ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুর্গতিনাশিনী

রূপম চক্রবর্ত্তী
🕐 ১২:১৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২০

তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে

এসো গন্ধে বরণে, এসো গানে।

এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে

এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে,

এসো মুগ্ধ মুদিত দু’নয়নে।

তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।

শ্রী মায়ের আগমনী ধ্বনিতে হৃদয়ে উষ্ণ শিহরণ জাগে। প্রাণে প্রাণে আনন্দের দোলা লাগে। ছুটে চলে সবাই মায়ের শ্রী চরণে অঞ্জলি দিতে। শ্বশুরালয় থেকে মেয়ে আসবে বাপের বাড়িতে। তাই সকলের মুখে হাসি হাসি রব। পাড়াপ্রতিবেশীর সত্তায় একটিই আকুতি কখন শারদ প্রভাত আসবে। কারণ তারা তাদের মেয়েটিকে শিউলি ফুলের মালা গেঁথে পরাবে। বার্তা প্রেরকের ভূমিকায় শুভ মহালয়া আসে। বাপের বাড়িতে শুরু হয়ে যায় প্রেমানন্দের সমারোহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-

আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ আমরা

গেঁথেছি শেফালি মালা।

নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে

সাজিয়ে এনেছি ডালা।

এসো গো শারদ লক্ষ্মী, তোমার

শুভ্র, মেঘের রথে।

যে মেয়েটি আসবে তিনি মা জগৎজননী। অসুরবিনাশিনী শক্তিদায়িনী বরদাত্রী দেবী দুর্গা। যে অসুর প্রতিনিয়ত আমাদের দুর্গতি প্রদানে সচেষ্ট থাকে সে দুর্গম অসুরকে মা বধ করেন তার অপার্থিব করুণায়। দুর্গম অসুরের দুই রূপ- ১. স্বার্থান্ধতা। প্রতিটি মানুষ সংসার বন্ধনে আবদ্ধ। সংসারের ঘূর্ণিপাকে মানুষ ঘুরতে ঘুরতে হয়ে পড়ে স্বার্থান্ধ। স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারকল্পে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিলিয়ে দিয়ে হিংসার দাবানলে নিজেকে দহন করতে থাকে। কেউবা চায় অন্যজনকে ছোট করে নিজেকে বড় করতে আর কেউবা চায় পরের সম্পত্তি দখল করে নিজেকে কোটিপতি করতে। কেউবা চায় আপনজনকে জুলুম নির্যাতন করে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা। আমরা পূজো বাড়িতে যখন যাই তখন দেখি মায়ের পদতলে বিজিত মহিষাসুর। ‘মহীং ইষ্যতি’ ইতি মহিষ। যে মহীকে অর্থাৎ জগতকে উগ্রভাবে কামনা করে সে মহিষ। মহিষবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ জাগতিক ভোগ, সুখ ও আনন্দ লাভের জন্য জগৎকে উগ্রভাবে কামনা করে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভিতরের পশুশক্তির প্রাদুর্ভাবের কারণে সে দুঃখ ভোগ করে। মা সেই পশুশক্তি স্বরূপ স্বার্থান্ধতা নামক দুর্গম অসুরের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন বলে তিনি দুর্গা। মা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এসে ভক্তদের রক্ষা করে চলেছেন। দেবী ভাগবতে আছে-

সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিণী

রূপং বিভর্ত্যরূপা চ ভক্তনুগ্রহেতবে

সেই সচ্চিদানন্দরূপিনী মহামায়া পরাশক্তি অপরূপা হয়েও ভক্তদের কৃপা করার জন্য রূপ ধারণ করেন। মা এত করুণাময়ী কেউ তাকে সকামভাবে ডাকুক অথবা নিষ্কামভাবে ডাকুক সে মায়ের কৃপা অবশ্যই লাভ করবে। সেই দেবীই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন ও তার দ্বারাই এই জগৎ মায়ামুগ্ধ হয়। তাকে নিষ্কামভাবে আরাধনা করলে তিনি অযাচিতভাবে তত্ত্বজ্ঞান দান করেন এবং তাকে সকাম উপাসনা দ্বারা পরিতুষ্ট করলে তিনি ঐশ্বর্য প্রদান করেন। অযাচিত তত্ত্বজ্ঞান লাভের মাধ্যমে আমরা নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা স্বার্থান্ধতাকে দূর করতে পারি।

২. অবিদ্যা : দুর্গম অসুরের দুই রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথমে স্বার্থান্ধতার কথা বলেছি। এবার অবিদ্যার কথা বলব। দুর্গম যখন অবিদ্যার অধীন হয় তখন মায়ার গহ্বরে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে। মায়ামুগ্ধ জীব ভাবে পৃথিবীর সবকিছুই তার। সে চিরদিন বেঁচে থাকবে। যা ভোগ করতে ইচ্ছা করে সে চেষ্টা করে তা ভোগ করার জন্য। অজ্ঞান বা মায়া দ্বারা আমাদের প্রকৃত জ্ঞান আবৃত থাকে। মায়া শক্তির কারণে জীব আমি কর্তা, ভোক্তা ইত্যাদি কল্পনা সৃষ্টি করে সংসার মোহে হাবুডুবু খায়। পরমপুরুষ শ্রী কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন-

‘ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমঃ।

মায়য়াহপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ ॥’ (গীতা ৭/১৫)।

[পাপ কর্মপরায়ণ বিবেকশূন্য নরাধমগণ মায়া দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া অসুর স্বভাবপ্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না]।

