ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভাস্কর্য-প্রতিমা বিতর্ক

আশেক মাহমুদ
🕐 ১২:২৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০২০

ভাস্কর্য-প্রতিমা কালচার কোনোভাবেই আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কোনো শিল্প নয়। এটি এমন কোনো শিল্প নয় যা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফসল। এমনকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই। বরং এ কথা বলা যেতে পারে— ভাস্কর্য শিল্প প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনধারার সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রতিটি যুগেই ভাস্কর্য মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য আর স্মৃতি রোমন্থনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে আসছিল।

সেই ভাস্কর্য-শিল্প কি সেকুলারদের সম্পত্তি নাকি ধর্মীয় সম্পত্তি— এই নিয়ে আমরা যতই বিবাদ করি না কেন, মূলত ভাস্কর্য নিজ থেকেই একটা নিরপেক্ষ শিল্প। প্রতিমা পূজাকে বিভিন্ন ধর্মাচারের অনুষঙ্গ বলা হলেও ভাস্কর্য কালচারকে সেকুলার ও ধর্মীয় দুই জায়গা থেকেই বুঝতে পারি। এটা সত্য, পূজা আর সম্মান এক জিনিস নয়, আরাধনা আর স্মৃতিচারণ এক কথা নয়। আর এটা বুঝতে পারছি না বলেই আমরা অনেকেই প্রতিমা পূজা আর ভাস্কর্যকে এক করে ফেলি। সমুদ্রের পানি আর ওরস্যালাইন কিছুতেই এক নয়, দুটাই লবণাক্ত, দুটার কাজ ভিন্ন; একটা মেডিসিন অন্যটা প্রাকৃতিক পানীয়। ভাস্কর্য আর প্রতিমা পূজাও এমনি ভিন্ন কিছু। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশেই প্রচুর ভাস্কর্য আছে, আবার বিভিন্ন সেকুলার প্রধান দেশেও ভাস্কর্য রয়েছে।

মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো ন্যাশনাল মনুমেন্ট যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরদের স্মরণে নির্মিত হয়। কাতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো ‘হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড’, মানে হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ। ইরাকের বাগদাদে রয়েছে আব্বাসীয় শাসক মনসুরের এক বিশাল ভাস্কর্য, আরও আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দা নগরীতে আছে উটের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। এছাড়াও ইরানে রয়েছে বিশ্বখ্যাত কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ সিরাজী, এমনকি ইবনে সিনার ভাস্কর্য। এসব দেশে হাজার বছর ধরে ভাস্কর্য আছে, সেখানে আলেম সম্প্রদায় আছে, কেউ ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি, অথচ এ নিয়ে আমরা কেন সোচ্চার সে বিষয়টা দেখা দরকার।

আমাদের সমাজে বলা হচ্ছে, ভাস্কর্য পুরোপুরি ইসলামবিরোধী, এমনকি ইসলাম ধর্মে এটি হারাম। আমার স্বাভাবিক বিবেচনায়— কোনটি ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম কোনটি হালাল, সেটির বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ। মানুষ নন। এখন আমরা হয়তো বলতে পারি, পবিত্র কোরআন শরিফে প্রতিমা পূজাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, সে সুবাদে ভাস্কর্য হারাম। আমরা এও জানি, কোনো নবী হারাম কোনো কাজ কখনো করেননি, যা পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। নবী সোলায়মান আ. যে নিজেই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বাণী থাকা সত্ত্বেও আমরা বলছি পরবর্তী সময়ে এটিকে হারাম করা হয়েছে। কেউ কি দেখাতে পারবেন এ ব্যাপারে এমন একটি আয়াত— যে আয়াতে ভাস্কর্যকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে? যদি ভাস্কর্য আর প্রতিমা পূজা এক হয়ে থাকে, যে প্রতিমা পূজা মানুষকে কলুষিত করে (পবিত্র কোরআনের ভাষায়), কোনো নবী কি নিজেকে এভাবে কলুষিত করেছেন? যদি এই বিধান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয় তাহলে কি আমরা এই বলব যে—আল্লাহর কাছে কলুষ নিষ্কলুষের ধারণা আপেক্ষিক (বিশ্বাসীরা তা কিছুতেই ভাবতে পারে না)?

