বটেই উর্দুও ভালো জানতেন না। ইংরেজি আর মাতৃভাষা গুজরাটিতে ভালো পারদর্শী ছিলেন। এমনকি সারা পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের কোথাও উর্দু নিজস্ব ভাষা ছিল না। তবে কেন তিনি উর্দুর সপক্ষে ছিলেন সেটা রহস্য। সম্ভবত মোঘল বাদশারা যেমনি সেনাবাহিনীতে উর্দুভাষার চর্চাকে প্রধান্য দিয়েছিল ভারতের নানা প্রদেশ থেকে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষি সৈনিকদের মাঝে সহজবোধ্য ভাব বিনিময়ের উপায় হিসেবে, সে ধারণা থেকে এটা করেছিলেন তবে তিনি বলেছিলেন ভাষাটি আরবি হরফে লেখা হয় ও ইসলামি সংস্কৃতি ধারণ করে যে জন্য ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য তা তার পছন্দ। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য উর্দুকে লস্করি ভাষা বলা হয়। আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দে সমৃদ্ধ এ ভাষা বারো শতকে দিল্লি ও তার আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সমাবর্তনে কিছু ছাত্র নানা প্রতিবাদ করায় হয়ত জিন্নাহ নতুন উপলব্ধি লাভ করেন। তিনি সভাতেই পাঁচ মিনিট চুপ হয়ে যান। এরপর যতদিন জীবিত ছিলেন কখনো এ ব্যাপারে কখনো কোন কথা বলেননি। এরপর এসে গেল ১৯৫২ সাল। ভাষা আন্দোলন পেল নতুন গতি।

ডিব্রুগড়ের বেরি হোয়াইট মেডিকেল স্কুল থেকে পাস করে সেকেন্ড ব্যাটালিয়ান আসাম রাইফেলসে রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পুরস্কার হিসাবে ডা. আইয়ুব মিয়াকে কনডেন্সড এমবিবিএস পড়ার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়েছেন। দেশভাগের জন্য এটা কার্যকর হতে ৫২ সাল এসে গেল। বাবা একদিন উত্তেজিতভাবে কলেজ ফিরে মাকে বললেন- গভর্নমেন্ট গুলি করেছে। বেশ কিছু লোক মারা গেছে। আমি তখন নেহাতই ছোট। স্কুলে যাওয়ার বয়স নয়। তারপরও আঁচ করতে পেরেছিলাম যে ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক কিছু। বাবা ছাত্রজীবনেই বিয়ে করেছিলেন। ১৪৭ নম্বর লালবাগ রোডে মাসিক ২০ টাকা ভাড়ায় ছোট একটা বাসার অর্ধেক ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। আসাম সরকারের চাকরি ছেড়ে পূর্ববঙ্গ সরকারের অধীনে চাকরি নেওয়ায় এখনো বেতন আটকে আছে। তখন পুরান ঢাকাই মূল ঢাকা। আমাদের বাসা মেইন রোডে। দরজা খুললেই দেখতে পাই গুলি বর্ষণের পর ঢাকা মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা হাতে প্ল্যাকার্ড ও বুকে কালো ব্যাজ এঁটে আকাশে দু’হাত ছুড়ে লাফিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে ফুঁসতে থাকে রোজ-
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
রাজবন্দিদের মুক্তি চাই
শহীদ স্মৃতি অমর হোক।
কখনোবা দল বেঁধে ওরা গায়- ভুলব না, ভুলব না, মোদের সে একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রায়ই পথচারীদের কাছে তারা দু’আনা দামে কালো ব্যাজ বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করে। দু’আনার তখন বেশ মূল্য। একটা ফুটো পয়সা দিয়ে সে সময় এক খিলি দোক্তা পান পাওয়া যায়। বাবা বেকার তবু তিনি ছুটে গিয়ে ব্যাজ কিনে আনতেন। নিজে সরকারি চাকুরে তাই পড়তে পারতেন না আমার জামায় তা সেঁটে দিতেন। বাংলাভাষার প্রতি আমার মমত্ববোধ তখন থেকেই গড়ে উঠেছিল মনের নিভৃতে। ধীরে ধীরে বড় হলাম। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃত হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই মিছিলে গর্জন শুনি- সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করো। দেয়ালের গায়েও এ লিখন দেখা যায়। কিন্তু কে এটা চালু করবে? কবে পাকিস্তান সরকার বাংলা লিখতে আদেশ দেবে সেদিকে হা করে চেয়ে বসে থাকলেই কি চলবে? ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে প্রথম বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছিল। বিলাতে ১৯২০ সনের আগে কোনো মেয়েকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে দেওয়া হত না। ১৮৯৬ সালের আগে জার্মানিতে কোনো মেয়েকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হত না। কিন্তু বাঙালি মেয়ে চন্দ্রমুখী বসু (১৮৬০-১৯৪৪) ও কাদম্বিনী বসু (১৮৬১-১৯২৩) সেই ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে জিবিএমসি (যা বর্তমানের এমবিবিএস সমতুল্য) লাভ করেন।

তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম মহিলা চিকিৎসক। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও দুঃখের বিষয় যে দেশের মেয়েরা আজ থেকে একশ’ বছর আগে স্নাতক হয়েছিল, সে দেশে এখনো সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু ও চিকিৎসা শিক্ষায় বাংলা ভাষা চালু হয়নি। বড় হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কেউ উদ্যোগী না হলেও নিজেকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। বাংলায় উচ্চশিক্ষা লাভের প্রথম কিছুটা সুযোগ পেলাম একাদশ শ্রেণিতে। অর্থাৎ ইচ্ছা করলে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারব। কিন্তু সেটা প্রহসন মনে হলো। একে তো তখনো বাংলায় একাদশ শ্রেণির (বিজ্ঞান) সব পাঠ্যবই নেই, নেই পরবর্তী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বাংলা মাধ্যমে পড়া যাবে কিনা তার নিশ্চয়তা, সর্বোপরি যতদিন বাংলায় ডাক্তারি ও কারিগরি শিক্ষা চালু না হয় ততদিন পর্যন্ত বাংলায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার অর্থ উচ্চশিক্ষার দ্বার রুদ্ধ। ইংরেজিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে মাতৃভাষার প্রতি মমতা থেকেই বাংলায় সম্মান নিয়ে ভর্তি হলাম। অনার্স পড়ি শুনলে অন্য বিভাগের ছাত্রছাত্রী বেশ সমীহ করত কিন্তু যখন শুনত বিষয়টা বাংলা তখন নাক সিটকাত। কেউ কেউ বলেই বসত- মেয়েরা বিশুদ্ধভাবে প্রেমপত্র লেখা শেখার জন্য বাংলা পড়ে, আপনি কেন পড়ছেন? বলাবাহুল্য, বাংলায় ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল বেশি। অথচ দেখতাম ভাষা দিবসে এরাই স্লোগান ধরেন, বড় বড় বক্তৃতা দেন। মেডিক্যালে আগেই নির্বাচিত হয়ে ছিলাম, গার্জেনদের চাপে ৩ মাস পর ফেরত আসতে বাধ্য হলাম চিকিৎসা অঙ্গনে। বাংলা প্রচলনের ইচ্ছাটা নিভৃতেই থেকে গেল। একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। পাস করে হাউস সার্জন বা শিক্ষানবিস শল্যবিদ থাকার সময় কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সনের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউরোলজির সর্ব প্রথম সিএ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আর কেউ না করুক এককভাবে হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমি বাংলা লিখব। এক শুভ দিনে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ থেকে শুরু হলো যাত্রা। ঢাকা মেডিকেলের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সেদিন ব্যবস্থাপত্রে প্রথম লিখলাম- লবণাক্ত ৫% ডেক্সট্রোজ ৫০০ সিসি ও পরে পানি মেশানো ৫% ডেক্সট্রোজ ৫০০ সিসি শিরায় মিনিটে শিরায় মিনিটে ৩০ ফোঁটা হিসেবে দিতে হবে। দেখি সিস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। বললাম- Infuse 5% Dextrose in saline and 5% Dextrose in aqua 500 c.c @ 30 drops per minute. এরপর চলল দেদার লেখা। ধীরে ধীরে সব বিভাগে ছড়িয়ে দিলাম আন্দোলন। আমার সহকর্মী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করে দলে টেনে আনলাম। সব বিভাগে গিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করে নিজেরা তাদের সবকিছু বাংলায় লিখে দিয়ে আসতে লাগলাম। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাংলায় অস্ত্রোপচার তালিকা রচিত হলো যার অনুলিপি পাঠানো হলো অসাড়তত্ত্বের অধ্যাপককে।

ইউরোলোজির নাম দিলাম মূত্রবিজ্ঞান। এদেশে ইউরোলোজির অগ্রদূত অধ্যাপক ইদ্রিস লস্কর ক্ষেপে গেলেন। কে যেন রসিকতা করে স্যারকে শুনিয়েছে যে বিজ্ঞান পড়তে পড়তে মানুষ মুইত্যা দেয় সেটা হলো মূত্রবিজ্ঞান। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলাম। আশ্বস্ত করলাম কেউ যদি বাংলা নির্দেশ না বোঝে তা বুঝিয়ে দেব, ওয়ার্ডের কাজে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। সেবিকাদের রাতের কাজের বিবরণী, রোগীদের ইতিহাস, অস্ত্রোপচারোত্তর টীকা (নোট) বাংলায় লেখা শুরু হলো। গোলাম রসূল, মোমিনুল হকের মতো জাঁদরেল অধ্যাপকদের ওয়ার্ডেও তাদের সিএকে পটিয়ে চালু করালাম বাংলা। স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ থেকে যেদিন অস্ত্রোপচার তালিকায় লিখে পাঠানো হলো যোনি পথে জরায়ু অপসারণ সেবিকারা মনে হলো শরমে মরে যাচ্ছে কিন্তু আদতে ব্যাপারটা তাই ঠধমরহধষ ঐুংঃবৎবপঃড়সু ও বিকারতত্ত্ব, রঞ্জনরশ্মি বিভাগেও নিজে বাংলায় তাদের প্রতিবেদনে কী লিখতে হবে তা মৌখিকভাবে বলে তাদের দিয়ে লেখাতে লাগলাম। অধ্যাপক আব্দুশ শাকুরের মতো রঞ্জনরশ্মি বিভাগের বিখ্যাত বিভাগীয় প্রধান আমার কথায় আইভিপি রিপোর্ট লিখলেন- পেটের সাধারণ ছবি : মূত্রাশয়ের বাম দিকে মাঝারি আকারের একটি পাথর আছে। শিরায় ২০ সিসি ওষুধ দেওয়ার পর : বৃক্কদ্বয়, উহাদের অভ্যন্তরীণ অংশ ও মূত্র নালিদ্বয়ে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায় নাই। উভয় বৃক্কই শিরায় দেওয়া ওষুধ স্বাভাবিকভাবে নিঃসৃত করছে। মূত্রাশয়ের নিচের দিকে ওষুধের অনুপস্থিতি প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধির আভাস দিচ্ছে। অধ্যাপক মতিউর রহমান (এফআরসিএস) স্যার একদিন আমার অজান্তে বাংলাচর্চার কিছু নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দিলেন। পরে স্যারের মাধ্যমে জানতে পারলাম পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাংলা চর্চা হচ্ছে দেখে তাদের মাঝে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কাজের প্রয়োজনে চিকিৎসা শাস্ত্রের দুরূহ শব্দগুলোর পরিভাষা সৃষ্টি করে চললাম। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ উদ্যোগের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দৈনিক ইত্তেফাকের শহীদ দিবস সংখ্যায় দুই পাতাজুড়ে বের হলো আমার সাড়াজাগানো প্রবন্ধ ‘বাংলা চর্চার এক বছর’। প্রথম যখন ইত্তেফাক অফিসে গিয়ে প্রবন্ধটি দাদাভাই রোকনুজ্জামান খানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম তিনি না পড়েই বললেন, ‘তুমি এমন কী হয়ে গেছ যে তোমার এ লেখা ছাপতে হবে?’ তারপর একটু চোখ বুলিয়েই দেখি তার মনোভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত।

