করোনাকালে মনুষ্যত্বহীনতায় কান্না
আল মামুন সরদার
🕐 ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০২০
প্রকৃতির অনিবার্য সত্য মৃত্যুকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মনের কোণে ধর্মভীতি লালন করে সততার সৃষ্টি করলে এই সত্যকে পরম যতে হৃদয়ে স্থান দিতেই হবে। সাবলীলভাবে চলমান পৃথিবীর বুকে দুর্বিষহ সংকটকালীন মুহূর্তের ক্ষত সৃষ্টি হবে সেটা ছিল সবার ধারণার বাইরে। প্রকৃতির হঠাৎ রূপ পরিবর্তন নিভিয়ে দিল ক্ষমতা, বাড়িয়ে দিল হাহাকার, আবার জ্বালিয়ে দিলো আলো। পৃথিবীতে সংকটকালীন এই মহামারীতে প্রকৃতির বুকে ফিরে আসা নতুন জীববৈচিত্র্যের গল্প, তেমনি ছোট্ট এই সোনার বাংলায় চরম দুর্ভোগে পতিত হওয়া মা মাটির হাহাকার।
করোনা সন্দেহে গর্ভধারিণী মাকে ফেলে আসা, রাস্তায় গাড়ির ভিতরে সন্তান প্রসব করা মা, সন্তানকে বাঁচানোর জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় দৌড়ানো বাবা। সবই যেন নতুন এক অভিজ্ঞতার চিত্র। আর্থিক সংকটে মধ্যবিধ, কর্মহীন দিনযাপনে হতদরিদ্র, টাকার ছড়াছড়ির বিনিময়ে প্রাণ বাঁচাতে না পারা ধনিকশ্রেণি প্রকৃতির কাছে পরাজিত। প্রিয়জনের লাশের দায়িত্ব যখন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম কাছে সমর্পিত, সময়ের কাছে হেরে তখন অতীতের স্মৃতিগুলো একরাশ দীর্ঘনিঃশ্বাস।
এমতাবস্থায় কিছু দুর্বৃত্ত ও স্বার্থান্ধ মানুষ লাভের আশায় ছলচাতুরির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় বিশ^মহলে সোনার বাংলার মুখ মলিন হয়েছে। দেশজুড়ে উঠেছে নিন্দার ঝড়। সংকটকালীন মুহূর্তেও তারা এমন জঘন্য কাজ করতে দ্বিধাবোধ করল না। মৃত্যুর ভয়াবহ স্বাদটা তাদের একটুও হৃদয়কে আন্দোলিত করল না। করোনার এই ক্রান্তিকালে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া তারই বড় প্রমাণ। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে শান্তির বাতাস খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেখানে এমনই শিক্ষিত সমাজ জঘন্য দুর্নীতির নেশায় মত্ত। বিশ^মহলে প্রিয় দেশের ভাবমূর্তি তাদের আবেগকে একটুও নাড়া দিল না। তারাই আবার প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে নিজেদের দাবি করে। সুষ্ঠু রাজনীতির শিক্ষাও আমরা তাদের থেকে পাই। উপরে উপরে দেশপ্রীতি চরমভাবে তাদের মধ্যে প্রবহমান, কিন্তু ভিতরে আছে কপটতার রক্ত।
আহমদ ছফা তার লেখনীতে এ দেশের তরুণ/তরুণীকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘যে দেশে গিয়ে আমাদের মেধাবী সুন্দর চেহারার তরুণেরা বেয়ারা বা গাড়ি চালকের চাকরি পেলে জীবনকে সার্থক মনে করে, অভিজাত অপরূপ সুন্দরী তরুণীরা শিশু পাহারার দায়িত্বকে আহা কি সৌভাগ্য বলে আখ্যা দেয়!! যেই দেশটিতে যাওয়া হবে না বলে আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষ এই নশ্বর জীবনে স্বর্গ দেখা হবে না বলে আফসোস করে।’ তেমনভাবে এই দেশদ্রোহী কপটচারী মানুষগুলোও আমাদের দেশের সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে সেই রকম একটা দেশে গিয়ে নাগরিকতার ছাঁয়া পেয়ে শিকড় গেড়ে বসে। এই ধরনের মানুষদের বিরুদ্ধাচার করা মানে নিজের বিপদকে প্রসারিত করা। তাদের মাথার উপরে আছে বড় বড় ছাঁয়া। কিন্তু এরা স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকদের থেকেও মারাত্মক ভয়ঙ্কর।
হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের একটি সংলাপের অনুকরণে বলা যায়, ‘দুর্নীতির কোনো শেষ নাই, দুর্নীতি রোধের চেষ্টা বৃথা তাই।’ সংকটকালীন এই সময়ে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত দুর্নীতির করাল গ্রাসে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো বিপর্যস্ত। তেল থেকে চাল পর্যন্ত চুরির এই জঘন্য কাজ মহামারী কালীন সময়েও বহমান। ঝড়ের করালগ্রাসে তছনছ হয়ে যাওয়া হতদরিদ্র মানুষের আশ্রয়ের জন্য ঘরের অনুদান দেয় সরকার। প্রভাবশালীরা টাকা ছড়াছড়ি করে হচ্ছে তার দাবিদার। আমাদের দেখা ছাড়া আর কী বা করার!! যেখানে সরকার প্রিয় এই দেশটিকে সুস্থ রাখতে নিরালস কাজ করে যাচ্ছে, তখন মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের এই কাজগুলো সত্যিই জঘন্য কর্মকা- বললে ভুল হবে না।
করোনাকালীন এই সময়ে অপরাধের প্রবণতা একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। বিকৃত মস্তিষ্কের জন্ম দেওয়া কিছু মানুষের এসব কর্মকা-কে পশুত্বকেও হার মানায়। মনুষত্ব, বিবেক আর পারিবারিক শিক্ষার যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশ যখন সমস্ত দিক দিয়ে সমস্যার মধ্যে পতিত তখনও এমন জঘন্য কর্মকা-কে তারা সহজতর করে পুরো সমাজটাকে জর্জরিত করে তুলেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মা মাটি মানুষের নিয়ে আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নের দেশ, সমৃদ্ধ জাতিকে সম্পদে পরিণত করতে চেয়েছিলেন আজীবন। সেইরূপ স্বপ্ন আমাদের ভিতরে কি একটু নাড়া দিয়ে যায় না? আমরা কি সত্যিই তাহলে মানুষ হতে পারলাম না? নাকি মনের কোণে পশুত্বকে জায়গা দিতে দিতে পশুতে পরিণত হয়েছি। ‘মানুষের চেয়ে পশুই শ্রেয়’ এমনটা বলাই এখন যুক্তিযুক্ত।
এই সংকটকালীন মুহূর্তে সরকারের পাশাপাশি আমাদের মানবিক উন্নতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মৃত্যুকে মনে ঠাঁই দিয়ে দেশকে, দেশের মানুষের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। নইলে হারিয়ে যাবে মা, মাটি ও জাতিসত্তা। বঙ্গবন্ধুর গড়া এই সোনার বাংলাদেশ। জননী আমার প্রতিনিয়ত ক্রন্দন করবে শুধু টিকে যাবে মনুষ্যত্বহীনতা। মানুষ ফিরে আসুক আলোর পথে। পথ দেখাক অসহায় মানুষের। মানুষ আত্মপ্রীতি ভুলে দেশের কথা, জনগণের কথা ভেবে কাজ করুক। নতুন করে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে গড়ে তুলুক সুখী সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ।
আল মামুন সরদার : দ্বিতীয় বর্ষ, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়