ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মনিরের অপকর্মের সঙ্গী সোনা শফি লাপাত্তা

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৬, ২০২০

স্বর্ণ চোরাচালান ও ভূমিদস্যুতার অভিযোগে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির গ্রেফতার হওয়ার পরই গা ঢাকা দিয়েছেন স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের আরেক মাফিয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা শফি। বন্ধ রয়েছে তার মুঠোফোন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনির। এরপর রাজধানীর মৌচাকের একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ নেন। সেই সূত্রেই মনিরের পরিচয় হয় চোরাকারবারি ও লাগেজ পার্টির সদস্য সোনা শফির সঙ্গে। 

সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সুরত মিয়া নামে এক ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি মদ্যপ অবস্থায় অসংলগ্ন আচরণ করেন। তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তার পেটে কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় তিন কাস্টম কর্মকর্তাকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় অভিযুক্ত কাস্টম কর্মকর্তাদের পক্ষে আদালতে সাক্ষী হন শফি। জনশ্রুতি আছে সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে শফিকে স্বর্ণ চোরাচালানে সহায়তা দেন কিছু অসাধু কাস্টম কর্মকর্তা। গড়ে উঠে শফি-মনিরের স্বর্ণ চোরাকারবারের সিন্ডিকেট।

ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে কোটিপতি হয়ে যান মনির ও শফি। শুরু করেন মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার। শফির নাম হয়ে যায় সোনা শফি আর মনির হয়ে যান গোল্ডেন মনির। এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মনির ও শফি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের ভোল পাল্টে এই দলে যোগ দেন। নির্বিঘ্নে টাকা পাচার করতে ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে সিভিল এভিয়েশনে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করান শফি। টানা তিন বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলের ইজারাদার ছিল শফির এই প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবনের অন্যতম মালিকও এই শফি ও মনির। নামে বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক এই শফি পরবর্তী সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শফি উত্তরখানের কাচকুড়া বেতাগী গ্রামের মৃত হাজী ফজন উদ্দিনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে উত্তরার দুই থানায় কয়েকটি মামলা রয়েছে। ২০১৬ সালে স্থানীয় কাচকুড়া কলেজের এক শিক্ষিকাকে হয়রানি করেন শফির ফুফাতো ভাই শ্যামল মিয়া। এ ঘটনায় মামলা হলে কলেজের অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন মিঞাকে লাঞ্ছিত করেন শফি। ওই ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ করেন ওই অধ্যক্ষ, থানায় মামলাও হয়। তবে প্রভাবশালী শফির বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাউন্সিলর হওয়ার পর এলাকায় আরও আধিপত্য বিস্তার করে শফি।

র‌্যাবের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মনিরকে গ্রেফতারের পর নাম আলোচনায় আসতেই গা ঢাকা দিয়েছেন সোনা শফি। এর মধ্যেই মনিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শফিসহ অন্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সরেজমিন সোনা শফির এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, মনির গ্রেফতার হওয়ার পরদিন থেকে তার চেহারা দেখেননি এলাকার কেউ। গত রোববার জমজম টাওয়ারে তল্লাশি চালানোয় গা ঢাকা দিয়েছেন শফি ও ভবনটির অন্য মালিকরাও। একাধিকবার শফির মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘মনিরের অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে র‌্যাব অনুসন্ধান করছে।’

সোনা শফি-গোল্ডেন মনির সিন্ডিকেট
র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালান ও ভূমি দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন অপকর্মে গোল্ডেন মনির ও সোনা শফির বেশ কয়েকজন সহযোগীর নাম ও তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতার নামও রয়েছে। মনির-শফির সোনা চোরাচালান চক্রের অন্যতম একজন হোতা রিয়াজ উদ্দিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এর আগে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক।

এছাড়া মনির-শফি সিন্ডিকেটে রয়েছেন গুলশান-১ নম্বর ডিসিসি মার্কেটে প্রসাধনীর লাগেজ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। রয়েছেন মোহাম্মদ আলী সোনা নামে আরও একজন। এর আগে মোহাম্মদ আলী বিদেশি মুদ্রাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। এছাড়া এই সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য বাড্ডা এলাকার সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা এম এ কাইউম বর্তমানে বিদেশে পালিয়ে আছেন।

রিমান্ডেও মনিরের দাম্ভিক আচরণ
মনিরের বিরুদ্ধে চলমান তিনটি মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে। এসব মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ডে থাকা মনিরকে বর্তমানে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে মনির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তার কাছ থেকে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি তার অপকর্মের সহযোগীদেরও শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে কোনো প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন না মনির। কখনও তিনি প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন আবার কখনও নিজের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। এত অল্প সময়ে বিশাল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কারা সহযোগিতা করেছেন- এই প্রশ্নের জবাবে দম্ভ নিয়ে মনির বলেছেন, ‘আমি যে কাজেই হাত দিয়েছি সবই সোনা হয়ে গেছে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপকমিশনার মো. মশিউর রহমান দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, মনিরের তিনটি মামলার তদন্তভার ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

 
Electronic Paper