ইয়াবার ছোবলে দেশ
কাজী সুলতানুল আরেফিন
🕐 ১১:২০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০২০
ইয়াবা আর ইয়াবা কারবারি দেশে এখন শীর্ষ আলোচনার বিষয়। বড় বড় চালান ধরা পড়েছে। এত চালান আর কারবার দেখে বোঝা যাচ্ছে, দেশে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যাও কম নয়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, বিমানবন্দর দিয়ে অন্য ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা রপ্তানি করার সময় ইয়াবার চালান ধরা পড়া!
মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আমাদের আগামী প্রজন্ম। আপাতদৃষ্টিতে ইয়াবাকেই বড় সন্ত্রাস মনে হচ্ছে। এ ইয়াবা নিয়ে কম ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে না। ইয়াবা দিয়ে নেশা দেশে চলছে। বাণিজ্য করে কেউ কেউ আকাশসমান সম্পদ গড়ে তুলছে। আবার এ ইয়াবা দিয়ে নিরীহকে ফাঁসানো হচ্ছে। ইয়াবার নামে ক্রসফায়ার বাণিজ্যের অভিযোগও পুরনো। অনেক আইনের লোক এ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সীমান্ত দিয়ে আমাদের দেশে ইয়াবা প্রবেশ করে। সম্প্রতি কক্সবাজারে সমুদ্রের ট্রলার থেকে তের লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। দেশে প্রায় সব সময় এ রকম ইয়াবার চালান ধরা পড়তে দেখা যায়। তবে যা চালান হয় তার অতি সামান্য! ইয়াবা একধরনের নেশাজাতীয় ট্যাবলেট। এটি মূলত মেথঅ্যাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইন এর মিশ্রণ। কখনো কখনো এর সঙ্গে হেরোইন মেশানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি খাওয়ার বড়ি হিসেবে সেবন করা হয়, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধাতব ফয়েলে পুড়িয়ে ধোঁয়া হিসেবেও এটিকে সেবন করা হয়ে থাকে। মাদকটি থাইল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয় এবং পাশর্^বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে এটি চোরাচালান করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এ মাদকের বিস্তার ঘটেছে।
দেশে অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধেও এ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। ইয়াবা ছোট হওয়ায় তা বহনে সুবিধা হয়। তাই এটি কারবারি এবং সেবনকারীর নিকট অন্যান্য নেশা দ্রব্য থেকে জনপ্রিয়।
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, টেকনাফে একটি ইয়াবা বড়ি ৫০ থেকে ৭০ টাকায় কেনাবেচা হয়। ঢাকায় পাঠানোর পর দাম হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। লাভ অনেক বেশি হওয়ায় ওজন মেপে নয়, সংখ্যার পরিমাপের ভিত্তিতে ইয়াবা পরিবহনের ভাড়া ঠিক হয়। এক লাখ ইয়াবা বড়ি টেকনাফ থেকে ঢাকায় পাঠানোর খরচ সাত থেকে আট লাখ টাকা। ইয়াবা পরিবহনের লেনদেন নগদে হয় না। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হয়। ইয়াবা কারবারের সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রথমত তারা নিরীহ কাউকে ফাঁসিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ইয়াবাকে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি ক্রসফায়ার বাণিজ্য শুরু করেছে ইয়াবাকে কেন্দ্র করেই। মাদক ব্যবসা বিস্তারের জন্য হচ্ছে খুনখারাবি। বখে যাচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। অনেক পরিবারের স্বপ্ন ধ্বংস হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে মেধা। ধ্বংস হচ্ছে জাতি। এখন কথা হচ্ছে, দেশে ইয়াবার কারবার বন্ধ করানো যাচ্ছে না কেন? কিংবা সেবন বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন? এত এত ইয়াবা কারবারিকে যদি ক্রসফায়ার দেওয়া হয়, তবুও ইয়াবা কারবারি না কমে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে কেন? কেন কেউ এ বাণিজ্য বন্ধ করতে পারছে না? কোন জায়গায় আমাদের ঘাটতি আছে তা ভেবে দেখা দরকার।
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, উদ্ধার হওয়া মাদকের এই সংখ্যা বিক্রি হওয়া বড়ির মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড়শ’ টাকা দাম হিসেবে)। এ টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে। এখন চিন্তা করলে আঁতকে উঠতে হয়, আর কত পরিমাণ ইয়াবা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কিংবা সেবনকারীদের হাতে চলে যাচ্ছে!
হিসাব করে দেখা গেছে, ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ (২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিজিবির বাজেট ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক। ইয়াবা চক্র লুটে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। আর্থিক, সামাজিক, মানবিক নানাভাবে ইয়াবার আগ্রাসন দেশজুড়ে ছড়ালেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ সামান্য। ইয়াবা বন্ধে মাদকদ্রব্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ছাড়া আর কোনো তৎপরতা নেই। অন্য বাহিনীগুলোর তৎপরতা শুধু উদ্ধারের ভিতরেই সীমাবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৯ জানুয়ারি পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মাদক নির্মূলের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইয়াবা পরিবার ও সমাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এ ইয়াবা সন্ত্রাসের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে আলাদাভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। দরকার হলে আলাদা জনবল নিয়োগ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সীমান্ত পাহারা। এ সীমান্তে যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায় তবে সিংহভাগ ইয়াবা কারবার রোধ করা সম্ভব।
পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ যে সকল প্রভাবশালী এ ব্যবসায় মদদ দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। জাতিকে এখনি ইয়াবা থেকে মুক্ত করতে না পারলে অচিরেই কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। আসুন, সবাই একযোগে ইয়াবার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলি। যুদ্ধ ঘোষণা করি মাদকের বিরুদ্ধে।
কাজী সুলতানুল আরেফিন
কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]