সেবার নামে প্রতারণা
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২১
জলবায়ুজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি ও আবাসন প্রদান, স্কুল নির্মাণ, নদীভাঙন রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, কৃষকদের ডিপটিউবয়েল প্রদান, দুস্থদের চিকিৎসা সাহায্যসহ বিভিন্ন সেবমূলক প্রকল্পে ফান্ড সংগ্রহের প্রলোভন দেখাতেন মো. রুবেল আহম্মেদ ওরফে হেলিকপ্টার রুবেল (৩৬)। এরপর সেই ভুয়া ফান্ডের টাকা ছাড়ের জন্য লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করতেন। এভাবে প্রতারণা করে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান রুবেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে গত রোববার রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ইকোনমিক অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং টিমের সদস্যরা।
বিশ্বাস জোগাতে হেলিকপ্টারে যাতায়াত
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (সিসিআইসি) নামক একটি বিদেশি এনজিও সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন রুবেল। মানুষের মনে বিশ^াস স্থাপন করতে তিনি ঢাকা থেকে যাতায়াতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন বলে তার নাম হয়ে যায় ‘হেলিকপ্টার রুবেল’। তার মূল টার্গেট ছিল ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা।
রাজধানীর উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বিমানবন্দর থানায় হওয়া একটি মামলার সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
সেবামূলক প্রকল্পের নামে অভিনব প্রতারণা
মামলার বিবরণী থেকে জানা গেছে, রুবেল আহম্মেদ সাত থেকে আটজন সহযোগী নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানাধীন তিন নম্বর বেতবাড়ীয়া ইউপি এলাকা পরিদর্শন করে জলবায়ুজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, দরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি ও আবাসন প্রদান, স্কুল নির্মাণ, নদীভাঙন রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, কৃষকদের মাঝে ডিপটিউবয়েল প্রদান, দুস্থদের চিকিৎসা সাহায্যসহ বিভিন্ন সেবামূলক আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থাপূর্বক ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার প্রজেক্ট প্রস্তুত এবং এ সংক্রান্ত প্রজেক্ট পার্টনার, প্রজেক্ট ও স্কুলে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা রকম প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুয়া ফান্ডের টাকা ছাড়ের জন্য আড়াই শতাংশ হিসেবে ট্যাক্স ও বিভিন্ন খরচ বাবদ ৪৩ লাখ টাকাসহ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থের প্রতারণা করে আত্মগোপনে চলে যান।
সিটিটিসি জানায়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই হেলিকপ্টার রুবেলের পেশা। নিজেকে প্রমাণ করতে এবং মানুষের বিশ^াস জোগাতে তিনি ঢাকা থেকে যাতায়াতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন। কুষ্টিয়া, মাগুরা, খাগড়াছড়িসহ কয়েক জেলা থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের সময় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, একাধিক মোবাইল, সিমকার্ড, ভ্যাট প্রদানের নির্দেশপত্র, কোটেশন গ্রহণপূর্বক কাজের অনুমোদন প্রদানের কপি, অনলাইনে কর পরিশোধ পদ্ধতি সংক্রান্ত ভুয়া কাগজপত্র, বিভিন্ন মানুষের ছবি ও এনআইডির ফটোকপি সংযুক্ত করা অনুদানপ্রাপ্তির ফাঁকা আবেদন ফরম ও চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন, দুস্থদের ঘর প্রদানের নামের তালিকা, সিসিআইসি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন কমিটির তালিকা, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয়ের অনুমোদনপত্র ও বিল ভাউচার, সিসিআইসির ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টসহ বিভিন্ন কাগজ উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে উত্থান হেলিকপ্টার রুবেলের
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, লিটন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে একটি এনজিওতে কিছুদিন চাকরি করেন রুবেল। সেখানে কর্মরত অবস্থাতেই এ ধরনের প্রতারণার কৌশল তার মাথায় আসে। পরবর্তীতে এমন কৌশলে প্রতারণা করে মাগুরা ও খাগড়াছড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন রুবেল। ২০০৭ সালে তিনি চলে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানে দেড় বছর অবস্থান করার পর আবার দেশে ফিরে আসেন এবং নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পাততে শুরু করেন। তার কাছ থেকে যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে তাতে বাবার নামে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। জাতীয় পরিচয়পত্রে সঠিক নাম ঠিকানা ব্যবহার করলেও পাসপোর্টে নিজের বাবার নামের জায়গায় খালুর নাম বসিয়েছেন রুবেল। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, প্রতারণার পর দেশের বাইরে চলে গেলে তাকে যাতে সহজে খুঁজে বের না করা যায় সে জন্য তিনি এই কৌশল অবলম্বন করেছেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানী ছাড়াও কুষ্টিয়া, মাগুরা ও খাগড়াছড়িতে একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন দৈনিক খোলা কাগজকে জানান, অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া রুবেলকে রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে তার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল এবং প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া টাকা সে কোথায় বিনিয়োগ করেছে।