দালালচক্রের দখলে বারডেম
তুষার আহসান
🕐 ১০:০১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০২০
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এখন দালালচক্রের দখলে। ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রমোশন অফিসারের (এমপিও) নামে সক্রিয় এসব দালালচক্রকে অনেকটা নিয়ম করেই বৈধতা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডাক্তার পরিদর্শনে তাদের দেওয়া হয়েছে পাস-কার্ড। আর সেই কার্ড দেখিয়ে এমপিওরা হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে বহির্বিভাগ, ওয়ার্ড, বিশেষজ্ঞ চেম্বার দাপিয়ে চলছেন। যদিও সেই কার্ডের মেয়াদ গত মে মাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। এরপরও মাথাব্যথা নেই হাসপাতাল প্রশাসনের। অভিযোগ আছে ডাক্তার পরিদর্শনের নামে এসব এমপিওরা জ্বালাতন করেন রোগীদের। আবার ডাক্তারদের দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা রোগীদের জন্য লিখিয়ে নিয়ে দেখিয়ে দেন প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখান থেকেও তারা কমিশনের নামে হাতিয়ে নেন টাকা। আর তার ভাগ চলে যায় কর্তৃপক্ষের স্তরে স্তরে। বারডেম প্রশাসনের গোপন আঁতাতেই নাকি চলছে সব। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের ডিরেক্টর জেনারেলের (ডিজি) নাম ভাঙিয়েও কেবিন বুকিং থেকে প্রতি পদেই চলছে অনিয়ম। এদিকে হাসপাতালের টেন্ডার নিয়েও উঠেছে নানান অনিয়মের অভিযোগ। ই-টেন্ডার চালু না করে চলছে মান্ধাতার নিয়মেই। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল প্রশাসন।
সরেজমিন দেখা যায়, ১২ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে হাসপাতালের ১৪৪ নম্বর কক্ষে পিপিই পরে বসে আছেন ডাক্তার। রোগী ভর্তির বিষয়ে খোঁজখবরের জন্য সেখানে হাজির প্রতিবেদক। কথাবার্তার ফাঁকে এলেন একজন। মুখে মাস্ক, সঙ্গে রয়েছে বারডেম কর্মীর পরিচয়পত্র। অনেকটা নির্দেশের সুরে এক ডাক্তারকে ডিজির নামে দুটো কেবিন রাখতে বলেন। চার্টে দেখে কাগজে দুটো কেবিনের নম্বর টুকে রাখলেন। অথচ ভর্তির জন্য টাকার বিনিময়ে আগাম বুকিং দেওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন সিস্টেম হাসপাতালে নেই।’ ডিজির রেফারেন্সে তাহলে বুকিং কেন, প্রশ্নে তিনি বললেন, ‘এসব বিষয়ে আপনাকে না জানলেও চলবে।’ সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি শুধুই নির্দেশ মেনেছি।’ যে ব্যক্তি নির্দেশ দিয়ে গেলেন তার নাম-পদবি ও তার নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। পরের দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দোতলার ১৩২ নম্বর বিশেষজ্ঞ চেম্বার, নিচতলার ১৩৮ নম্বরের আশপাশে অন্তত তিনটি চেম্বারের সামনে দেখা যায় এমপিওদের ভিড়। সবার পকেটেই আইডি। কিন্তু দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী ও হাসপাতাল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন দেখেও দেখছেন না। আবার কয়েকজনকে টেস্ট করানোর জন্য রাজধানীর নামিদামি দুটি হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কথাও বলা হয়।
কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির এমপিওদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের নাকি পাস আছে। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, কারা এমপিও দেখে বোঝা কঠিন। রোগীর স্বজন সেজে ঢুকে পড়েন এমপিওরা।’ এ বিষয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের ইনচার্জ মো. সেলিম খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তবে কোনোভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয়েই তাদের কোনো গোপন যোগাযোগ নেই।’
এদিকে করোনার কারণে আটকে যাওয়া বারডেমের বার্ষিক টেন্ডার নিয়ে গতকাল বুধবার মিটিং হয়। এর আগের দিন টেন্ডার ওপেন করা হয়। ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার আগের টেন্ডার ঘিরেও রয়েছে নানা অভিযোগ। এবার কী হতে যাচ্ছে তা বলতে চায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে টেন্ডার কার্যক্রম শেষ হলে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন চলতি দায়িত্বে থাকা যুগ্ম পরিচালক ডা. নাঈমুল ইসলাম। এমপিওদের দৌরাত্ম্য, দালালি, তাদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের গোপন আঁতাত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘প্রতিদিন ওষুধের নতুন নতুন মলিকিউল আসছে। সেগুলো ডাক্তারদের জানা দরকার। এমপিওরা সেটাই করেন। তাই এমপিওদের নিয়ম করে বেলা একটার পর ডাক্তার ভিজিটের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে তা করোনাকালীন সময়ের প্রথম থেকেই বন্ধ। এরপরও তারা ঢুকছে। আমরা কঠোরতার সঙ্গে তাদের রুখতে চেষ্টা করছি।’
ডিজির নাম নিয়ে কেবিন বুকিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্যটি এলার্মিনিং। তবে অভিযোগ নির্দিষ্ট করে দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ টেন্ডার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই স্বচ্ছতার সঙ্গে ওপেন টেন্ডার করে থাকি। করোনার কারণে ২০১৯-২০ এর টেন্ডার পিছিয়ে মঙ্গলবার ওপেন করা হয়েছে। বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম এইচ খানের নেতৃত্বে টেন্ডার-১ কমিটি এটা দেখভাল করে। নিয়ম মেনেই কোম্পানি মনোনিত হবে।’ ভবিষ্যতে ই-টেন্ডার প্রক্রিয়া উন্মোচনের চিন্তা চলছে বলেও তিনি জানান। এর আগে ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক ডা. এম কে আই কাইয়ূম চৌধুরীর কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ডা. নাঈমুল ইসলামের কাছে পাঠান।