ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আত্মপ্রত্যয়ে এগিয়ে চলা নারী

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ১২:৩২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০২০

‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’- নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বর্তমানে পুরুষের তুলনায় নারীও কোনো কাজে পিছিয়ে নেই। যদিও কয়েক দশক আগে কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু এখন নারীরা ঘরেবাইরে সব ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত করছেন। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন নারীকে নিয়ে আজকের আয়োজন। সম্পাদনা করেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

উদ্যোক্তা নাসরিন সুলতানা
১৯৮৭ সালে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন নাসরিন সুলতানা। বাবা মিজানুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী ও মা ফেরদৌসী বেগম গৃহিনী। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন নাসরিন। এরপর মাত্র কয়েক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে অপরূপা বিউটি পার্লার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে অপরূপা বিউটি পার্লার অ্যান্ড বুটিকসে রূপ নেয়। তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি বাটিক থ্রি-পিস, ব্লক থ্রি-পিস, হ্যান্ডপ্রিন্ট, ওড়না, ওয়ান পিস, শিশুদের পোশাক, বেডশিট, শাড়ি ও উপহার সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেশ-বিদেশে। এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন প্রায় ১৫ জন নারী।

তার এ সফলতার পেছনে রয়েছে তার নিজের পরিশ্রম এবং এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। পথে পথে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে নাসরিন সুলতানাকে। তবে কখনও দমে যাননি তিনি। নিজের মেধা, মননশীলতা, কর্মনিষ্ঠা এবং একাগ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। নাসরিন সুলতানা বলেন, শুরুটা আসলে নিজের ছোটবেলার ইচ্ছা থেকে। আমার মা কাপড়ের হাতের কাজ অনেক ভালো পারতেন। মায়ের কাছ থেকেই হাতের কাজ করা শিখি। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকলেও আমার মনে হয় যে ঘরে বসে থাকার চেয়ে কিছু করলে ভালো হয়। তাই হাতের কাজ করার জন্য প্রথমে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে বাজার থেকে কিছু থ্রি-পিস ও সুতা কিনে আনি।

পরে সেগুলোতে নিজেই কাজ করি এবং আশপাশে বিক্রি করে দেই। দেখা যায় যে ক্রেতাদের চাহিদা বেশ ভালো এবং তারা পোশাক পরার পর অনেকে প্রশংসাও করতেন। ক্রেতাদের চাহিদা ও প্রশংসা দেখে আমার মনোবল এবং কাজ করার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। পরে আমি হাতের কাজ ছাড়াও বিভিন্ন কাপড় তৈরির উপর প্রশিক্ষণ নিই এবং কাপড় তৈরির কাজ করতে থাকি।

এভাবে কাজ করে সামান্য আয় হতে থাকে। এ আয়ের থেকে টাকা জমিয়ে পাইকারিতে ওয়ান পিসহ বিভিন্ন কাপড় কিনে এনে হাতের কাজ করতে থাকি। পরে কয়েকজন কর্মী নিয়োগ দিই। চুক্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্ডার নিয়ে তা তৈরি করে দিতাম। অর্ডারের মালামাল নিখুঁতভাবে এবং সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতাম। এতে আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে, পাশাপাশি বেশ অর্ডারও পেতে শুরু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার এবং ব্যবসার প্রসার আরও বাড়তে থাকে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে আমি ব্যবসার কার্যক্রম শুরু করি। বর্তমানে ব্যবসার পরিসর খুব বেশি না হলেও অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ভালো পর্যায়ে যেতে পেরেছি। দিন দিন ব্যবসার পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে আমি অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বাবলম্বী। তাছাড়া অনেকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে ২০ জন নারীকর্মী কাজ করছেন। আমার মাসিক আয় প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এবং বিদেশে পণ্য সরবরাহ করি। এছাড়া পণ্যের প্রচার ও প্রসার এবং বিক্রির জন্য বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত মেলায় অংশগ্রহণ করি। আমি চাই আমার ব্যবসার আরও প্রসার হোক। সাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার স্বার্থকতাটাই আলাদা। তাই বলবো, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হবে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, তবে ইচ্ছা থাকলে তা অতিক্রম করা সম্ভব।

কাপাসিয়া (গাজীপুর)

অভাব ঘুচিয়ে সচ্ছল খাদিজা
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের নুরনগর তালপট্টি গ্রামটি চরাঞ্চল হওয়ায় কামারখন্দ উপজেলার সদর থেকে অনেক দূরে। বন্যার সময় তাদের চলাচল করার একমাত্র ভরসা নৌকা। এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকাজ, মাছ ধরা ও গৃহপালিত পশু গরু, ছাগল পালন করে থাকে। সঠিক পরিকল্পনা আর ইচ্ছাশক্তি থাকলেই জীবনের সফলতা সম্ভব সেটি প্রমাণ করেছেন নুরনগর তালপট্টি গ্রামের বরাত আলীর স্ত্রী খাদিজা বেগম (২২)।

ছাগল পালনের বিক্রির টাকা দিয়েই চলে তাদের সংসার ও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। কয়েক বছর আগেও খুব কষ্টে দিন পার করেছেন বরাত আলী। কাজ থেকে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়েছে। এরপর কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে ছাগল পালন করা শুরু করেন তার স্ত্রী খাদিজা বেগম। ছাগল পালন খুবই লাভজনক ব্যবসা, যা থেকে সহজে সাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহযোগিতা ও মোটা অঙ্কের পুঁজি নিয়ে খামার করতে পারলে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন স্ত্রী খাদিজা বেগম।

তিনি বলেন, আমাদের চর এলাকায় খামার করার জন্য অনেক জায়গা আছে। আমরা শুধু মোটা অঙ্কের টাকার অভাবে ছাগল বা গরুর খামার দিতে পারছি না। আমাদের চরাঞ্চলে যদি সরকার অল্প সুদে বেশি ঋণ দিত অথবা টাকা দিয়ে সহযোগিতা করত তাহলে আমাদের এলাকায় যারা বেকার যুবক রয়েছে তাদের বেকারত্ব দূর হবে। একইসঙ্গে চর এলাকার সবাই সাবলম্বী হবে।

খাদিজা বেগম বলেন, বিয়ের পরে বাপের বাড়ি থেকে দুটি ছাগল নিয়ে স্বামীর বাড়িতে পালন করতে থাকি। স্বামী কৃষিকাজ করেন। তবে যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টকর। পরে বাপের বাড়ি থেকে ছাগল নিয়ে এসে পালন করা শুরু করি। ছাগলগুলোকে নদীর ধারের কাঁচা ঘাস, বিভিন্ন গাছের পাতা খাওয়ানো হয়। তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর প্রতিটি ছাগল ৭-১০ হাজার টাকা করে বিক্রি করি অর্থাৎ বছর শেষে ৪০-৪৫ হাজার টাকা আয় করি। কিছুদিন আগেও ২৫ হাজার টাকার ছাগল বিক্রি করা হয়েছে।

এখনও আমাদের আটটি ছাগল আছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৫৫-৬০ হাজার টাকা। কামারখন্দ উপজেলা উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. গোলাম হোসেন জানান, নিবন্ধিত ছাগলের খামারে সংখ্যা প্রায় ২৬টি। এছাড়া ১৫০টি পরিবার প্রায় এক হাজার ছাগল পালন করছে এ উপজেলাতে। তবে যার যার প্রয়োজন মোতাবেক অফিস থেকে সেবা প্রদান করা হয়। যারা ছাগল পালন করে তাদের বিনামূল্যে টিকা, পাতলা পায়খানার ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে আমাদের মাঠ কর্মীরা সার্বিকভাবে তাদের সহযোগিতা করেন।

আলমগীর কবির, সিরাজগঞ্জ

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিপা
করোনার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কর্মকা-ে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এমন সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে অনলাইন বা ই-কমার্স বিজনেসের। বাংলাদেশের কিছু তরুণ উদ্যোক্তা ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্র্যময় স্বদেশী পণ্য নিয়ে অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্মে এসে নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেছে। বিশেষত নারীদের জন্য তেমনই একটি প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম। যা মূলত উই নামে পরিচিত। সবাই এখন প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম থেকে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তেমনই একজন উদ্যোক্তা নিপা সেনগুপ্ত (২২)। তিনি উইতে চলতি বছরের ১৪ জুন যুক্ত হন। উইয়ের কর্নধার রাজীব আহমেদ ও নাসিমা আক্তার নিশা কাছে ই-কমার্সে হাতেখড়ি নিয়ে নিপা কাজ শুরু করেন বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী যবের ছাতু ও যবের আটা নিয়ে। যব বিলুপ্তপ্রায় কৃষি পণ্য এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই উই গ্রুপে ভালো সাড়া আসতে থাকে।

