ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

একমুঠো তারাবাতি

সালেহা চৌধুরী
🕐 ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২০

দীর্ঘদিন লন্ডনে স্কুল শিক্ষকতা করি। প্রথমে ‘বরো অফ ক্রয়ডন’ তারপর ‘বরো অফ টাওয়ার হ্যামলেটস’। আমি সবসময় পছন্দ করতাম ছোটদের ক্লাস। ফলে বেশ কয়েক বছর আমি নার্সারিতে কাজ করি। একসময় আমার ইংরেজি কবিতার বই লন্ডন থেকে বেরিয়ে গেলে একদিন হেডমাস্টার জন আমাকে ওর ঘরে ডাক দিয়ে বলেন- তোমার ইংরেজি কবিতার বই তো বেরিয়ে গেছে। এখনো কি তুমি নার্সারিতে কাজ করবে? 

 

আমি বলি- আমার ওদের সঙ্গে কাজ করতে খুব ভালো লাগে। কেন আপনি কি অন্য কিছু ভাবছেন? 

তিনি বললেন- আমি চাই তুমি ইয়ার সিক্সে পড়াবে। আমি ভীত। ওইসব বাচ্চা যে কী ভীষণ বিচ্ছু সেটা কে না জানে। বিশেষত বাঙালি টিচারদের নাস্তানাবুদ করতে ওরা খুব পছন্দ করে। অনেকেই এসব কারণে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। তখন আমি টাওয়ার হ্যামলেটসে। সেখানকার সকল বাচ্চাই বাঙালি। কেবল দু’একজন ইংরেজ বা গ্রিক বা ইতালিয়ান।

আমি বলি- জন আমি ওদের পড়াতে ভয় পাই।
তিনি বলেন- তোমাকে অঙ্ক করাতে হবে না। সেটা অন্য করাবেন অন্য টিচার। তুমি ওদের ইংরেজি পড়াবে। সিলেবাসে যা আছে দেখে তুমি ‘লেসন প্লান’ কর। আপাতত এক বছর কর। তারপর দেখা যাবে।

বুঝলাম জন যা বলছেন সেটা তিনি করবেন। প্রাইমারি স্কুলে কোনো নির্দিষ্ট বই থাকে না। কেবল সিলেবাস দেখে টিচার তাদের লেসন প্লান করেন। একসময় পুরো সিলেবাস শেষ করতে হয়। লেসন প্লান দেখেন হিড টিচার। তিনি পছন্দ করলে সেটা দিয়ে কাজ করা যায়। তিনি দেখেন আরও অনেক কিছু। আমি ইংরেজির সিলেবাস দেখে জানতে পারি ইংরেজি হাইকু সিলেবাসে আছে আরও কিছুর সঙ্গে। আমি তখন শুরু করলাম হাইকু দিয়ে। পাঁচ সাত পাঁচ সিলেবলে জমে গেল ক্লাস। সেখানে নাউন, প্রোনাউন, অ্যাডজেকটিভ, সিমিলি, মেটাফরের চর্চাও হতে শুরু হলো। ওরা জানল সিলেবল কী। বানান এবং আরও কত কী। ছেলেমেয়েরা হাইকু লিখতে লাগল। একেবারে ইলাসট্রেটেড। সেগুলো স্কুলের দেয়ালে টাঙানো হলো। দেয়ালের সেইসব ছবি দেখে সকলে বলতে লাগল এরা সব সালেহার ছানাপোনা। মোটামুটি সামলে-সুমলে চলছি। এর মধ্যে আমার ‘ইট গ্রোজ ইন মাই হার্ট’ থেকে কবিতা নিয়েও পড়াতে শুরু করলাম ক্লাসে।
কেন নয়? আমার কবিতার জন্যই তো আজ আমি চালান হয়ে গেছি ইয়ার সিক্সে। এর মধ্যে একটি কবিতা বাচ্চাদের খুব প্রিয় ছিল নাম তার ‘কুইন নেফারতিতি’। আর একটি ‘মোমেন্ট অফ ক্রিয়েশন।’ ওদের কাজ ছিল কবিতা পড়ে ওরা তা গদ্যে লিখবে। আর ছবি আঁকবে।

নেফারতিতি নামের মিশরের রানি ওদের ছবিতে প্রাণ পেল। কী সুন্দর সব ছবি। একেবারে পুরো মিশরীয় ছবি সেগুলো। আর ‘মোমেন্ট অফ ক্রিয়েশনে’ বাইকের ছবি এঁকে খাতার পাতা ভর্তি করল ওরা। ওরা সকলে বাইকে হেলান দিয়ে সন্ধ্যার আকাশে তাকিয়ে রইল। একটা দুটো তিনটে তারা ফুটছে। এরপর সিডারের ছবি, বহুদল গোলাপের ছবি, কলমের ছবি। প্রপাতের ছবি। আরও নানা কিছু। এইসব করতে করতে বছর শেষ হলো। দেখলাম ওরা সিমিলি মেটাফর, সিলেবল, চিত্রকল্প, ইলাসট্রেশন বেশ শিখে গেছে। কবিতাকে গদ্যে লিখতে পারছে। কবিতার ভাষা ও গদ্যের ভাষা বুঝতে পারছে।

