ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঐতিহ্যের তীর্থভূমি কুমিল্লা

রূপসী বাংলা ডেস্ক
🕐 ১২:৩৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১

ঐতিহ্যের তীর্থভূমি কুমিল্লা

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি কুমিল্লা। খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত কুমিল্লা-চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এই জেলা প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় ভ্রমণ স্থানসমূহ হলো, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি, ধর্মসাগর দীঘি, রূপবান মুড়া, চন্ডীমুড়া মন্দির, ম্যাজিক পার্ক পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ জেলা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন-

লালমাই পাহাড়

লালমাই পাহাড় বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লালমাই উপজেলায় অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন পর্বত শ্রেণি। প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে এই পাহাড় গঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সে হিসেবে এটি বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি এবং মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের সমকালীন। লালমাই পাহাড় এর দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার এবং এর সবচেয়ে চওড়া অংশ ৪.৮ কিলোমিটার। এটির সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। পাহাড়টির উত্তর অংশ ময়নামতি পাহাড় এবং দক্ষিণ অংশ লালমাই পাহাড় নামে পরিচিত। লালমাই পাহাড়ের মাটি লাল রঙয়ের। যার কারণে একে লালমাই পাহাড় বলা হয়। লালমাই পাহাড় নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে, রাম ও রাবণ এর মধ্যে যখন যুদ্ধ সংগঠিত হয় সে সময় রামের ছোট ভাই লক্ষণ গুরুতর আহত হলে, বৈদ্যের নির্দেশ অনুযায়ী বৈশল্যকরণী গাছের পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগানোর নির্দেশ দেয়। বৈদ্যের মতে, বৈশল্যকরণী পাতার রস লাগালে লক্ষণ ভালো হয়ে যাবে। আর তাই হনুমান বৈশল্যকরণী গাছ নিয়ে আসার জন্য হিমালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করে। তবে হনুমান বৈশল্যকরণী গাছ না চিনতে পারায় গাছসহ পুরো হিমালয় পর্বতকেই তুলে নিয়ে আসে। চিকিৎসা শেষ হলে পর্বতটা যথাস্থানে রাখার জন্য হনুমান রওয়ানা দেয়। কিন্তু যাত্রাপথে পর্বত এর কিছু অংশ কুমিল্লার লমলম সাগরে পরে যায়। তখন থেকেই এ স্থানের নাম লালমাই নামেই পরিচিত।
এছাড়া আরও কথিত আছে এক রাজার নাকি দুই কন্যা ছিল। এক কন্যার নাম লালমতি আরেক কন্যার নাম ময়নামতি। তাদের নামানুসারে এই লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।


নওয়াব ফয়জুন্নেসা জমিদারবাড়ি

নওয়াব ফয়জুন্নেসা জমিদারবাড়িটি (Foyjunnesa Zamindar Bari) কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁওয়ে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে অবস্থিত। তৎকালীন ভারতবর্ষের একমাত্র মহিলা নবাব ‘ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী’ ১৮৭১ সালে এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটখাটো কিন্তু বেশ চমৎকার সুন্দর বাড়িটি যার মূল বাড়িটি দক্ষিণমুখী। তার পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে বৈঠকখানা। বাড়ির পশ্চিমপাশে রয়েছে মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ। অনেকটা সময় সবুজের সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য অনেক ভালো একটা জায়গা। দশ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি ১৯০৩ সালে স্থাপিত, যেটা আসলেই চক্ষু শীতল করার মতো। ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী ছিলেন সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ে করেন আরেক জমিদার গাজী চৌধুরীকে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। আর ঐ বিবাহ বিচ্ছেদের সময় পাওয়া দেনমোহরের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে তিনি নিজে একটি বাড়ি তৈরি করেন। ঐ সময় তিনি জমিদারির প্রশিক্ষণ নেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। তার জমিদারির আওতায় প্রায় হোমনাবাদ পরগণার বর্তমান সময়ের কুমিল্লা জেলার মোট ১৪টি মৌজা ছিল। ১৪টি মৌজাতে রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৪টি কাছারি ঘর ছিল। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী জমিদার। বিশেষ করে নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে। তার জমিদারির অধিকাংশ আয় এই নারী শিক্ষার পেছনে ব্যয় করতেন। তার এই সাহসী উদ্যোগ ও সাফল্যের কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়া তাকে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যা পুরো ভারত উপমহাদেশে একমাত্র মহিলা হিসেবে তিনি এই উপাধি পান। তিনি ছিলেন একাধারে জমিদার, সমাজকর্মী, লেখিকা।

ময়নামতি জাদুঘর

শালবন বিহারের পাশেই ময়নামতি জাদুঘর। শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার, রানীর বাংলা ও ভোজ রাজার বাড়ি বিহার খননকালে অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ীর শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। জাদুঘরের প্রবেশপথের বাঁ পাশেই রয়েছে বুদ্ধের বিশাল ব্রোঞ্জের মূর্তি। তারপর রয়েছে বেলে পাথরে দন্ডায়মান বৌদ্ধের মূর্তি। এটি আনুমানিক ৭ম শতকে তৈরি। ১২-১৩ শতকের দুটো তাম্র শাসন রয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দ্রব্যের মধ্যে ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, (ওজন ৩৭০ কেজি) কালো পাথরের শিবের বাহন, তালপাতার বর্মী পাণ্ডুলিপি অন্যতম। জাদুঘরের মূলভবনে গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তু প্রদর্শনের জন্য স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯৭০-৭১ সালে এর দক্ষিণ পাশ বর্ধিত করায় ভবনটি ইংরেজি ‘টি’র আকার ধারণ করে। পুরো জাদুঘর ভবনে মোট ৪২টি আধার রয়েছে। যাতে পুরাবস্তুসমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরের প্রবেশপথের বাম দিকে থেকে ১ নং প্রদর্শনী আধার দিয়ে প্রদর্শনী আরম্ভ করে ক্রমানুসারে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রবেশদ্বারের ডান দিকে ৪২ নং আধারে প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। প্রদর্শনী আধারগুলোতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খননের উন্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, ধাতুলিপি ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, মৃন্ময় মুদ্রক-মুদিকা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলংকারের অংশ এবং ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি-পাতিল প্রদর্শিত হচ্ছে।
এছাড়া আধারের ফাঁকে ফাঁকে মেঝের ওপর জাদুঘর ভবনের বিভিন্ন স্থানে কিছু পাথর এবং ব্রোঞ্জ মূর্তিও প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এসব মূর্তির কয়েকটি প্রাচীন সমতটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত।
জাদুঘরে প্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের পাথরের দন্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধমূর্তি, ত্রি-বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গণেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসস্ত¡ মূর্তি।


ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক
ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক (hy) ঢাকার কাছেই কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থিত একটি বিনোদন কেন্দ্র। কুমিল্লা ইউনিভার্সিটির পাশে দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার সামনে গেলেই কোটবাড়ী বনের মধ্যে দেখা মিলবে এক নতুন সাম্রাজ্যের। ডিজনিল্যান্ডের আদলে তৈরি করা হয়েছে ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক এর বিশাল ফটক। ওয়াটার পার্ক, ২০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের রাইড, ডাইনোসর পার্ক, পিকনিক স্পটসহ ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি এমিউজমেন্ট পার্ক। সবুজ প্রকৃতি আর কৃত্রিমের ছোঁয়া মিলেমিশে একাকার পার্কটি। ভিতরে ঢুকতেই বিশাল এক নাগরদোলা। চূড়ায় বসে পুরো পার্কের দৃশ্য দেখার মতো। এছাড়া পার্কে রয়েছে রেল, রোলার কোস্টারসহ শিশু-কিশোরদের নানা রাইড। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম ওয়েভ পুলের দাবিদার এই পার্কটি। উচ্চ শব্দের গানে, ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না। বাচ্চাদের জন্যও ওয়াটার পুলে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ছোট পাহাড়ের ওপর তিনটি ওয়াটার রাইড আছে যা আপনার পছন্দ হবে। তবে যারা ফ্যান্টাসি/নন্দনের ওয়াটার কিংডমে গিয়েছেন তাদের কাছে রাইড তুলনামূলক কম মনে হবে। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই ডেকে উঠবে ডায়নোসর। ডায়নোসর গুলোকে সেন্সরের মাধ্যমে মুভ করার সঙ্গে সাউন্ড ইফেক্টেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।