নিপা সেনগুপ্ত ই-কমার্সে কাজ শুরু করেন মাত্র ৫০০ টাকা মূলধন নিয়ে। উই গ্রুপের নিয়ম মেনে চলতে থাকে পরিচিতি বাড়ানোর কাজ। পাশাপাশি অল্পবিস্তর অর্ডার প্রাপ্তি। আস্তে আস্তে পরিচিতি বৃদ্ধি হতে থাকে। আসতে থাকে পজেটিভ রিভিউ। এরপর কাস্টমারের চাহিদার উপর ভিত্তি করে পণ্যের তালিকায় যুক্ত করেন যব, গম, চাল, মসুর ও ছোলার সংমিশ্রণে পঞ্চ-ব্যাঞ্জন ছাতু। এটাও এ অঞ্চলের ঐতিত্যবাহী খাবার। এরপর ধীরে ধীরে একে একে তার পণ্যের তালিকায় যুক্ত হতে থাকে ভেজালমুক্ত আখের গুড়, পাবনার ঘি, গমের লাল আটা, দেশী ধানের চাল, মৌসুমী আচার, দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ফলের গাছ।

উইতে যুক্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সকল পণ্য মিলিয়ে নিপা সেনগুপ্তের আয় হয়েছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার টাকারও উপরে। এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপে পরিচিতিও বেড়েছে। এ বিষয়ে সফল তরুণ নারী উদ্যোক্তা নিপা সেনগুপ্ত বলেন, আমি অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। পাঁচটি পরীক্ষাও শেষ হয়েছিল। এর মধ্যেই করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আর আমিও বাসায় বন্দি হয়ে গেলাম। সারাদিন বসে বসে দিন কাটছিল। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে উই গ্রুপে যুক্ত হই। প্রথমেই একটি ভালো লাগা তৈরি হয়। আস্তে আস্তে রাজীব স্যার ও নাসিমা আক্তার নিশা ম্যামের দিক-নির্দেশনাগুলো ফলো করতে শুরু করলাম।

নিজের প্রতি একটা বিশ্বাস তৈরি হলো। আমার স্বামীর সহযোগিতায় রাজশাহী অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী যবের ছাতু নিয়ে কাজ শুরু করা। কিন্তু ভাবিনি এই ছাতু নিয়েই আমি লাখপতি হতে পারব। বর্তমানের উই থেকে আমার সেল প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার টাকারও উপরে। আরো অনেক অর্ডার হাতে আছে বলে উল্লেখ করে নিপা সেনগুপ্ত উই গ্রুপের সকল সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সকল নারীর নিজের একটি পরিচয় সব সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উই গ্রুপের সবাই সবাইকে সহযোগিতা করছে। নিপা সেনগুপ্তের কাজের সঙ্গে এ অঞ্চলের দুজন প্রান্তিক নারী যুক্ত হয়ে নিজে আয়ের মাধ্যমে পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারছেন। তেমন এক নারী রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের আবেদা বেগম (৪৮)।

তিনি বলেন, নিপা সেনগুপ্ত বাজার থেকে যব কিনে আমাদের কাছে দেন। আমরাও যবগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে বালুতে ভেজে দিই। এজন্য আমরা নিয়মিত টাকাও পাই। যা দিয়ে আমাদের সংসারের অনেক উপকার হয়। আমরা বাড়তি আয় করতে পারি। উই গ্রুপ থেকে নারীদের একটি পরিচয় তৈরি হচ্ছে যা আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে বলেও উল্লেখ করেন এ নারী।

মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী)

শাহেনার ইচ্ছাপূরণ
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের মেঘাই গ্রামের শাহেনা পারভীন পেশায় একজন শিক্ষিকা। ২০১৪ সালে স্বামী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে দুই সন্তান নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। নিঃসঙ্গ জীবনে অনাগত দিনের দুশ্চিন্তায়। একাকীত্ব থেকে মুক্তির পথ, দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করার প্রত্যয়ে অন্তরে রোপিত স্বপ্ন পূরণে শুরু হয় পথচলা। অতঃপর দৃষ্টি দিলেন সমাজের দুস্থ অসহায় অবহেলিত নারীদের প্রতি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি শাহেনা পারভীনকে।

তিনি বলেন, আমি বিধবা। শিক্ষকতা আমার পেশা। কিন্তু সমাজে অনেক নারী আছে, কেউ বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা। তাদের জীবন জীবিকা শেয়ার করি এবং চিন্তা করি, কিভাবে তাদের অন্ধকার জীবনকে স্বনির্ভর করা যায়। ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজে আগ্রহী ছিলাম। পরবর্তীতে দুটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন হাতের কাজের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ২০ জন নারীকে নিয়ে লালিত স্বপ্নের লক্ষ্যে শুরু করি ইচ্ছাপূরণ হস্তশিল্পের কাজ। এখন প্রশিক্ষণ প্রদান করি নকশিকাঁথা, বাটিক, ফুলের কাজ, কুশি কাটার কাজ, চটের কাজ, বেতের কাজ, পাপশের কাজ এবং পণ্য তৈরি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানে ২৫০ জন নারী কাজ করছেন। আমার মূলধন এখন আট লাখ টাকা। তৈরি পণ্যগুলো স্থানীয় মার্কেটে বিক্রি হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্ডারের মাধ্যমে বিক্রি হয়। সরকারি আর্থিক সহায়তা পেলে এক হাজার অসহায় নারীকে প্রশিক্ষিত করে ব্যবসায়ী করা যেতে পারে। তার তৈরিকৃত পণ্য বিদেশে রপ্তানির আশাও আছে।

তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এখন স্বনির্ভর তাদেরই একজন নূরানী খাতুনও (৩২) স্বামী পরিত্যক্তা। এক বছর ধরে সেলাইয়ের কাজ করেন ইচ্ছাপূরণ হস্তশিল্পে। মাসে ৩৫০০ টাকা আয় হয় তার।

সাফল্য গাঁথা নারী উদ্যোক্তা শাহেনা পারভীনের ব্যাপারে কাজিপুর মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা চিত্রা রানী সাহা বলেন, ইচ্ছাপূরণ হস্ত শিল্পে তৈরিকৃত বিভিন্ন পণ্য মানসম্মত।

আমাদের জয়িতা ফাউন্ডেশনের অধীনে পণ্য বিক্রি করতে চাইলে, সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

আলমগীর কবির, সিরাজগঞ্জ

তাসলিমার সফলতা
সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী বিধ্বস্ত চৌহালী উপজেলার উমারপুর ইউনিয়নের পয়লা গ্রামের দিনমজুর শুকুর আলীর মেয়ে তাসলিমা আক্তার। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। পড়াশুনায় ভালো হলেও টাকার অভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর বিএ ভর্তি হওয়া হয়ে উঠেনি। ২০১৬ সালে ইউএসএআইডি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কেয়ার বাংলাদেশের কারিগরি সহযোগিতায় এনডিপি বাস্তবায়নাধীন সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির অতি গরিব সদস্য হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় তাদের পরিবার।

যুব ও কিশোরীদের বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেশনে তাসলিমা অংশগ্রহণ করে বাল্যবিয়ের কুফল, কিশোরীদের টিটি টিকা, আয়রন, ফলিক এসিড সেবন, কর্মমুখী শিক্ষা সম্পর্কে অবগত হন। বাবা-মা পড়াশুনার টাকার যোগান দিতে পারবেন না বলে মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মেয়ের অমতে সেটা সম্ভব হয়নি।

গত বছর সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির ১০ দিনের ছাগল পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তাসলিমা আক্তার। প্রশিক্ষণ শেষে প্রাপ্ত ৩৫০০ টাকা ও ২০০০ টাকা বাবা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গ্রাম থেকে উন্নতমানের দেশী একটি ছাগল ক্রয় করেন। এক মাসের মধ্যেই ছাগলটি তিনটি বাচ্চা জন্ম দেয়।

ছাগলগুলোকে ভিডিসি কমিটির উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে টিকা প্রদান করা হয়েছে। বন্যার সময়কালীন আরও একটি ছাগলের জন্ম হয়েছে। বর্তমানে তাসলিমার ছাগলের সংখ্যা পাঁচটি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

বন্যা পূর্ববর্তী সময়ে সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির সহায়তায় বসতভিটা উঁচু করার ফলে বাড়িতে সবজি উৎপাদন করারও সুযোগ হয়। জৈব সার প্রয়োগ করে উন্নত বীজ সংগ্রহ করে বসতভিটার খালি জায়গা সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে চালকুমড়া, ধুন্দল, পুঁইশাক, ঢেঁড়শ, বেগুন, কচু, ধান মরিচ ইত্যাদি শাক-সবজি উৎপাদন করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেও প্রায় দুই হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেন তাসলিমা আক্তার।

তিনি বলেন, আমি ছাগল বিক্রি করছি না। কারণ কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি ছাগলের একটি খামার করতে আমি এ শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। এ বছর বিএ ভর্তি হয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির এফটি গভর্নেন্স অ্যান্ড ইয়ুথ হান্নান মোরশেদ জানান, পয়লা কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাসলিমাকে। গ্রামের অন্য যুব ও কিশোরীদেরও পরিশ্রম করে সাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা চাই গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা নিজে কাজ করে সাবলম্বী হোক। আমরা শুধু সহযোগিতা করে যাব।

আলমগীর কবির, সিরাজগঞ্জ

কোহিনূরের অনলাইন নার্সারি
করোনার কারণে সারাবিশ্ব যখন থমকে গেছে, ঠিক তখন ঘরে বসে অনলাইনে নার্সারি করে সারা দেশে সাড়া ফেলেছেন যশোরের মেয়ে কোহিনূর আক্তার। একইসঙ্গে মাছ ও গাছের সমন্বয়ে নিজের ছাদকে পরিণত করেছেন ছাদ কৃষির রোল মডেলে। অনলাইন নার্সারি থেকে তিনি প্রতি মায়ে আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা।

বর্তমানে তিনি স্ট্রোবেরির চারা বিক্রি করে নেট দুনিয়ায় ব্যপক সাড়া তৈরি করেছেন। নিজের উৎপাদনের পাশাপশি তিনি অনলাইনের মাধ্যম্যে অর্ডার করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চারা সংগ্রহ করে আবার দেশের প্রত্যেকটি জেলা উপজেলাতে কুররিয়ার এবং পরিবহনের মাধ্যম্যে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ছাদ কৃষকদের হাতে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কৃষকরাও তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করছেন।

উন্নতজাতের আমেরিকান হাইব্রিড ফেস্টিভল স্ট্রোবেরির চারার চাহিদা বেশি। কোহিনূর আক্তারের বাসার ছাদের উপরে হচ্ছে হাড্রোফনিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ। সেখানে রয়েছে দেীশয় প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় সব ধরনের মাছ। তার পাশাপাশি ছাদজুড়ে রয়েছে কয়েকশ প্রকার ফল গাছ, রয়েছে ভেষজ ও হরেক করকমের ফুল গাছ। কোহিনূর আক্তার বলেন, আমার বাবা সিরাজুল ইসলাম যশোর জজ কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান তুলনা সহকারী। আমি মাস্টার্স শেষ করে সাংসারিক কাজকর্মের পাশাপাশি অনলাইনে গাছের চারাসহ পোশাক কেনা বেচা করি। শখের বসে করতে গিয়ে এখন পেশায় পরিণত হয়ে গেছে।

বাবা এবং স্বামীর সহযোগিতায় আমি বর্তমানে উন্নতজাতের আমেরিকান ফেস্টিভল স্ট্রোবেরির চারা, যেটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য উপযোগী, সেটি নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া আমি লেটুস, আইস প্লান্ট, পিটুনিয়া, জার্বেরা, গ্লাডিলিয়সসহ বেশকিছু বিরল গাছের চারা নিয়ে কাজ করছি। একইসঙ্গে এগুলোর রোপণ পদ্ধতি, পরিচর্যা, গুণাগুণ সম্পর্কেও অনলাইনে ট্রেনিং দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রোবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে।

ফল পেকে লাল বর্ণ ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হয়। স্ট্রোবেরির সংরক্ষণকাল খুবই কম বিধায় ফল সংগ্রহের পরপরই তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। ফল সংগগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে। স্ট্রোবেরির সংরক্ষণ গুণ ও পরিবহণ সহিষ্ণুতা কম হওয়ায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এর চাষ করা উত্তম।

তিনি বলেন, স্ট্রোবেরি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও বেশি দিন থাকে সেসব এলাকায় বারি স্ট্রোবেরি-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রোবেরি চাষ করা হচ্ছে। অক্টোবর থেকে নভেম্বর দুই মাস স্ট্রোবেরির চারা লাগানোর জন্য উপযুক্ত। যাদের বড় করে বাগান করার মতো জায়গা আছে তারা অনায়াসেই করতে পারেন। কিন্তু যাদের জায়গা নেই তারা চাইলে বারান্দা কিংবা ছাদে ছোট্ট পরিসরে চাষ করতে পারেন। তিনি শিক্ষিত মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন, ঘরে বসে না থেকে আপনারা প্রযুক্তির আর্শীবাদকে কাজে লাগান, তাহলে আপনি সাবলম্বি হতে পারবেন।

বিএম ফারুক, যশোর

 
Electronic Paper