বছর শেষ হলো আমি জনকে বললাম- জন, তুমি বলেছিলে আমাকে নার্সারি ক্লাসে দেবে।
তিনি বললেন- কেন ঠিকই তো আছে সব। দেয়ালে দেয়ালে কতসব ছবি। কী সমস্যা।
আমি বলি- আমি ওই সাড়ে তিন আর চার বছরের বাচ্চাদের খুব মিস করি। ওরাও মিস করে। ইম কেমন করে বলত- মিস আমি তোমার কান্দাত বসতাম। এরপর পাশে বসার সেইসব প্রতিযোগিতা। ওদের সঙ্গে খেলব বলে কতসব গেম বানিয়েছি। দেশ থেকে বাগাডুলি এনেছি। সেসব পড়ে আছে।
জন বললেন- দেখি কী করি।

যাই হোক এই করতে করতে আমি একসময় রিটায়ার করি। এরপর চলে গেছে কয়েক বছর। একদিন আমি লন্ডনের ‘ইস্ট এন্ডে’ গেছি কী এক কাজে। শীত জমিয়ে পড়বে মনে হয়। আমি কোট মাফলারে দস্তানায় এক বিশাল মাঠের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। ধু ধু মাঠ। মাঠটা পেরোতে পারলেই বাঁচি এমন ভাবছি। চারপাশে হিমেল বাতাস। কেউ নেই মাঠে। কেবল দু’একজন কুকুর নিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ শীতের বাতাস ভেদ করে এক উচ্চস্বর চিৎকার আমার কানে বাজে- মিস ও মিস। মিস। মিস।

কানঢাকা বলে একসময় শুনতে পাই। একটি ছেলে পাগলের মতো ছুটে আসছে আমার দিকে। আমি বুঝতে পারলাম ও একসময় আমার ছাত্র ছিল। পাঁচ বছরে বদলে গেছে তাই ওকে চিনতে পারছি না। কাছে এসে ও হাঁফাতে থাকে। বলে- মিস, কখন থেকে তোমাকে (ইউ মানে তুমি) ডাকছি তুমি শুনতে পাচ্ছ না।
আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বলি- তুমি কি কাইলিতে পড়তে? জি মিস। এরপর বলে- তোমার কথা আমার খুব মনে আছে। আমি ওকে পরীক্ষা করার জন্য বলি- আমি তোমাদের যা পড়িয়েছি সে সবের কিছু কি তোমার মনে আছে। পাঁচ বছরে ভুলে যাবে এমনই আশা করেছিলাম। ও এক গাল হেসে বলে- মনে আছে মিস।

কী মনে আছে? আমি ইয়ার সিক্সে মাত্র এক বছর পড়িয়েছি। সেখানে এমন কী পড়িয়েছি যে ও মনে রাখবে। ও আরও কাছে সরে আসে। শীতে আমার ইচ্ছে করে ওকে আমার কোটের ভিতর জায়গা করে দিই। তেমন শীতের কাপড় নেই ওর শরীরে। ও বলে- মিস, আমার রানি নেফারতিতির কথা মনে আছে।
নেফারতিতি? আমার সেই কবিতা। ও গড়গড় করে বলে গেল- ওপেন আপ দ্য ডোর/ ইউ উড সি উইথ হান্ড্রেড মেডস/ কুইন নেফারতিতি/ সাম ইনস্নেস কয়েলস/ স্টার স্টাটেড ইয়ারিংস- লাপিস লাজুলি।

আমার তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ কেন জানি ভরে গেল পানিতে। ঘন করে ওকে বুকের সঙ্গে ধরে বলি- আর কিছু?
ও বলে- মিস, সেই সাইকেলের কবিতা। আমরা কতসব ছবি এঁকেছিলাম। আর তুমি বলেছিলে- আমার ছবি তোমার খুব ভালো লেগেছে। এরপর আরও কিছু একটা কথা হলো। একসময় ও ওর পথে আর আমি আমার পথে চলে যাই। ঠা-া হাওয়া চারপাশে। মনে হলো- যেই এক বছর নিয়ে কত কিছু ভেবেছি সেই ভালো না লাগা বছরের একটি ছোট ঘটনা এই শীতের শহরে আমাকে কেমন উষ্ণ করে দিয়ে গেল। -কুইন নেফারতিতি মিস। তোমার কবিতা। এখনো আমি ভুলিনি।

মাঝে মাঝে শিক্ষকদের জীবনে এইসব মুহূর্ত আসে সেটাই হয় তাদের পুরস্কার। যেমন একদিন হাই কমিশন অফিসে একজন ছাত্রী বলে ছিলেন- আপা আপনি আমাদের ফার্স্ট পার্ট এমএ-তে মধুসূদন পড়াতেন। হাই কমিশনে আপনার যদি কিছু দরকার হয় আমাকে ফোন করবেন। আমি সেদিন সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। আর শীতের মাঠে কবির নামের ছেলেটি আমাকে একমুঠো তারাবাতি উপহার দিয়েছিল নিজের অজান্তে। ঈশ্বর তোমাদের ভালো রাখুক। যেখানে তোমরা থাকো ভালো থাকো।

সালেহা চৌধুরী: সাহিত্যিক ও অনুবাদক
[email protected]

 
Electronic Paper