ধর্মসাগর দীঘি
কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল আকারের দীঘিটিই হলো ধর্মসাগর দীঘি। রাজা ধর্মপালের নামানুসারে এই দীঘির নাম হয়েছে ধর্মসাগর দীঘি। প্রায় ২০০-২৫০ বছর আগে আনুমানিক ১৭৫০ অথবা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাহিতৈষী রাজা ছিলেন ধর্মপাল। তিনি ছিলেন পাল বংশের রাজা। বাংলায় তখন ছিল দুর্ভিক্ষ। রাজা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য এই দীঘিটি খনন করেন। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। সাগর নাম দিয়ে দেশে যে কয়টি দীঘি রয়েছে ধর্মসাগর তার মধ্যে অন্যতম। বিকেলের পরন্ত সূর্যের আলো যখন তেজহীন হয়ে আসতে থাকে শত শত দর্শনার্থীর পদভারে ধীরে ধীরে মুখরিত হতে থাকে ধর্মসাগর পাড়। যেন প্রতিদিনই বসে মিলনমেলা। ধর্মসাগরের উত্তর কোণে রয়েছে কুমিল্লার শিশুপার্ক। এই শিশুপার্কে বসে সাগরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়, সবুজ শ্যামল ও বিশাল বড় গাছ নিয়ে এই শিশুপার্ক। এই শিশুপার্কে বসলে মন ভরে যায় ভালো লাগার পরশে। দীঘিপাড়ের সবুজ বনানী ধর্মসাগরকে (Dharmasagar Digh) দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। থরে থরে সাজানো বড় বড় গাছের সারি। তার মাঝে সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চি।


শালবন বৌদ্ধবিহার
শালবন বৌদ্ধবিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ীতে বার্ডের কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এ বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এ বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো হলেও আকারে ছোট। ১৮৭৫ সালের শেষদিকে বর্তমান কোটবাড়ী এলাকায় একটি সড়ক তৈরির সময় একটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। সে সময় আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষকে একটি দুর্গ বলে অনুমান করা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টাশালী সে এলাকায় যান এবং উক্ত এলাকায় অনুসন্ধান পরিচালনাকালে ধ্বংসাবশেষটিকে রণবংকমল্ল হরিকেল দেবের তাম্রশাসনের (খ্রিস্টীয় তের শতক) দুর্গ ও বিহার পরিবেষ্টিত পট্টিকেরা নগর বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যদিও অপর প্রত্নতাত্ত্বিকদের মত অনুযায়ী এটি ছিল জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। আকারে চৌকো শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনি দেয়াল পিঠ করে নির্মিত।


রানী ময়নামতির প্রাসাদ
কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পূর্বপাশে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে সৌন্দর্যমন্ডিত রানী ময়নামতির প্রাসাদ (Palace of Queen Mainamati) অবস্থিত। দশম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজা মানিক চন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, ময়নামতি ইউনিয়নের প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটি ৮ম থেকে ১২শ শতকের এক প্রাচীন কীর্তি। প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সমতল থেকে ১৫.২৪ মিটার উচ্চতায় একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ার ওপর রানী ময়নামতির প্রাসাদের অবস্থান। স্থানীয়দের মতে, এই স্থানটিতে একটি ক্রুসাকৃতির মন্দির ছিল, যা পরবর্তীতে সংস্কার করে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ যুগে ক্রমান্বয়ে ছোট আকারের একটি পূর্বমুখী মন্দির বানানো হয়। ১৯৮৮ সালে ভূমি সমতল থেকে ৩ মিটার গভীরে প্রাপ্ত একটি সুড়ঙ্গ পথের সামনে খননের মাধ্যমে এই প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাথমিকভাবে এখান থেকে নির্মাণ যুগের ৪টি স্থাপত্য, ৫১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০০ ফুট আয়তনের বেষ্টনি প্রাচীর, পোড়ামাটির ফলক, মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ববস্তু ও অলঙ্কৃত ইট আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিবছর ৭ বৈশাখ এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাসব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োাজন করা হয়।


