ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে এবং লেখার ব্যবধান
দ্বীপ সরকার
🕐 ১:৩৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২১
এক লেখা থেকে আরেক লেখা বা এক কবিতা থেকে আরেক কবিতা লেখার ব্যবধান- এমন বিষয় নিয়ে বিস্তর কথা শোনা যায় কবি লেখক মহলে। কেউ বলেন, লেখা নিয়মিত থাকা উচিত। সে হিসেবে প্রতিদিন বা দু’একদিন পরপর বা সপ্তাহে অন্তত একটি লেখা, লেখা উচিত। তাতে লেখার গতি এবং লেখার বোধ ও গভীরতা ঠিক থাকে। আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বিভাজন ঘটে না। আবার অনেকে মনে করেন এত বেশি লিখলে বা এত স্বল্প ব্যবধানে লিখলে লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তারা মনে করেন মাসে ছয় মাসে একটি লেখা লিখলে সেটা বেশ পোক্ত এবং যুতসই হয়। এই যুক্তিকে অনেকে থোড়াই কেয়ার করেন।
বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রটা একটু আলাদা। এখানে যত স্বল্প ব্যবধান প্রয়োগ করা যাবে ততই কবিতার নিগূঢ় বোধ ও প্রসঙ্গ বিদ্যমান রাখা সহজ। অর্থাৎ কবিতা যে কর্ষণের বিষয় তা যুুুুক্তির ভাড়ারে আনা যায়। কবিতাকে কর্ষণ করতে হলে সেখানে প্রতিদিন যেতে হবে। চিন্তার ভেতরে এমন শত সহস্র অণুভাবনাগুলো একত্রিত হয়, সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে একই সময় একাধিক কবিতা প্রসব করা সম্ভব। এবং এটা কবিদের সহজাত বিষয়। যখন লিখতে বসে তখন একসঙ্গে অনেকগুলো লিখে ফেলেন। এর কারণই হলো চিন্তা ও ভাবনার ব্যবধান খুব কাছাকাছি। অনুভাবনাগুলো কলমের ডগাতেই নাচে। তাই একাধিক কবিতা লিখতে কবিতার চরিত্র, বিশ্লেষণ এবং কবিতার অন্তর্নিহিত তথ্য ও ভাবনাগুলো প্রয়োগে সহজ হয়। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলে কবিতারাও তার নিকট থেকে সরে যায়। কবিতাকে ছেড়ে দিলে বুঝে নেবেন কবিতাও আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছে।
কবিতাকে ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’র মতো ওঠ ‘কবিতা তোকে লিখি’ এমনটি ভাবা কবির জন্য শুভ নয়। তখন এমন ঘটবে যে কবিতাকে জোর করে লেখার তাগাদা দিচ্ছেন কিন্তু লেখা হাতে আসছে না বা আসলেও সেটা আর কবিতা হচ্ছে না। জোর করে কনেকে বিয়ে দিলেও দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু কবিতাকে জোর জুলুম করে পৃথিবীতে আনা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন কবিতার কাছে কাছে থাকা। কবিতার কাছে যত যাবেন ও ধরা দেবেই। এ কারণেই যে পণ্ডিতগুলো ভাবেন অনেক দিন পর পর একটা কবিতা লিখলে তা হবে চঞ্চলা হরণীর মতো বা ফুটফুটে রমণীর মতো সুন্দর এটা আমার যুক্তি বুদ্ধিতে কম ঢোকে। তবে গদ্য’র ক্ষেত্রটা অনেকটাই ভিন্ন। এখানে ব্যবধান রাখা ভালো। দীর্ঘ ভাবনার সন্নিবেশ ঘটানো যায় এবং তাকে পাঠপ্রিয় হওয়ার জন্য যতগুলো কন্টেন্ট প্রয়োজন তার প্রয়োগ ঘটানো যায়। একটু সময় নিয়ে তথ্য-উপাত্তের সংমিশ্রণ না ঘটালে তা পানসে হয়ে ওঠার প্রবল আশঙ্কা থাকে। লেখার মধ্যে দুর্বল চরিত্রের আনাগোনা নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য ব্যবধান রাখা ভালো।
সৈয়দ শামসুল হকের মতে ‘কবিতা হলো সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ’। তার এই যুক্তির কাছাকাছি যেতে হলে কবিতাকে যত স্বল্প ব্যবধানে লেখা যাবে ততই কবিতার যথাযথ ভাবের সংমিশ্রণ ঘটানো সম্ভব এবং এক কবিতা থেকে আরেক কবিতার ভাবের যোগাযোগ নিগূঢ় হবে। বিশেষ করে কবিতার অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে কবিতাকে বের করে আনার জন্য স্বল্প ব্যবধানের ফর্মুলায় আসতে হবে সবাইকে। দুই মাস পর বা ছয় মাস পর অথবা আরেকটু বেশি সময় নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফাটিয়ে দেবেন- তা কখনো হয় না। এটা কষ্টসাধ্য হবে এবং কবিতার সামগ্রিক বিশ্লেষণে সেটা ভাঁড় হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কার্লাইল যেমন কবিতাকে ‘মিউজিক্যাল থট’ ভেবেছেন অর্থাৎ একটা দোলায়িত ব্যাপার হিসেবে দেখেছেন তার জন্য অবশ্যই ঘনঘন কবিতার কাছে যেতে হবে। তখন ‘পেলেও পেতে পারেন অমূল্য রতন’ এমন অনিশ্চয়তা থেকে অবশ্যই মুক্ত হওয়া সম্ভব।