মানুষ যদি বিধান দেয় তাহলে মানুষ এক সময় মদকে হালাল বলতে পারে, অতঃপর দেখল মদের অনেক ক্ষতি, এই দেখে মানুষ মদকে হারাম করল। এর মানে মানুষের জ্ঞান অভিজ্ঞতার আলোকে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তো মানুষ নন, বিশ্বাসীদের চোখে শাশ্বত, মানে সীমাবদ্ধতামুক্ত। এর মানে মৌলিক বিধানের পরিবর্তন হতে পারে না। অথচ এসব চিন্তা না করেই বলছি— ভাস্কর্য হারাম। আমি কথাটা নিজ থেকেই বলছি না। তাফসিরে ‘মিজান’-এর লেখক আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেছেন— পবিত্র কোরআনে যদি কোনো কিছু সরাসরি হারাম ঘোষিত না হয় তাহলে আমরা কিছুতেই তা হারাম ঘোষণা করতে পারি না।

এ থেকে সহজেই বুঝতে পারি, ইসলাম ধর্মে প্রতিমা পূজা হারাম হলেও ভাস্কর্য নিজ থেকে হারাম নয়। আমরা তখন বলি, কোনো নবীর ভাস্কর্য বা কোনো সাহাবির ভাস্কর্য কেন বানানো হয়নি? প্রথমত, এটা এজন্য যে ভাস্কর্য বানানো ফরজ নয় যে বানাতেই হবে। আবার ফরজ না হলেই যে হারাম, তাও নয়। তবে এটা সত্য, ভাস্কর্য হল স্মৃতিচারণের স্মারক। মানুষ যদি ভাস্কর্য বানাতে চায় তার মান নির্ভর করে নিজ নিজ নীতি ও মূল্যবোধের ওপর। এটা বুঝতে হলে ভাস্কর্যের রাজনীতি বুঝতে হবে।

এই রাজনীতিটা দেখেই আমাদের বুঝতে হবে— কেন আরবে ভাস্কর্য প্রথা সংকুচিত হয়েছিল? আরবের সুদীর্ঘকাল ছিল রাজতন্ত্রের ইতিহাস। আব্বাসীয় ও উমাইয়া রাজতন্ত্র কিছুতেই উচ্চতর ও গৌরবোজ্জ্ব¡ল মানুষদের মাথা উঁচু করতে দেয়নি। সে সময় ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিক সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করা হয় শুধু আদর্শিক দর্শনচর্চার জন্য। সেই পরিবেশে ভাস্কর্য নির্মাণ করা তো দূরের কথা, আদর্শ মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই কারণেই তো কারবালার ঘটনা ঘটেছিল।

ইরাকে একসময় সাদ্দামের রাজত্ব ছিল, আমাদের অনেকেই তখন সাদ্দামের সমর্থক ছিল, সেই সাদ্দামের বহু ভাস্কর্য ছিল। মার্কিন আঘাতে সে সব মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আবার দেখা যায়, আমেরিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে কলম্বাসের ভাস্কর্য, দাস ব্যবসায়ী কোলস্টনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। ইরাকিরা সাদ্দামের পূজা করেনি; মার্কিনিরা কলম্বাস-কোলস্টনের পূজা করেনি, কিন্তু কলম্বাস-কোলস্টন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক, আমাদের চোখে ছিল অত্যাচারের প্রতীক।

অন্যদিকে, ইবনে সিনা, কবি হাফিজ, ওমর খৈয়াম উচ্চতর সভ্যতা নির্মাণের স্বাক্ষর ছিলেন বলেই তাদের ভাস্কর্য ছিল ন্যায়ের প্রতীক। এর মানে ভাস্কর্যের দুটো প্রধান রূপ আছে, একটা হলো ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রতীক, অন্যটি হলো অত্যচার ও জুলুমের প্রতীক। আমরা যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি— তাহলে এ কথা বলতে পারি, এমন ভাস্কর্য নির্মাণ করা যায় যা ন্যায় নীতি ও সৎকর্মের দিকে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে, আর এমন ভাস্কর্য নির্মাণ করা উচিত নয় যাতে করে অত্যাচারীরা আরও অত্যাচারী হতে উৎসাহিত হতে পারে। মূলত ভাস্কর্য কালচার রাজনীতির রূপরেখার মধ্যেই প্রোথিত।

আমরা চাই ভাস্কর্য নিয়ে কাদা ছোড়াছুঁড়ি না করে, শান্তির পথে চলা। আমরা বলতে চাই না এটা ফরজ, এও বলতে চাই না— এটা হারাম। বরং জঘন্য অন্যায় অবিচার সমাজে বিস্তার লাভ করলেও আমাদের সে দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ভাস্কর্য নিয়ে আমরা যেভাবে সোচ্চার হচ্ছি, সেভাবে কি সোচ্চার হচ্ছি সমাজের চলমান দুর্নীতি, লুটপাট, ধর্ষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে? অথচ এটাই ফরজ ছিল। যদি আসল কাজের দিকে মনোযোগ না দিই, আমরা কি পারব সমাজের আসল উন্নতি নিশ্চিত করতে? আসলে, আমরা চাই এমন ভাস্কর্য কালচার যাতে থাকবে মানবিকতার প্রকাশ, সৎকর্মে উৎসাহের অনুভূতি, উচ্চতর সৃষ্টিশীলতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ। আমরা চাই সুস্থ সমাজ, যেখানে দুর্নীতি আর অত্যাচারের কবল থেকে জাতি রক্ষা পাবে, আমরা চাই উন্নত সংস্কৃতির বিকাশ।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper