ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নৌকাভাসি মানতা সম্প্রদায়

সুনান বিন মাহাবুব, পটুয়াখালী
🕐 ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১

নৌকাভাসি মানতা সম্প্রদায়

আধুনিকতার লেশমাত্র স্পর্শ করেনি তাদের। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেকটাই দূরে তাদের বসবাস। মাটির সঙ্গে মিতালী নেই, জলেই ভেসে বেড়ান তারা। দলবদ্ধভাবে নোঙ্গর করে স্থানে স্থানে। ফের ছুটে যায় অন্য কোথাও থাকার সন্ধানে। নৌকায় ভেসে জীবনের চাকা ঘুরতে থাকে জাল, বড়শিতে। এদের কারও কারও জাতীয় পরিচয়পত্র মিললেও অধিকাংশের জোটেনি সেটাও। মানতা সম্প্রদায়ের দুঃখ এখনও দুঃখই থেকে গেছে বলে জানায় তারা।

পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন চর-মোন্তাজ। দ্বীপ ইউনিয়ন চর মোন্তাজকে চারদিক থেকে জড়িয়ে আছে তেঁতুলিয়া নদী। এ নদীর কোনো এক নৌকায় আজ থেকে বিশ কি বাইশ বছর আগে আক্কেল সরদারের কন্যা কোহিনূরের জন্ম। শৈশব, কৈশোর পার করে কোহিনূর বাপের নৌকা ছেড়ে এখন সংসার পেতেছে স্বামী বসারের নৌকাতে। সেখানেই বেড়ে উঠেছে তার সংসার এবং সন্তানরা.

বাপ-দাদার নৌকাভাসি ঐতিহ্য লালন করেই তিনি পার করে এসেছেন জীবনের ২২টি বসন্ত বেলা। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মের কারোরই এই পানিতে ভাসমান জীবন ভালো লাগে না। ভালো লাগে না এই যাযাবর জীবন। তারা ফিরতে উদগ্রীব ডাঙার জীবনে। যেখানে সবাই সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ও মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা গৃহে বাস করে। মাথার উপরে ডেকে ডেকে হয়রান হয় দোয়েল, কোকিল। শুকিয়ে কাঠ হওয়া মাটির বুক চিরে কৃষক বের করে আনে শস্যদানা, পড়াশোনা করে কেতাদুরস্ত পরিপাটি চলাফেরা করে মানুষজন। মানতাদের তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে এরকম জীবন। তারা চায় ক্ষুদ্র ক’ফুট ছাউনির তলা থেকে বেরিয়ে এসে বিশাল আকাশের নিচে মাটির পৃথিবীর আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে।

চর-মোন্তাজ ছাড়াও ভোলা, পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে ওরা ভেসে চলে পানপট্টি, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, বদনাতলী, উলানিয়া, পটুয়াখালী সদরসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী, চর ও মোহনাগুলোতে। জানা গেছে, এই সম্প্রদায়ের কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক পরিবার রয়েছে পটুয়াখালীতে। যার অধিকাংশেরই রয়েছে নাগরিকত্ব পরিচয় সংকট। এ সম্প্রদায়ের শিশুদের বয়স ছয়-সাত-আটে পা দিলেই জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নিতে হয় নৌকার বৈঠা। জাল ফেলতে হয় নদীতে। ফলে এরা বঞ্চিত হয় সাক্ষরজ্ঞান থেকে। শিক্ষা না থাকায় জীবনের পদে পদে হতে হয় বঞ্চিত-লাঞ্ছিত। ভোলা সদরের ইলিশা ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজন মানতা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের সঙ্গে। তারা জানান, একই স্থানে ২-৩ মাসের বেশি সময় থাকেন না। যেখানে বেশি পরিমাণে মাছ ধরা পড়ে উপকূলের সেই স্থানেই তাদের বেশি সময় অবস্থান করা হয়। মাছ ধরা না পড়লে কখনও কখনও পরিবার-পরিজন নিয়ে উপোষ থাকতে হয়। এ ছাড়া নৌকার জীবন কাটাতে গিয়ে নদীতে পড়ে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট শিশুর প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

এ সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা বেড়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে। নৌকাতে জীবন কাটানোর ফলে এরা স্বাভাবিক পরিবেশ পায়না। ছোট ছোট শিশুরা ভোগে নানা অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে। বয়স্কদের রোগ বালাই নেই বললেই চলে। নৌকাতেই গর্ভবতী নারীরা সন্তান প্রসব করেন। অনেক প্রসূতি নারীই আবার হাসপাতালে যেতে চান না। ফলে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। মানতা সম্প্রদায়ের অনেকেই জানেন না তাদের পৈতৃক ভিটে কোথায় ছিল, আদৌ ছিল কিনা। আধুনিক সভ্যতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ যুগ যুগ ধরে বাস করছেন নৌকাতে।

মানতারা জানান, দেশের নাগরিক হয়েও কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। সরকার যদি তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিত তাহলে তারা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত। পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান মোহন জানিয়েছেন, মানতা সম্প্রদায় চাইলে তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে সব নাগরিক সুবিধা দেওয়া হবে।

 
Electronic Paper