রাই কুড়িয়ে বেল
হাসনাত মোবারক
🕐 ১:০৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২১
একতাই বল, একতাই শক্তি। এমনটাই প্রমাণ করে চলেছেন এক দল উদ্যমী যুবক। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বিলচলনের বুকে যাদের বসবাস। আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত অসংখ্য গ্রাম পানির ওপর ভেসে থাকে। যেন ভাসমান এক দ্বীপ। তেমনি একটি গ্রামের নাম চিনাধুকুড়িয়া। শহর-নগরের রূপজৌলুস থেকে দূরে-বহুদূরের এই বাসিন্দাদের নিয়ে নানান কথা উপকথা জমা আছে মনবিতানের খাতায়।
এই তো কয়দিন আগে ওই নিভৃত পল্লীতে গিয়ে দেখি মহা আয়োজনের পশরা। ৪২ গজ আয়তনের একটি পানসি নৌকা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুর পেশা-শ্রেণির মানুষ। মুষ্টি মুষ্টি চাল, গমসহ কারোর খেতের সবজি বিক্রি করা জমানো দু’চারটা খুচরো টাকা। এ যেন রাই কুড়িয়ে বেল। সেটা সত্য প্রমাণ করার পথে ওই গ্রামের যুবকরা। এই বাইচের নৌকা জলে ভাসাতে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হবে।
ভরা বর্ষার মৌসুমে এদের পেশা মাছ ধরা, নৌকা চালানো, মাছ বিক্রিসহ নানান পেশায় নিয়োজিত এতদাঞ্চলের মানুষ। এর পরও তারা এত বড় উদ্যোগ নিয়েছে শুধু সৌখিনতার বশে। নৌকার বাহারি বৈঠার তালে তালে জলের ছোঁয়ায় নান্দনিক এক দৃশ্যকাব্যের কারিগর এই মাঝি মাল্লাদের সৃজনক্রিয়ায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। এত বড় নৌকার গঠন অবয়ব দেখে আমার মনে কৌতূহল জেগেছিল। তাই নৌকার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছুতোরের হাতুড়ি বাটাল র্যাদার শব্দকে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করল। আমার শিল্পমানস মন উচাটন হয়ে গেল। ইশ! যদি সাধ্যে থাকত তাহলে গ্রামের এই সৌখিন মানুষদের মনে সখ আরও ব্যাপকভাবে পূরণ করে দিতাম। আমি নৌকার কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় দু’চারজন বয়সী মানুষ আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভাই তুমি তো সাংবাদিক মানুষ। আমাগারে লাওটি (নৌকাটি) নিয়ে যখন বাইচ দিতে যাব, পেপারে পত্রিকায় লাওয়ের ছবি তুলে দিও হে। এই প্রথম এত বড় লাও আমাদের এলাকায় বানানো হচ্ছে।’
এই গ্রামের মানুষের আবেগ অনুভূতি দেখে আমার মনে পড়ল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ও ফখরে আলম ভাইয়ের কথা। কীভাবে এই ধূসর পাণ্ডুর গাত্রের মানুষদের আনন্দ অনুভূতির কথা লিখে জানাই! নৌকার ছুতোর মিস্ত্রিদের সার্বক্ষণিক জোগানদার আজাহার আকন্দের চোখে-মুখে দেখি আনন্দের বান বয়ে যাচ্ছে। ৬০ বছর বয়সী মানুষটির কাছে এমন শ্রমসাধ্য কাজ কিছুই মনে হচ্ছে না। এ এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বলে নয়, আবেগের চূড়ান্ত রূপের মিশেলে অনুভব করলাম, নৌকার কাঠ পাতামের সঙ্গে তার সমস্ত আনন্দ মিশে আছে। ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
বয়সী এক মাঝি মোক্তার হোসেন হাজি। বয়সের ভারে কোমরটা তার বেঁকে গেছে। তিনি বলেন, পুরনো ঐতিহ্যকে ফেরানোর জন্য এই উদ্যোগ। আমরা তো মারাই যাব। পাড়ার ছেলেরা একটা আশা উঠাইছে। ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি আনন্দ বিনোদনও লাগে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ভাই। আমরা তো এখন বুইড়া হয়ে গেছি। তখন যুবক বয়স। সে সময় নৌকার সারিন্দারি করতাম। পাকিস্তান পিরিয়ডের কথা। পাকিস্তানিদের কটাক্ষ করে আমরা নৌকা বাইচের সময় কত সারি যে গাইছি। এই বুড়ো বয়সে সেসব আর কী বলব। এখনকার ছেলেপেলেদের মধ্যে কোনো, জারি, সারি গান বাঁধার মন মানসিকতা দেখি না। মোবাইলে কী সব চাপাচাপি করে। অথচ আমরা সে সময়ে কত যাত্রাপালা, নাটক, গানের আসর বসাইছি। আমি কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো নৌকার সারিন্দার ছিলেন, দু’একটা সারি যদি এখন শোনাতেন।
লাল টকটকে গালখান ছেড়ে দিয়ে হাসি দিয়ে বললেন, হ ভাই। এখন বুড়ো মানুষ হয়ে গেছি। ওসব সারি কি আর মুখে আনা যায়। আমার পীড়াপীড়িতে তিনি একটা সারির দু’কলি গাইলেন, ‘ও সাধের গাঙচিলা রে উড়াল দিয়ে যায়, পাকিস্তানের মাইয়ারা টকটকিয়ে চায়।’ মোতালেব হোসেন প্রামাণিক। অন্যতম সংগঠক। তার কাছে এত বড় নৌকা গড়ে তোলার অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তার একহারা গড়নের শরীর থেকে যেন আনন্দের দ্যুতি বয়ে গেল। কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফে হাত বুলিয়ে নিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, বাপু, নিজেদের প্রভাব, নামডাক, অত্র এলাকায় মানুষকে জানাতে এত বড় কাজে হাত দিয়েছি। নিজেদের মধ্যে ঐক্য, একতা বজায় রাখার জন্য নৌকাবাইচের চেয়ে আর কোনো বিনোদন আমাদের কাছে নেই।
বাইচের নৌকার আগা নায়ের মাঝি আনছার সরদার ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বললেন, যত বড় লাও বাঁধতেছি বাপু। যে রাজার দেশেই যাব, হেই রাজ্য জয় কইরা আনব। এই নৌকা বানানোর সর্বাত্মক দায়িত্বে নিয়োজিত সিরাজুল ইসলাম, রবিউল করিম, জাহিদ সরদার, আব্দুর রাজ্জাক, মামুন, মানিক মোল্লা, রাজু নামের এক কিশোরসহ আরও অনেকে।
সারা দিনের কাজ শেষ যখন সন্ধ্যা নামে পশ্চিমের আকাশে তখন, নৌকার প্রধান ছুতোর শ্রীবাস চন্দ্র সূত্রধরের নেতৃত্বে গানের আসর জমে ওঠে। গানের আসরে উপস্থিত ছিলাম। আমার হৃদয়কোঠরে বাজতে শুরু করেছিল, বয়াতি আকবর হারুনীর গান- নিগূঢ় নিগূঢ় করে মানুষ আনন্দের বাজারে/ আছে মানুষ আনন্দের বাজারে।
হাসনাত মোবারক : কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]