নবীনের কবি
রাশেদ রহমান
🕐 ৭:০৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮
পাবনায় কবিকুঞ্জের নিজস্ব জমিনেই গড়ে ওঠা কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু শিক্ষা নিলয়ের পাশেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তিনি আমাদের খুব পরিচিত; কবি বন্দে আলী মিয়া।
নামের সঙ্গে যার কবি শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তার ‘আমাদের গ্রাম’ পড়েছো নিশ্চয়ই। আর কবিতাটি পড়েনি কে তাই বলো-‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর/পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই...।’
জয় গোস্বামী তার কবিতার এক জায়গায় তাই তার নামে স্মৃতিকাতর। জয় গোস্বামীর মতো অনেক মানুষ; যারা নিজেরাই বড় কবি বা লেখক, শৈশবে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়া এই সুন্দর, মনোরম কবিতাটি। আজ তাদের স্মৃতির সব চেয়ে আবেগময় খাতায় পটে তুলে রেখেছেন এই কবিতাটি। একজন পশ্চিম দেশীয় লেখক তাই বোধহয় বলেছিলেন, যাদের শৈশব-কৈশরের স্মৃতি নেই তারা যেন সাহিত্যের সমুদ্রে ভেলা না ভাসায়। কারণ সাহিত্য হলো ফেলে আসা স্মৃতির রোমন্থন। এখন বলো, যাদের শৈশবিক স্মৃতির ঝোলায় ‘আমাদের গ্রাম’র মতো কবিতা আছে, তাদের স্মৃতির খাতা তো ভর্তিই থাকে। তো তাদের শিল্পী-সাহিত্যিক হতে বাধা কোথায়? তাই তো আমাদের বাংলা ভাষায় এত এত কবি-সাহিত্যিক। সে তো বন্দে আলী মিয়াদেরই উত্তরাধিকার। তো এসো, এই শৈশবিক স্মৃতির জাদুকর সম্পর্কে কিছু জেনে নেই। কবি বন্দে আলী মিয়া। ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক। আঁকতেন ছবিও। সাহিত্য ক্ষেত্রের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ তার পেশাগত জীবনও। শিক্ষকতা করেছেন, বেতারে কাজ করেছেন, নাটকে কাজ করেছেন। তবে সব ছাপিয়ে তিনি আমাদের প্রিয় শিশুসাহিত্যিক। ছোটদের জন্য লেখা বই একশর বেশি। বুঝো এইবার কাকে নিয়ে আমরা বলতে বসেছি।
তিনি ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, পাবনা জেলার রাধানগর, উমেদ আলী মিয়া ও নেকজান নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ। কবির শৈশব-কৈশোর কাল কাটে রাধানগরেই। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতা আর্ট একাডেমিতে। ১৯২৭ সালে সেখান থেকে চিত্রকলায় ১ম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বন্দে আলী মিয়ার কর্মজীবন শুরু পড়াশোনা শেষ করার আগেই। সাংবাদিক হিসেবে ১৯২৫ সালে তিনি ইসলাম দর্শন পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। পরে, ১৯৩০ সালে যোগ দেন কলকাতা করপোরেশন স্কুলে, সহকারী শিক্ষক হিসেবে। এখানে দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করে ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করেন বন্দে আলী মিয়া। ষাটের দশকে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন। পাশাপাশি কবি বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য পালাগান ও নাটিকাও রচনা করেছেন। সেগুলো রেকর্ড আকারে বের হলে বেশ জনপ্রিয়ও হয় তখন। এতকিছু করেও বন্দে আলী মিয়ার জীবন ছিল খুব কষ্টের। অর্থ অনটন লেগেই থাকত। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও কবি কিন্তু তার সাহিত্যচর্চা ছেড়ে দেননি। অবিরাম লিখে গেছেন। বাংলার জীবন ও প্রকৃতির চিরায়ত রূপ তার লেখনীতে এমন দরদি মায়াবী আঙ্গিকে ভেসে উঠেছে, তোমাদের মতো ছোট্ট সোনাদের বুকের পলিতে নরম হাতে বসিয়ে যায় ভালোর চারা, মঙ্গল আর কল্যাণের বীজ। আজীবন যিনি কষ্ট করলেও লিখে গেছেন তোমাদের জন্য, তোমাদের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটানোর জন্য।
কবি যখন বেতারে কাজ করতেন, তখন ছোটদের জন্য একটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। নাম ছিল ‘সবুজ মেলা’। বেতারে ছোটদের জন্য আরও একটা অনুষ্ঠান হতো তখন- ‘ছেলে ঘুমাল’। সে অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই নিত্যনতুন গল্প লিখে দিতেন তিনি। বন্দে আলী মিয়া সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শর মতো বই লিখেছেন। যার মধ্যে একশটির ওপর কেবল ছোটদের জন্যই। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- ‘ময়নামতির চর’, ‘অরণ্য’, ‘গোধূলী’, ‘ঝড়ের সংকেত’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘জীবনের দিনগুলো’, ‘অনুরাগ’। আর ছোটদের জন্য লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল চোর জামাই, মেঘকুমারী, মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ডাইনি বউ, রূপকথা, কুঁচবরণ কন্যা, ছোটদের নজরুল, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা ইত্যাদি। বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যে পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে পান প্রেসিডেন্ট পদক। মৃত্যুর পরও তিনি পেয়েছেন দুটি মরণোত্তর পদক-১৯৮৮ সালে একুশে পদক, ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা পদক। কবিকে নিয়ে তার জীবিতকালে রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিশ একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছিল। তারা কবিকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। কবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা সংগঠনটির মুখপত্র ‘প্রতীতি’-এর একটি সংখ্যা ‘কবি বন্দে আলী সংবর্ধনা সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশ করেন। এটি ১৯৭৮-এর ঘটনা। তার মৃত্যুর পরে পরেই রেডিও বাংলাদেশ-এর মুখপত্র ‘বেতার বাংলা’র জুলাই অনুষ্ঠান সূচিকে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মরণী’ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। তার পরেই প্রকাশিত হয় ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মারক গ্রন্থ’। তারপর প্রকাশিত হয় ‘শিশু সাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া’। এর পর বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তার জীবনী এবং রচনাবলি। এর বাইরে দেশের নানা স্থানে প্রকাশিত হয়েছে তাকে নিবেদিত সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা।