কেন এমনটি হলো!
ওয়াসিম ফারুক
🕐 ১২:২৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৪, ২০২০
নানান বিষয়ের মাঝে বর্তমান সময়ে যেই বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত তার মধ্যে একটা বাংলাদেশ তথা বিশে^র অন্যতম ক্রিকেটার সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান; অন্যটি হলো আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ। দুইটার সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রবাদ তথা ধর্মান্ধতা কাজ করছে। সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়, যাকে নতুন করে পরিচিত করার কিছুই নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচিত সাকিবকে বিশে^র অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বলে গণ্য করা হয়।
বিভিন্ন সময় নানান কারণে সাকিব আলোচিত ও সমালোচিত। ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার সিরিজের দ্বিতীয় ওডিআই চলাকালীন ড্রেসিংরুমে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করায়, তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ ও তিন লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয় তাকে। জাতীয় দলের কোচ চণ্ডিত হাথুরুসিংহার সঙ্গে দুর্ব্যবহার, মাঠে অশোভনের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। জুয়াড়িদের কাছ থেকে একাধিকবার ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও তা আইসিসি বা বিসিবিকে না জানানোর অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর দু’বছরের জন্যে আইসিসি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সাকিব ভুল স্বীকার করায় তা কমিয়ে এক বছর করা হয়, বাকি এক বছরের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রয়েছে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সাকিবের সংসদ সদস্য হওয়ার খায়েশও সাকিবকে কম সমালোচনার মুখে ফেলেনি। কারণ সাকিব বাংলাদেশের একজন জাতীয় সম্পদ তাই কোনো দল বা গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করলে তখন আর তার সেই গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের বিতর্কিত নোংরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পর যে কোনো যোগ্য ব্যক্তিই তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য। সম্প্রতি সাকিব আল হাসান প্রথম যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তা হলো- ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকায় একটি কালীপূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যশোরের বেনাপোলে আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনে এক ভক্ত তার সঙ্গে সেলফি তোলার চেষ্টা করলে ভক্তের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার ঘটনায়।
একজন সেলিব্রেটিকে তার ভক্তদের জন্য অনেক সময় অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। আর পছন্দের তারকাকে কাছে পেলে তার সঙ্গে ছবি তুলতে ও অটোগ্রাফ নিতে কে না চায়! সাকিবের ওই ভক্ত সাহেদ বা অন্য বাটপাড় রাজনৈতিক পাতি নেতাদের মতো নয়; যে ভিআইপি বা ভিভিআইপিদের সঙ্গে ছবি তোলার মতো সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি নিজের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে রাষ্ট্র ধ্বংসে লিপ্ত হবে। এ ঘটনার পরে যদিও সমালোচনার ঝড় উঠেছে তার জন্য সাকিব একটিবারও কিন্তু তার ভক্তের সঙ্গে এমন কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। এরপর সাকিব কাঁকুড়গাছি পূজা উদযাপন কমিটির প্রধান উদ্যোক্তা ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতা বিধায়ক পরেশ পালের আমন্ত্রণে কালীপূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
সাকিব আল হাসান একজন বিশ^নন্দিত ক্রিকেট খেলোয়াড়। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি দল-মত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পূজার মণ্ডপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তারকাদের উপস্থিতি নতুন নয়। সাকিবের এ কালীপূজায় অংশগ্রহণ যেন তার জন্য আরেক সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ফেসবুক লাইভে এসে সিলেটের এক যুবক রামদা নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসার হুমকি দিয়েছেন। সাকিবকে সহি মুসলমান হিসেবে গণ্য করে সাকিবের কালীপূজায় অংশগ্রহণ নিয়ে অনেকেরই এক ধরনের গাত্রদাহ শুরু হয়। আর এর প্রভাবে সাকিবও নিজেকে খাঁটি মুসলমান প্রমাণের জন্য তওবা করতে হয় অর্থাৎ সাকিবকে পূজায় অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়।
স্বাভাবিকভাবেই সাকিবের উচিত ছিল ওই ভক্তের কাছে ক্ষমা চাওয়া। সেলফি তোলায় অপরাধে যার ফোন ভাঙা হয়েছে। সাকিবের এ ক্ষমা চাওয়াটা কি খুবই জরুরি ছিল? নাকি সাকিব সিলেটের ঐ উন্মাদ যুবকের রামদাকে ভয় পেয়েছেন! সাকিবের এ ক্ষমা চাওয়া প্রগতিশীল সমাজ মোটেও ভালো চোখে দেখেনি। বরং এ ক্ষমা চাওয়া উগ্রপন্থীদের আস্কারা বাড়িয়ে দিয়েছে।
অবশ্য এ গোষ্ঠীর আস্কারা বাড়ানোর ঘটনা নতুন নয়। স্বাধীনতার কিছুদিন না যেতেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের একটি অংশকে ধর্মান্ধতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। প্রত্যেক সরকারেরই সঙ্গী বা ছায়াসঙ্গী হিসেবে টিকে আছে এরা। জেনারেল জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এইচএম এরশাদের মতো সামরিক শাসকরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও স্থায়ী করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের শরিক করেন। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। তা ভেস্তে যায় শুধুই ক্ষমতা লোভের জন্য। পরবর্তী সময়ে বিএনপি জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্য জোটের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সেই লোভ কোনোভাবেই সামলাতে পারেনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে গড়া যাদের ছিল অন্যতম লক্ষ্য সেই আওয়ামী লীগও ২০০৬ সালে খেলাফতে মজলিশের প্রধান আল্লামা আজিজুল হকের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে। এ আজিজুল হকই কোনো একসময় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করেছিলেন। আজ তাদের পরবর্তী প্রজন্ম জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মাণ প্রতিরোধে আন্দোলনে নেমেছে।
ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য কী তা আজ কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না অনেকে। তাই তারা দেশে তথাকথিত আলেম নামের কিছু ধর্মব্যবসায়ীর ধর্মের অপব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মাণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বাধায় মোটেও বিস্মিত হইনি। এর আগেও তারা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে মরমি সাধক লালন ফকিরের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে দেয়নি। তাদের আন্দোলন ও হুমকিতে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে গড়া ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি অপসারণ করতে বাধ্য হয় সরকার। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে পাওয়া বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র- এমন বুকভরা আশা নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ ভেবে দলমত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিকামী মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়। তাদের জীবন ও ত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। কিন্তু আমাদের সেই স্বাধীনতা অঙ্কুরেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় নির্লজ্জ ক্ষমতালোভীদের কাছে। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিই তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তথা ধর্মব্যবসায়ীদের দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে।
তাই আজ তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা দিতেও পরোয়া করছে না। কারণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলাম বা চরমোনাইর পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য এমনকি কারও কারও সঙ্গে জোট গড়তেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাই বিভিন্ন সময় সরকার তাদের বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের টুঁটি চেপে ধরার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তারই ফলে আজ সাকিব আল হাসানকে পূজায় অংশগ্রহণের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়, জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলন হয়। হয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো ধর্মীয় উৎসবে যোগদানে বাধা দেবে মৌলবাদী গোষ্ঠী।
ওয়াসিম ফারুক: কলাম লেখক
[email protected]