 নিজের অস্তিত্ব বিনাশী অবিদ্যা রূপ মায়াকে যিনি ধ্বংস করেন তিনি জগৎজননী মা দুর্গা। মা হচ্ছেন অভীষ্টদায়িনী। তিনি পরমা ইচ্ছাশক্তি। মানুষের মধ্যস্থিত আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করে মুক্তি পথের সন্ধান দেন মা জগৎজননী। আমাদের মতো ব্যক্তিদের মায়ার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। মায়ার কাজ হচ্ছে যারা ধর্মবিমুখ তাদের প্রতিনিয়ত আবদ্ধ করা। শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে-

‘কৃষ্ণভুলি সেই জীব অনাদি বহির্ম্মুখ।

অতএব মায়া তারে দেয় সংসার দুঃখ ॥

কভু স্বর্গে উঠায় কভু নরকে ডুবায়।

দণ্ড্য জনে রাজা যেন নদীতে চুবায় ॥’ (চৈ: চ: মধ্য ২০)। 

যা হোক, দুর্গম অসুরের কথা বলতে গিয়ে স্বার্থান্ধতা এবং অবিদ্যার কথা বিশ্লেষণ করেছি। মাতৃপূজায় আমাদের প্রার্থনা থাকবে এ দুটি অসুরকে বিনাশ করে ধর্মপথে অথবা ইষ্টপথে নিজের জীবনকে যেন পরিচালিত করতে পারি। কেননা মানবজীবনে অর্থের বা বিত্তের প্রাচুর্য থাকতে পারে কিন্তু সে অর্থ যদি সঠিকভাবে বণ্টিত না হয় তাহলে সুন্দর জীবন গঠন করা যাবে না। বণ্টন করার গুপ্ত রহস্য ধর্মই সন্ধান দিতে পারে। ধর্মীয় অনুশাসনবাদ মানুষের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেয়। ধর্মীয় আচরণের তাত্ত্বিক দিকগুলো আমরা গুরুর কাছ থেকে শিখতে পারি।

অন্যদিকে আমরা যখন দুর্গাপূজা করি, কালীপূজা করি, সরস্বতীপূজা করি তখন খেয়াল রাখব পূজোর ভিতরের রহস্যগুলো নিজের জীবনে যেন অধিষ্ঠিত করতে পারি। ধরুন, পূজো করতে বসলাম কিন্তু দেখা গেল আমরা ভক্তি করে মায়ের শ্রী চরণে নিজেকে অঞ্জলি দিতে পারলাম না। তাহলে কি আমরা সঠিকভাবে পূজা করেছি? সমাজে অনেক লোক পাওয়া যাবে যাদের মধ্যে কেউ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য বা আত্মপ্রচারের জন্য পূজা করছেন।

যে পূজাগুলোর মধ্যে রাজসিকতা ও তামসিকতায় ভরা। একবার আমি চট্টগ্রাম শহরের একটি নামকরা পূজোবাড়িতে তন্ত্রধারকের কাজ করেছিলাম। আমি দেখলাম জগৎ অধিশ^রী মা দুর্গা দেবীর পূজা হচ্ছে অথচ কোনো একজন মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না একটু উলুধ্বনি করার জন্য। ব্রাহ্মণ পূজো করছেন, তাকে সাহায্য করার জন্য কোনো ব্যক্তি নেই। আমরা যদি প্রকৃত ভক্ত হয়ে উঠতে না পারি তাহলে মাতৃ কৃপা থেকে বঞ্চিত হব। হিংসা ও অহমিকার প্রচণ্ড আঘাতে জর্জরিত সনাতন সমাজকে সাত্ত্বিক পূজা করে মাতৃকরুণা লাভ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। মহাদেবী বলেছেন,

ন তেষাং দুষ্কৃতং কিঞ্চিদ্দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ।

ভবিষ্যতি ন দারিদ্রং ন চৈবষ্ট বিয়োজনং ॥ [৫/১২] 

যে আমার উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য ভক্তি সহকারে পাঠ করিবে, তাহার কোনো পাপ বা পাপজনিত বিপদ হইবে না। ঋষি মেধস, শ্রোতা সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যকে দেবীর চরণে শরণাগতি গ্রহণ করিতে বলিলেন।

‘তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম।

আরাধিতা সৈব নৃনাং ভোগন্বর্গাপবর্গদা ॥’

[দেবী মাহাত্ম্যম্- ৩]

সেই পরমেশ্বরীর শরণাগত হও। তাহাকে আরাধনা করিলে তিনি মনুষ্যদিগকে ভোগ, স্বর্গ দান করিয়া থাকেন। নিজের পরমার্থিক মুক্তির লক্ষ্যে আমরা শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে মায়ের কাছে আত্মনিবেদন করব। পাশাপাশি দুর্গাপূজার মূল শিক্ষা সর্বজনীনতাকেও আমাদের গ্রহণ করতে হবে যাতে পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হই। সুন্দর পরিবার, সমাজ নির্মাণের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ভাষায়,

‘বাঁচতে নরের যা যা লাগে

তা তা নিয়ে ধর্ম জাগে।’

প্রত্যেক পূজার্থীর জীবন সুন্দর হোক। শুভ শক্তির জয় হোক এ প্রত্যাশা। 

রূপম চক্রবর্ত্তী : সনাতন ধর্মীয় বক্তা ও গ্রন্থ প্রণেতা

[email protected]

 
Electronic Paper