পার্বণহীন পৌষ
গোলাম মোর্তুজা
🕐 ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২১
ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশ। ভালোবাসার এ দেশে ঋতু আসে যথাসময়ে। সম্ভবত বাংলাদেশের অবারিত বুক জুড়ে যেভাবে ঋতুর রূপ-রস-গন্ধ ছড়ায় পৃথিবীর আর কোথাও এমন হয় না। প্রকৃতি নানা রঙ ঢালে নানা সময়ে। কখনো আকাশজুড়ে বৃষ্টি। কখনো সাদা মেঘের ভেলা। কখনো কালবৈশাখীর ভয়াল ছোবল। কখনো ফুলে ফসলে আমোদিত। আবার কখনো ঋতুর রাজনে চারদিক সরগরম। বাংলাদেশে যখন যেমন, তখন তেমন ভাব শুধু আসে না, আসে রূপেও। বিশে^র কোনো দেশেই ছয়টি ঋতু নেই। অধিকাংশ দেশে বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত এই চারটি প্রধান ঋতু দেখা যায়। আমাদের বাংলাদেশে আসলে সবই বেশি বেশি। শীত বেশি, গরম বাড়াবাড়ি রকমের। দুর্যোগ বেশি বেশি। ধৈর্য বেশি, দুঃখ বেশি, গরিব বেশি, আর বেশি মানুষ। যাক গে সে কথা।
ঋতু পরিক্রমায় এখন শীত। পৌষ ও মাঘ নিয়ে শীতকাল। পৌষ চলছে। পৌষের সঙ্গে পার্বণ নামক শব্দটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না। এই পৌষের সঙ্গে বাঙালির রয়েছে এক গভীর ও নিবিড় যোগ। গানের কথা কবিতা করে শুনলে যেমন প্রাণ পায় না। মন আন্দোলিত হয় না। সেরকম আবেদন জাগে না। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের গল্প বলব আর সেখানে অনুষ্ঠান পালন বা পর্বাদি পালনের গল্পে আসর জমবে না তা তো কল্পনা করাই যায় না।
হাসতে হাসতে এদেশে ঋতু আসে আর যায়। আর আমরাও তা অবলোকন করি ছবির রিলের মতো। দেখে দেখে আমরা হই তৃপ্ত। আমাদের মন ও মননে জাগে আশা, বেড়ে যায় প্রত্যাশা। প্রত্যাশার চাওয়াগুলো যখন ভাষা পায় তখনি আমরা শান্তি সুখের স্পর্শে আমাদের যাপিত জীবনে ঢল হয়ে আসে অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি।
পৌষের প্রথম থেকেই চলে বাঙালির প্রাণের ঐতিহ্যের উৎসব আর নানা বর্ণিল অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানে শীত আসে দেহ ও মনকে নাড়া দিতে। জীবনটায় কিছুটা রিক্ততাও দেয় বটে। পৌষ এক সম্ভারের নাম। হেমন্তে ধানকাটায় কৃষকের ব্যস্ততা যেমন আমাদের গ্রামীণ জীবনকে জাগরিত করে তেমনি আবার আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে বয়ে নিয়ে আসে পূর্ণতা। পাকা ধানের মুহুর্মুহু গন্ধে কৃষকের মন ভরে, বুকে জাগে আরও কিছুদিন বাঁচার সাধ। ধান আছে তো না খেয়ে মরব না-এ ধরনের স্বপ্নেই বিভোর হয় কৃষকরা। ঘরে ওঠে ধান। কৃষাণীরাও কৃষাণের মতো গৃহস্থালির নানা কাজে সদা ব্যস্ত। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা ধান মাড়াই-বাছাইয়ের কাজে নিজেদের নিবেদিত করে। তাদের চোখে মুখে নতুন দিনের আশা আর প্রত্যাশার নীল ছবি। শীত আসে পায়ে পায়ে। তখন গ্রামের সবার মাঝে নতুন ধান আর নতুনভাবে জীবন সায়রে বৈঠা বাওয়ার পরিকল্পনা।
ধানের গন্ধ মনটাকে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরে দিলেও শীতের আমেজ কিছুটা মন্থর করে দেয় জীবনযাত্রার চাকা। তারা সব পেছনে ফেলে ধান ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি করে নানা রকম পিঠাপুলি। চারদিক পিঠা খাওয়ার গমগমে আয়োজন। এ সময়ে গাঁও গেরামে চলে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম। তাই বলি, পৌষ হলো পিঠা খাওয়ার মাস। গ্রামের ঘরে ঘরে পিঠার উৎসব। পাটিসাপটা, ভাপা, দুধ চিতই, সন্দেশ, রস চিতই, কুলি, পুলি, দুধপুলি, চসি, মেরা, আমিত্তি, নকশি, ফুলঝুরি, ফুলন দলাসহ অসংখ্য নামের পিঠা এদেশের গ্রামের গ্রামীণ পরিবেশকে আমোদিত করে রাখে। গ্রামের মায়েরা-বোনেরা অনেক আনন্দে আর ভালো লাগায় বানায় এসব পিঠা আর পরিবারের সবাই গরম গরম হাতে তুলে ফুঁ দিতে দিতে গপাত করে মুখে তুলে নেয়। আহ! সে কি মজা। মুখে গরম পিঠা তুলে হা করে মুখের ভিতর দিয়ে গরম ভাপ বের করে দিতে দিতে আনন্দের আস্ফালন আর কোথায় বা আছে। মায়ের হাতের পিঠা, খেতে বড়ই মিঠা- কথাটি শুধু গ্রামের মানুষদের মুখে আওড়ানো বুলি নয়। এই কথার মাঝে আছে শাশ্বত মায়ের আদর মাখানো। গ্রামের মানুষগুলো এ সুস্বাদু পিঠাগুলো একা একাই খান না। উনাদের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করেও খাওয়ান। এ তো গ্রামের পৌষের চিত্র। খেজুরের রস আর রসের পিঠা গ্রামের পিঠাপুলির উৎসবে নতুন মাত্রা পায়। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গ্রামের গাছিরা খেজুর গাছের মাথায় চড়ে রস নামিয়ে আনে। এরকম অবস্থায় অনেকেই সেই রসের সঙ্গে মুড়ি দিয়ে খায়। রস হতে এক সুন্দর প্রক্রিয়ায় গুড় করে তা দিয়ে আবার পিঠা বানানোর এক আলাদা আমেজ আছে। গ্রামের মানুষগুলো যেন শুধু গড়তেই জানে। একে অপরের সঙ্গে পিঠার এ উৎসবে সবাই মাতে। এক বাড়ির পিঠা অন্য বাড়িতে যায়। সবাই সবার পিঠার স্বাদ নেয়। শুধু কী তাই গ্রামের কারও সঙ্গে কারও মনোমালিন্য হলে এই উৎসবের মাঝে সবাই তা বেমালুম ভুলে যায়। ক্ষমাতেই নির্মল আনন্দ।
আসলেই গ্রাম যেন এক সম্প্রীতির নাম। গ্রামের মানুষ যতই দরিদ্র হোক না কেন নিজেদের জামাইসহ নিকট আত্মীয়দের পৌষের পিঠাপুলি খাওয়াতেই হবে। এ ধরনের আন্তরিকতার প্রতিচ্ছবি বিশে^র আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। সাধ্যের মাঝে সবটুকু সুখ অনুভব করাই যেন গ্রামীণ মানুষগুলোর এক স্বাপ্নিক দিক।
এবার একটু শহরের কথা বলা যাক, শহরের বাড়িগুলোতে এসবের কোনো বালাই থাকে না। তারা নিজেদের খুপড়ি তুল্য বাড়িতে থাকতেই হিমশিম আবার পিঠা বানিয়ে খাওয়া তো সম্ভব নয়। এ সময় শহরের বিভিন্ন রাস্তা এমনকি ফাস্টফুডের দোকানে পৌষের পিঠা বিক্রয় হয়। শহরের খাপছাড়া মানুষগুলো ওসব খেয়েই পিঠার স্বাদ মেটায়। এ যেন ঘোল খেয়ে দুধের অভাব মেটানো। আবার গ্রাম ছেড়ে অনেকেই আসা গ্রামের বাড়িতে যান। এখানে একটি কথা বলতে মন ভারাক্রান্ত হবে জানি তারপরও না বললে সত্যটাকে বলা হবে না। তাই একটু বেদনাসিক্ত হয়েই বলছি, শহরে আসা শেকড় বা শেকড়বিহীন মানুষগুলো একটা সময় নিজেদের ভুল শুধরাতে গ্রামে যায়। এ ক্ষেত্রে এ বিশেষ মাসে অনেকেই গ্রামে হ্যাবলার মতো ছুটে যায়। শহরের সবাই এ কাজটি করেন তা কিন্তু নয়। তবে যারা করেন না তাদেরকে স্যালুট জানাই। স্মৃতিচারণের পালা অনেকেই করবেন জানি। তবে তা শেষ হলে যেন আবার আগের মতো না হয়ে যান সে বিষয়টি খেয়াল করার জন্য করজোড়ে মিনতি জানাই।
শহরের রাস্তার বিভিন্ন অলিতে গলিতে ভাপা পিঠার বেশ কদর। অনেকেই এই মাসে এটাকে উপার্জনের একটা মোক্ষম সময় মনে করে। জীবন ও জীবিকার এ চিত্রও বোধ করি এ সোনার বাংলাতেই গোচরীভূত হয়। পৌষের শেষ দিনে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে পৌষ সংক্রান্তি। এটি বাঙালির ঐতিহ্য আর উৎসবের দিন। এই দিনটাকে উৎসাহ উদ্দীপনা আর আনন্দের সঙ্গে আয়োজন করে পালন করা হয়। চলে পৌষ মেলা। পৌষ মেলায় আমাদের আদি গৌরব লোকজ সংস্কৃতিকে চাঙ্গা করার হিড়িক চলে। দোকানে নানান বাহারের লোকজ পণ্য আর পিঠাপুলিতে সাজানো থাকে। বাঙালিরা তাদের প্রাণের আবেগকে এখানে প্রকাশ করে। এক দারুণ পরিবেশে দিনটি পালিত হয়। একদিকে চলে পিঠা তৈরির আয়োজন আর অন্যদিকে চলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানান দিক। নতুন প্রজন্মকে বাঙালির বাঙালিয়ানা স্পষ্ট করার মানসেই এসব অনুষ্ঠান করা। শহরেও চলে এসব অনুষ্ঠান। কিন্তু এবার বুঝিবা পার্বণ পালন করা হবে না। দেশ আজ ভীষণ অসুখে আক্রান্ত। সব থমকে আছে। এহেন পরিস্থিতিতে যখন নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাপনই সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে পার্বণ পালন অসম্ভব। তাই না হয় হলো না আমাদের প্রাণের উৎসব। পার্বণ না হয় নাই বা পালন করা হলো পৌষ তো এসেছে।
গোলাম মোর্তুজা : প্রভাষক
[email protected]