ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কারাগারে ভয়ঙ্কর অনিয়ম-দুর্নীতি

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৫, ২০২১

কারাগারে ভয়ঙ্কর অনিয়ম-দুর্নীতি

দেশের কারাগারগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ই। তবে সম্প্রতি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দির নারীসঙ্গের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিষয়টি। কারাগারে দেখা-সাক্ষাৎ ও অফিস কলের নামে বিশেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বন্দী ও তার স্বজনদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে শতাধিক কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীকে শাস্তির আওতায় আনা হলেও এর প্রতিকার হচ্ছে না। সবশেষ কাশিমপুর কারাগার-১-এ বাইরে থেকে নারী নিয়ে ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদের একান্ত সময় কাটানোর ঘটনায় জেল সুপার রত্না রায় ও জেলার নুর মোহাম্মদ মৃধাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ নিয়ে ওই ঘটনায় পাঁচজনকে প্রত্যাহার করে কারা অধিদফতরে সংযুক্ত করা হলো। গতকাল রোববার সকালে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধার জায়গায় মাগুরা জেলা কারাগারের জেলার রীতেশ চাকমাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর নতুন জেলার হিসেবে বদলি করা হয়।

এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দায়িত্বরতরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন : এদিকে জেল সুপার রত্না রায় ওই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কারা মহাপরিদর্শকের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছেন। এতে তিনি সব কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন বলে কারা সূত্রে জানা গেছে।

রত্না দাবি করেন, জেলার নুর মোহাম্মদ, ডেপুটি জেলার মো. গোলাম সাকলাইন, ডেপুটি জেলার তানিয়া ফারজানাসহ কয়েকজন কারারক্ষীকে বন্দি তুষার ওই নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বাবদ টাকা দিয়েছেন। যদিও জেলার নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, রত্না রায়ের নির্দেশেই তিনি তুষার আহমেদকে ওই নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর অনুমতি দেন। ঘটনার জন্য জেলারের ওপর দায় চাপিয়েছেন ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইনও। তবে রত্না রায় তার দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সরকারিভাবে সব শ্রেণির বন্দিদের জন্য পারিবারিক সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা জেলারের অনুমতি সাপেক্ষে কারাগারের অফিসে প্রবেশ করে থাকেন। কাজেই জেলারের অথবা কর্তব্যরত ডেপুটি জেলার অথবা গেট কারারক্ষীর অবহিতকরণ ছাড়া কেউ অফিসে প্রবেশ করছেন- তা কোনো সুপারের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। করোনাকালীন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরের গেট (আরপি গেট) দিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। সামগ্রিক বিষয়টি ওয়াকিটকির মাধ্যমে না বলে গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হওয়ায় জেল সুপার রতœা তা জানতে পারেননি বলেও দাবি করেন প্রতিবেদনে।

তবে ঊর্ধ্বতন এক কারা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, জেল সুপার যতই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করুন, তিনি এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ একটি কারাগারের প্রধান নিয়ন্ত্রক জেলসুপার। তাই প্রকৃত ঘটনা বের করার জন্যই সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রত্যাহার করা জরুরি।

অনিয়মের আখড়া দেশের কারাগার : দেশের কারাগারগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ই। গত বছর সরকারের এক তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়ই কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কারা অধিদফতরের উপমহাপরিদর্শকরা (ডিআইজি) গতানুগতিকভাবে কারাগার পরিদর্শন করেন। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো তারা কখনোই খতিয়ে দেখেন না। উল্টো তারা অন্যায় সুবিধা নিয়ে থাকেন। অনিয়ম খতিয়ে না দেখার পেছনে কী রহস্য, তা সহজেই অনুমেয়।

দেশের কারাগারগুলোতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি তদন্ত শেষে ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রতিবেদন জমা দেয়।

এক হিসাবে দেখা গেছে, গত তিন বছরে শতাধিক কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এরপরও কমছে না অপরাধ। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারা ক্যাম্পাসে মাদক সেবন ও বিক্রির অভিযোগে পলাশ হোসেন (৩০) নামে এক কারারক্ষীকে হাতেনাতে আটক করা হয়। ঘটনার পর থেকে অন্য দুই কারারক্ষী পলাতক। একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর মাদক কারবার ও সেবনের অভিযোগে হাই সিকিউরিটিসহ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ ও ২-এর পাঁচ কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও একজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়।

২০১৮ সালের মে মাসে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় কর্মকর্তা ও কারারক্ষী মিলিয়ে কমপক্ষে ৭০ জনের বিরুদ্ধে মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনজনকে চাকরিচ্যুত এবং দুজনকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এর আগে মার্চ মাসে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বরিশাল কারাগারের চার রক্ষীকে বরখাস্ত করা হয়।

একই বছরের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সোহেল রানার এই অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় তদন্ত কমিটি।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল সিনিয়র জেল সুপারের কনফারেন্স কক্ষে একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের ১১ কর্মকর্তার সঙ্গে একটি খুনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ও ওই গ্রুপের ডিএমডির বাণিজ্যিক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া মাস ছয়েক আগে গাজীপুরের কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে দিন-দুপুরে মই নিয়ে সীমানাপ্রাচীর পেরিয়ে বেরিয়ে যান আবু বকর ছিদ্দিক নামের এক কয়েদি। ওই সময় ১২ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজি প্রিজন্স কর্নেল আবরার হোসেন বলেন, কারাগারগুলোতে যখনই কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসছে, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা মিললেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের কারাগারগুলোতে প্রযুক্তিগত ব্যবহারও বাড়ানো হচ্ছে, যাতে কোন কারাগারে কী হচ্ছে সেগুলো ঢাকা থেকেই মনিটরিং করা যায়।

 
Electronic Paper