ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কোয়ারান্টিন বাংলায় এলো কীভাবে

শেখ আনোয়ার
🕐 ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৪, ২০২০

সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিন্তু বাজারে একটিও দোকান খুলল না। যে বাজারে সকাল-সন্ধ্যা হাজার মানুষের আসা যাওয়া। সেখানে এখন ঘুঘু চরে বেড়ায়। পথে লোকজনেরও দেখা নেই। দেখলে মনে হবে যেন সব নাগরিক এক সঙ্গে শহরটা পরিত্যাগ করেছেন। বাস্তবও কিছুটা সেরকম। অজানা মহামারীর আতঙ্কে বহু মানুষই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যারা পড়ে রয়েছেন, তারাও ভয়ের চোটে এক ঘরে হয়েছেন।

জি না। এটা চীনের সাম্প্রতিক দৃশ্য নয়। ২০২০ সালের করোনাভাইরাসের কোয়ারান্টিনের বাংলাদেশের কোনো শহরের দৃশ্যপটও নয়। এটা বঙ্গদেশে ১৭২৯ সালের বৈশাখ মাসে মুঘলদের রাজধানী দিল্লির দৃশ্যপট। যার বিবরণ দিয়েছেন সমকালীন ইতিহাসবিদ সৈয়দ গোলাম হোসেন তাবাতাবাই। আজকের দিনে বসে তাবাতাবাইয়ের সেই বিবরণ পড়লে গায়ের লোম কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। আজ থেকে প্রায় তিনশ’ বছর আগের এই বর্ণনা যেন কদিন আগেকার বাংলাদেশের কোয়ারান্টিনের ছবি। তবে আজকের বাংলাদেশের কোয়ারান্টিনের শহরগুলোর সঙ্গে একটা প্রকা- ফারাক রয়েছে মুঘল আমলের বঙ্গদেশের বিবরণে। মুঘল কেন? ইংরেজ শাসন পত্তনের পরেও মহামারীর সময় সারা শহরে কোয়ারান্টিনের উদাহরণ বিরল। যদিওবা দু’একটা উদাহরণ মেলে, তা হলো ভিনদেশ থেকে নবাগত কোনো বিশেষ একটা দলকে কোয়ারান্টিনের, আইসোলেশনের দৃষ্টান্ত। 

কোয়ারান্টিনের প্রাচীন নমুনা চীন ছাড়া বিশে^র আর কোথাও নেই। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, অটোমান সাম্রাজ্যে বারবার প্লেগ দেখা দেওয়ার ফলে অনেক সময় পশ্চিম এশিয়ার যাত্রীদের কিছুদিন কোয়ারান্টিনে রাখা হতো। ১৭৪৯ সালে উইলিয়াম প্লাইস্টেড নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী কলকাতা থেকে বসরা, বাগদাদ ইত্যাদি নগর হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কালে ফ্রান্সের মার্সেই শহরে কিছুদিন কোয়ারান্টিনে ছিলেন। সে বর্ণনা তিনি তার যাত্রার আখ্যায়িকায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
পরবর্তীকালে এ ধারার পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে আমাদের বাংলাদেশেই। যশোর জেলায় ১৮১৭ সালে দেখা দেয় নতুন এক ব্যাধি। সংক্রমিতরা হঠাৎ করে ঘনঘন বমি ও মলত্যাগের মধ্যে দিয়ে অতি দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে থাকে। যদিও আমাদের এই প্রাচীন বাংলা বহুকালই পেটের নানান অসুখের সঙ্গে সুপরিচিত। ১৮১৭ সালের আগে সেসব রোগ কখনো এত মারাত্মক রূপে আবির্ভূত হয়নি। তাই এই ব্যাধির নতুন নাম রাখা হলো ‘এশিয়াটিক কলেরা’। যশোর থেকে প্রথমে কলকাতা হয়ে তারপর বাকি মহাদেশে এবং তারও পরে সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়ানক এশিয়াটিক কলেরা।

কলেরা বা ওলাওঠার এই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার একটা স্পষ্ট কারণ ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকটা ছিল বিশ^ায়নের প্রথম স্তর। বাষ্পচালিত জাহাজে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল অনেক সহজ ও দ্রুত। সে সহজতা ও দ্রুততার সুবিধা নিয়েই নানা ইউরোপীয় দেশ অন্যান্য মহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই ইংরেজ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণ এবং ফল দুটোই ছিল বাণিজ্য। কাঁচামাল সস্তায় কেনা ও তৈরি জিনিস বড় বাজারে বিক্রি করা। এই দুটোই ছিল সাম্রাজ্যবাদের মূলমন্ত্র। আর কে না জানে, যশোর তখন নীল চাষের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আর সে ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে নানা দিক থেকে বহু মানুষ তখন যশোরবাসী হচ্ছেন। এ ব্যবসার সুবিধার জন্যই ইংরেজ বেনিয়া সরকার নতুন সড়ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর সে সড়ক নির্মাণের কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন জেল থেকে নিয়ে আসা কয়েদিদের। এ সড়ক তৈরিতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যেই প্রথম দেখা দেয় ভয়ানক কলেরা। আর এই বাণিজ্যিক পথ ধরেই তা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে।

