বগুড়া ভূমি অফিসে দালাল দৌরাত্ম্য
টিএম মামুন, বগুড়া
🕐 ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৬, ২০২১
টিপটপ পোশাকেই বগুড়ার ভূমি অফিসে তার অবস্থান। তাকে বাদ দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে সরাসরি যাওয়ার কথা যেন কল্পনাই করা যায় না। প্রথম দেখাতে যে কেউ তাকে ভূমি অফিসের কর্মচারী ভেবে নেবেন। সুবিধা দিয়ে সুবিধা আদায়ের সুযোগ পাওয়া যায় বলে ভূমি মালিকরাও তার কাছেই ভেড়েন। পরিচয় দেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে। কখনো তিনি সরকার পাড়ার আব্দুল হাই, কখনও ধুনট উপজেলার জিঞ্জিরতলার আব্দুস সাত্তার। নাম যাই হোক, খোলা কাগজের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে বলেন, ‘জনস্বার্থে কাজ’ করেন তিনি। অনুসন্ধানে জনস্বার্থের ছিটেফোঁটা না মিললেও নামজারি, খারিজ, খাজনা- সব কাজে সেবাপ্রত্যাশীদের দেখা যায়, বাধ্য হয়েই তারা শরণাপন্ন হচ্ছেন আব্দুস সাত্তার বা আব্দুল হাই নামের এ দালালের সঙ্গে। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক খোলা কাগজের চোখে বগুড়া ভূমি অফিস নিয়ে থাকছে এবারের প্রতিবেদন।
খারিজ করা ও খাজনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভূমি মালিক সেজে বগুড়ার ধুনট সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খোলা কাগজের প্রতিবেদক। ভূমি অফিসে গিয়ে প্রথমেই দালালের বেপরোয়া ধাক্কা সহ্য করতে হয়। একটু এগিয়ে দেখা যায়, ভূমি কর্মকর্তাদের মতো চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করছেন আব্দুস সাত্তার ওরফে আব্দুল হাই। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথি, কাগজ ও আসবাবপত্র সবই তার হাতে। নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি দালাল বা দালালচক্রের কেউ। মনে হচ্ছে, তিনিই যেন অফিসের প্রধান অফিস সহকারী।
পাশেই বেশ খানিকটা বিশ্রাম ভঙ্গিতে বসে আছেন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) সানাউল হক ও অফিস সহায়ক মিজানুর রহমান। কাজের কথা শুনে বুঝিয়ে দেন কী করতে হবে। প্রতিবেদকও বুঝে যান সব। ভূমি অফিসের কর্মচারী সেজে দীর্ঘদিন ধরে বসে থাকা দালাল আব্দুল হাই দাবি করেন অতিরিক্ত টাকা। খাজনা খারিজ সংশ্লিষ্ট কাজে আসা আরও অনেক মানুষ তার আশপাশ ঘিরে। তাদের চালচলন দেখে নির্ধারণ করা হচ্ছে টাকার পরিমাণ। ইচ্ছেমতো চলছে অবৈধ লেনদেন।
পরিচয় জানতে চাইলে ১৯ জানুয়ারি নিজেকে ধুনট উপজেলার জিঞ্জিরতলার আব্দুস ছাত্তার এবং ২৫ জানুয়ারি সরকার পাড়ার আব্দুল হাই হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানান, প্রায় ৫ বছর ধরে এভাবেই কাজ করছেন তিনি। অফিস থেকে কোনো পারিশ্রমিক না নিয়ে জনস্বার্থেই করছেন সব। প্রতিদিন অফিসে আগত জমি মালিকদের কাজ করে দিয়ে কিছু আয় হয়। তবে ‘সরকারি আমানত অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি’র প্রসঙ্গ আনতেই রেগে যান তিনি। পরে খোলা কাগজের পরিচয় পেয়ে অবশ্য কৌশলে বোল পাল্টিয়ে নেন। বলেন, ‘আমি স্থানীয় মানুষ। জনগণের সেবার জন্যই কাজ করি। এজন্য কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’
জমির খারিজ করতে আসা একজন দাবি করেন, নাম খারিজের জন্য ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হলেও খরচ কত হয় সেটা তারা জানতে পারেন না। পুরো কাজের জন্য দালালের হাতেই টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া এই অফিসে কোনো কাজ হয় না। ধুনট পৌর এলাকার পাকুরিহাটার আব্দুস সবুরের ছেলে ইয়াছিন আলী বলেন, ‘খাজনা ও খারিজ করার জন্য অফিসে এসেছি। কাজটি আব্দুল হাই করে দেবেন।’
প্রথম পর্যায়ে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্তকে জানালে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরবর্তী তথ্যানুসন্ধান নিয়ে ২৫ জানুয়ারি গেলে তিনি ভূমি অফিসে দালালের উপস্থিতি ও সক্রিয় কার্যক্রম অস্বীকার করে বলেন, ‘তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পর দুপুর সোয়া একটার দিকে ভূমি অফিসে গিয়ে আব্দুস সাত্তার ও আব্দুল হাই নামের দুই দালালে উপস্থিতি দেখা যায়।
ধুনট সদর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা সানাউল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘দালালরা বেশ প্রভাবশালী। হঠাৎ করেই ভূমি অফিস দালালমুক্ত করা কঠিন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমন উদ্যোগ নিলে আমার জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে? নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে যায়নি। তবে অফিসে আগতরা যেন ভোগান্তিতে না পড়ে, সে বিষয়টি দেখা হয় এবং সরকারি নিয়মেই সব কাজ হয়’।
বগুড়া জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, ‘দ্রুত এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’