এ লেখা পড়ে পাকিস্তানজুড়ে শিক্ষিত লোকদের মনে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল। কিছুদিন পরেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অফিস আদালত সব বন্ধ। মে মাসের দিকে গিয়ে ডাক যোগাযোগ শুরু হলো। ২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানের নানা প্রান্ত থেকে লেখা অসংখ্য অভিনন্দন জানানো চিঠি পেতে শুরু করলাম। অসহযোগের উদ্দীপনায় খামগুলোর বাইরে বড় বড় করে লেখাÑ জয় বাংলা। চিঠিতে আমার ভূয়সী প্রশংসা কিন্তু আমি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি চিঠিগুলো যে হানাদার বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ডাকঘর হয়ে এসেছে। কবে ধরে নিয়ে যায় কে জানে। আমার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ভাইকে এরই মাঝে হত্যা করেছে। অসহযোগের সময় শহীদ মিনারে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গের শপথ নেওয়া ঢাকা মেডিকেলের সামনের কাতারে ছিলাম আমি, সেখান থেকে মিছিল বের করে পাকিস্তানের শাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কালো পতাকা হাতে শহরে প্রদক্ষিণ করা হয়েছিল তার নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম আমি। সবার সামনে কালো পতাকা লাগানো বিশাল দণ্ডটি ছিল আমার হাতেই ধরা। পরদিন দেখি ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় বড় করে সে ছবিটি ছাপা হয়েছে। এক ছেলে হারানো আমার মা আতঙ্কে বারবার বললেন- তোর মোচটা কেটে ফেল, ওরা যাতে চিনতে না পারে। কিন্তু তা কাটিনি আমার কার্যক্রমও থামিয়ে দিইনি। শুভাকাক্সক্ষী ও শিক্ষকরা আমার জীবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমাকে থামাতে চাইলেন। আমার তরুণ রক্তে প্রতিবাদ করে উঠলাম- স্যার, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমি বাংলাচর্চা করছি। অন্যায় তো করছি না। কিন্তু জল্লাদ বাহিনী বলে কথা। কয়েকদিনের মাঝেই আমার সহকর্মী ও হাউস সার্জন ডা. হাসিময় হাজরাকে ধরে নিয়ে হত্যা করল। দু’দুবার রাস্তায় আমার বুকে বেয়োনেট ঠেকালেও আল্লাহর রহমতে গুলি থেকে বেঁচে গেছি। ১৯৭৫ সালে দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমার বাংলা প্রচলন অব্যাহত রেখেছিলাম। বিদেশে যাওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরাসরি এ কাজে নিয়োজিত থাকা সম্ভব হলো না।

বিকল্প পথ খুঁজে পেলাম। লক্ষ করলাম, আমাদের অফিসে আরবি ভাষায় সুন্দর ডায়রিয়ার বই আছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বের করেছে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালি ইত্যাদি পৃথিবীর সব প্রধান ভাষায় বইটি পাওয়া যায় অথচ বাংলায় বইটি নেই! আমি পৃথিবীর কত লোক বাংলায় কথা বলে তা জানিয়ে জেনেভাস্থ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের কাছে বইটি বাংলা করার অনুমতি চেয়ে নিলাম। এরপর তাদের দিল্লিস্থ দক্ষিণ পূর্ব অফিসের সহযোগিতায় বইটি কলকাতার একাডেমিক পাবলিশার্স থেকে বের হলো। এতে আমার উৎসাহ বেড়ে গেলো। এরপর বিদেশে বসেই দু’খ-ে মৌলিক শৈল্যবিদ্যার বই ‘অস্ত্রোপচারের কলাকৌশল’ রচনা করলাম। বইটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি ডাক্তারি নামগুলো আমার জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। বাংলায় ভালো দখল আছে। প্রয়োজনে পরিভাষা বানিয়ে নিয়েছি। আমার লেখা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব বইগুলোতে এ রকম সৃষ্ট পরিভাষা দেওয়া আছে শেষে। সুখের বিষয়, অনেকেই এখন সেই পরিভাষা ব্যবহার করছেন। দেশে এসে এরপর একে একে অনেক বই রচনা করেছি চিকিৎসাশাস্ত্রের। সেগুলো বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সম্ভাবনা শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এতে অন্যতম আলোচক ছিলাম আমি। অন্যদের মাঝে ছিলেন ড. আব্দুল্লাহ-আল মুতী, ডা. আহমদ রফিক, ডা. শরফ উদ্দিন আহমদ। সেমিনার শেষে সেখানে ভাষা জাদুঘর স্থাপিত করা হয় এবং পাকিস্তান আমলে আমার বাংলা প্রচলনের নমুনা সংরক্ষিত করা হয়। পরবর্তীকালে সে জাদুঘর উঠে যায় এবং জাতীয় জাদুঘরে আমার নমুনা স্থান পায়। ২০০৪ সালে বাংলায় রচনা করি মহামারী সার্স রোগের উপর পৃথিবীর প্রথম বই ‘মরণ ব্যাধি সার্স’। এবার আমার কাজের স্বীকৃতি পেলাম কিছুটা। বাংলা একাডেমি থেকে লাভ করলাম : শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক পুরস্কার। ২০১৬ সালে ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর গণবিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ভাষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক পাঁচদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ ছিল আমার ‘মেডিক্যাল এডুকেশন ইন বেঙ্গলি মিডিয়াম’ও তুমুল করতালির মাঝে আমি অভিনন্দিত হয়েছিলাম। ভাষা প্রচলনবিষয়ক একটি অধিবেশনেও সভাপতিত্ব করেছিলাম।

আমি পাকিস্তান আমলে প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাংলা প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলাম। চিকিৎসক হিসেবে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী উর্দুভাষী সুইপার পর্যন্ত তখন আমার বাংলায় লেখা ট্রিটমেন্ট কার্ড ছুঁড়ে ফেলে দিতÑ ইয়ে সব কেয়া লিখতা হ্যায় বলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, যিনি সূচনা থেকেই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ১৯৭২ সালে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে অফিসের কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের নির্দেশ জারি করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর নির্দেশে সারা পৃথিবীতে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মাতৃভাষা নিয়ে এত পথ হাঁটার পরেও সর্বস্তরে আমরা বাংলাভাষা প্রচলন করতে পারিনি। আমি উর্দু, ইংরেজি বা অন্য ভাষার বিরোধী নই। ভাষা দিবস এলে যারা পিটিয়ে দোকান বা অফিসের ইংরেজি সাইনবোর্ড ভাঙেন তাদের সমর্থন করি না। নামকরা প্রতিষ্ঠান, হোটেল, বিপণি কেন্দ্রে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি নাম রাখতে হবে। পর্যটনের সমৃদ্ধির জন্য এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিদেশিরা তাহলে সহজেই বেড়াতে এসে হোটেল, শপিং মল, গুরুত্বপূর্ণ অফিস বা স্থান ইত্যাদি কাউকে না জিজ্ঞাসা করেও খুঁজে নিতে পারবে। এটার দরকার আছে।

যারা বাংলাভাষায় বিজ্ঞান তথা চিকিৎসাবিদ্যাচর্চা সম্বন্ধে সন্দিহান তাদের জানাই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছেনÑ ‘যারা বলেন, বাংলাভাষায় বিজ্ঞান হয় না তারা হয় বাংলা জানেন না, নয়ত বিজ্ঞান বোঝেন না’। জাপান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, জার্মানি ইত্যাদি দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হয় তাই বলে তাদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় না। আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে সাত বছর পর্যন্ত ইংরেজি পড়ে তারপরও তারা ইংরেজি ভালো করে বলতে, পড়তে ও লিখতে পারে না। কেন না যে পদ্ধতিতে তা সেখানো হয় তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। অথচ এই ছেলেমেয়েরাই যখন রাশিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যায় তারা মাত্র ৬ মাস বা এক বছরে সেই সম্পূর্ণ অজানা ভাষাটি শুধু আয়ত্ত করে না, সেই বিদেশি ভাষায় সে পিএইচডি মানের অভিসন্দর্ভ লিখে আত্মপক্ষ সমর্থন করে। এটা যদি সম্ভব হয় তবে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করার পাশাপাশি ছয় মাসের বিজ্ঞানসম্মত দেখা-শোনা (অডিও ভিজুয়াল) পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখলে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাদের আরও উচ্চতর শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ হবে কেন? সুতরাং বাংলায় পড়লে উচ্চশিক্ষার দ্বার রুদ্ধ হবে এ ভীতি অমূলক। সেদিন দূরে নয়, যেদিন চিকিৎসাবিদ্যাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে এবং ভাষা আন্দোলনে দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সার্থক হবে। প্রবন্ধটিতে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ চলে আসায় ক্ষমা চাচ্ছি।

হাফিজ উদ্দীন আহমদ : অধ্যাপক ও একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ; স্টেথোস্কোপ মেডিকেল জার্নালের সম্পাদক
[email protected]

 
Electronic Paper