সাম্রাজ্য আর বাণিজ্যের যৌথভাবে তৈরি জাল যেমন পৃথিবীটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাকে। সে জাল বেয়েই আবার কলেরার মতো ভয়ানক ব্যাধি দ্রুতগতিতে বিশে^র এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৮১৭ থেকে ১৮২১ পর্যন্ত বারে বারে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে কলেরায়। আজকের বিজ্ঞানীরা এই সময়টাকে ‘প্রথম কলেরা প্যানডেমিক’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এই বিষয়ে একটা বড় রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ধাঁধা হলো, এই মারাত্মক এবং বিধ্বংসী ব্যাধির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজ সরকার কেন কোয়ারান্টিনের প্রচেষ্টা করেনি? ঔপনিবেশিক বাংলাকে কোয়ারান্টিন করে দিলে তো তাদের নিজের দেশ রক্ষা পেয়ে যেত। কিন্তু ইংরেজরা তা করল না কেন? বরং চিরাচরিত, প্রাক-ঔপনিবেশিক রীতি অনুযায়ী তারা চেষ্টা করল আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার সুযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা দিতে। প্রধান সড়কগুলোর ধারে ধারে দ্রুত স্থাপিত হলো কিছু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। গ্রামাঞ্চলে অস্থায়ীভাবে কয়েকজন চিকিৎসকও নিযুক্ত করা হলো।

প্রাক-আধুনিক জনস্বাস্থ্য ভাবনায় রোগের সংক্রামকতার তেমন কোনো সুগঠিত ধারণা ছিল না। বরং বিজ্ঞানীদেরই ধারণা ছিল, প্লেগ কিংবা কলেরার মতো রোগের উৎস দূষিত পরিবেশ। ইউরোপের মধ্যযুগেও আমরা দেখতে পাই একই রকমের ধারণা।

চিকিৎসক এমনকি শিক্ষিত মানুষও মনে করতেন, কোনো অজ্ঞাত কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে একধরনের বিষ প্রসব করে। এই বিষই উৎস স্থান থেকে পরে ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তের মানুষকে আক্রান্ত করে। বিষাক্ত বাতাসকে ইউরোপীয় চিকিৎসকরা ‘মাইয়াস্মা’ নাম দিয়েছিলেন। যাকে আমরা বলি মহামারী। মানুষ জানতেন, এই মহামারীর উৎপত্তি বিষাক্ত বাতাস থেকেই। ফলে একজন থেকে আরেকজনের শরীরে সরাসরি সংক্রমণের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। আর তাই কোয়ারান্টিনের কারণ দেখা দেয়নি। কোয়ারান্টিনের জিগির ওঠেনি। রোগ যদি সত্যি দূষিত পরিবেশ থেকে জন্মায় এবং পরে আবহাওয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আর মানুষের যাতায়াত, চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে কী হবে?

এ ধারণা দ্রুত পাল্টাতে থাকে। কোয়ারান্টিন জিগির প্রথম উঠল ১৮৩০-৩১ সালে। যখন দ্বিতীয় কলেরা প্যানডেমিক শুরু হলো। ততদিনে গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের প্রচার বহুল হয়েছে। দূর-দূরান্তের দেশগুলোর মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সে সুবাদে ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোর দৈনিক খবর থেকে এটুকু প্রমাণ হয়ে যায় যে বাংলা থেকে ধীরে ধীরে কলেরা বিশ^ময় ছড়াচ্ছে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজে চেপে। চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞান লেখক, গবেষক ও সাংবাদিকদের মিলিত প্রয়াসে বহুল প্রচারিত খবর হলো, কলেরা বঙ্গভূমি থেকে আমদানি হয়েছে। বাতাসের ডানায় ভর দিয়ে নয়। এ থেকেই উঠে আসতে থাকে সংক্রমণের ধারণা। সে ধারণার দ্বারাই লালিত হয় কোয়ারান্টিন করার যৌক্তিকতা।

১৮৩০-এর পরে কলেরার আতঙ্কে ত্রস্ত ইউরোপীয় রাজ্যগুলো একে একে কোয়ারান্টিন জারি করতে থাকে। প্রাক-আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত প্রায়শই ছিল আবছাভাবে মাপা। প্রধান নদীপথ বা স্থলপথে টোল আদায়কারী কয়েকটা চৌকি ছাড়া তেমন কোনো পাহারারও ব্যবস্থা ছিল না। তাই কোয়ারান্টিন সফল করতে, সীমান্তে বসানো হলো নতুন রাষ্ট্রীয় পাহারা। দেশের মধ্যেও নতুন আইনকানুন জারি হলো। আশ্চর্যের বিষয়, কোয়ারান্টিন মেনেও নেওয়া হলো। ইউরোপে এবং পরবর্তী কালে আমেরিকায় একাধিক দেশের মধ্যে অনেক শহর, গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত নিজের নিজের চৌহদ্দির মধ্যে কোয়ারান্টিন জারি করতে থাকল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে যেহেতু উনিশ শতকে তেমন বেশি বাঙালি মানুষ দেখা যেত না, এবং যেহেতু সেখানে মহামারীর আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত দরিদ্র আইরিশ অভিবাসীদের জাহাজে চেপে। তাই ওসব আইরিশদেরই সেখানে গণ-আক্রোশের মুখে পড়তে হয়।

সেই মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বহন করছে ‘কানাডা গ্রস আইল’ নামের দ্বীপ। এ দ্বীপে আয়ারল্যান্ড থেকে আসা হাজার হাজার দরিদ্র অভিবাসীকে কোয়ারান্টিনে রাখা হতো। যারা মহামারীতে আক্রান্ত তারা তো মরতই। উপরন্তু সুস্থ ব্যক্তিরাও অনাহারে বা সংক্রমিত রোগের জেরে কিংবা অন্য রোগের চিকিৎসা না পেয়ে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুমুখে পতিত হতো। তাই আজও অনেক আইরিশ দ্বীপটিকে তীর্থস্থানের মতো পবিত্র জ্ঞান করে।

শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

 
Electronic Paper