ওয়ার সিমেট্রি
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি (Moynamoti War Simetri), যার আরেক নাম কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয় লোকদের কাছে এটা ইংরেজদের কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৩৭ সৈন্য। এর মধ্যে ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি এবং ১ জন বেসামরিক ব্যক্তি। স্থানীয়দের ভাষায় একে ইংরেজ কবরস্থান বলা হলেও আসলে এখানে সারিবদ্ধভাবে শায়িত রয়েছেন মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু এবং বৌদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এবং যুদ্ধে আহত হয়ে পরে মারা যাওয়া সাধারণ সৈনিক থেকে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার এখানে সমাহিত করা হয়েছে। কুমিল্লা (Comilla) শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজার। টিপরা বাজার ও ময়নামতি সাহেবের বাজারের মাঝামাঝি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাঁয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাড়ে চার একর পাহাড়ি ভূমিজুড়ে বাংলাদেশে অবস্থিত দ্বিতীয় এ কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র।


ডাইনো পার্ক
কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ীর জামমূড়ায় লালমাই পাহাড়ের ১২ একর জায়গা নিয়ে ডাইনোসর পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। সমতল ভূমি থেকে ৪৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত পাখির কলকাকলিতে মুখরিত মনোমুগ্ধকর এই থিম পার্কে হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসররা চলাফেরা করে। ডাইনোসর পার্ক নাম হলেও ডাইনো পার্ক (Dino Park) নামটি ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। ডাইনো পার্কের প্রধান আকর্ষণ ডাইনো জোনে যেতে চাইলে রঙধনু সিঁড়ির ৪০ ধাপ বেয়ে টিলায় চড়তে হবে। ডাইনোসরগুলোর মটরাইড নড়াচড়া ও গর্জন দর্শনার্থীদের অনেক আনন্দিত করে। প্রতিটি ডাইনোসরের নিচে তাদের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া আছে। ডাইনো জোনের পাশেই একটি কৃত্রিম ঝরনা রয়েছে।


আনন্দ বিহার
কুমিল্লা জেলা সদরের কোটবাড়ীর ময়নামতিতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য আনন্দ বিহার (Ananda Bihara)। ময়নামতির অন্যান্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে বৃহত্তম এই মন্দির উপমহাদেশের শেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। নকশা করা বর্গাকৃতির বিশাল বিহার কাঠামোর কেন্দ্রে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির ও সুন্দর এক দীঘি। মন্দিরকে ঘিরে কাঠামোর প্রতিটি বাহুতে রয়েছে সন্ন্যাসীদের কক্ষ। বিস্তৃত আঙিনার মাঝে অবস্থিত মন্দিরের উত্তর দিকের মধ্য ভাগে রয়েছে বিহারে প্রবেশ করার একমাত্র প্রবেশদ্বার। আর বিহার হতে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে ৬৩টি রৌপ্য মুদ্রা, তাম্রশাসন, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পোড়ামাটির ভাস্কর্য ফলক ও মৃৎপাত্র পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত ভাঁটি উল্লেখযোগ্য। সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব আনন্দ বিহার নির্মাণ করেন।

এক নজরে

আয়তন: ৩০৮৭.৩৩ বর্গ কিলোমিটার।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত দৈর্ঘ্য: ১০৬ কিলোমিটার
উপজেলা: ১৭টি (আদর্শ সদর, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, বরুড়া, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, চান্দিনা, তিতাস, দাউদকান্দি, হোমনা, মেঘনা, মুরাদনগর, দেবিদ্বার, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া ও লালমাই )
সংসদীয় আসন সংখ্যা: ১১টি
সিটি করপোরেশন: ০১টি (কুমিল্লা সিটি করপোরেশন)
হোল্ডিং সংখ্যা: সরকারি- ১৭৪টি, বেসরকারি- ৩৩,৭১২টি
পৌরসভা: ০৮ টি (‘ক’ শ্রেণিভুক্ত- ০৩টি; লাকসাম পৌরসভা, নাঙ্গলকোট পৌরসভা, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভা) (‘খ’ শ্রেণিভুক্ত- ০৫টি; দাউদকান্দি, দেবিদ্বার, চান্দিনা, হোমনা ও বরুড়া পৌরসভা)
ইউনিয়ন: ১৯৩টি
মোট জনসংখ্যা: ৫৩,৮৭,২৮৮ জন; (পুরুষ: ২৫,৭৫,০১৮ জন, মহিলা: ২৮,১২,২৭০ জন)
জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কি.মি): ১৭১২ জন (প্রতি বর্গ কি.মি)
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার: ১.৫৮% (প্রায়)

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper