ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান রচয়িতা

রঞ্জনা বিশ্বাস
🕐 ১২:৪৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২০

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লোক কবিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গান ও কবিতা রচনা করেছেন। সেই সব গান ও কবিতা বাংলার লোকসংস্কৃতির ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। গানগুলো গ্রামীণ সমাজের অস্তিত্বের কথা নিয়ে লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ ধারায় আশ্রয় নেয়। আর তাই এসব গানে গণঅনুভূতির বিশেষ পরিচয় উন্মোচিত হতে দেখা যায়। আধুনিক গান যখন প্রায়ই আনন্দানুভূতি ও বিনোদনের খোরাক জোগায় লোকগান তখন তার বিষয়বস্তু ও জীবনমুখিতা, জীবনসংগ্রাম নিয়ে মানুষের মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। লোকগানের এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার বিখ্যাত মনীষী ওয়াই এম সকলোভ তার দ্য রাশিয়ান ফোকলোর বইয়ে জনসাধারণের সাহিত্য-সংস্কৃতির ও প্রলেতারিয়েতদের চিন্তাপুষ্ট ফোকলোরকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিনের কীভাবে সমর্থন করেছেন তা তুলে ধরেন (ডক্টর মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর পরিচিতি এবং লোক সাহিত্যের পঠন-পাঠন, বাংলা একাডেমি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৭৬)।

এরপর থেকেই সোভিয়েত রাশিয়ায় ফোকলোর একটি বিশেষ সংগ্রাম ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং লোকগান ও সাহিত্য হয়ে ওঠে মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ নতুন প্রলেতারিয়েত ফোকলোর (ডক্টর মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭)। ম্যক্সিম গোর্কি ঘোষণা করেন, পরিশ্রমী মানুষের ক্রন্দনে সর্ব দেশের ফোকলোর চিরদিন মুখর (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭)। দেখা যাচ্ছে, গান মানুষের আনন্দ আনন্দদানের অনুষঙ্গ হলেও লোকগান তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের জীবনের বৃহত্তর সত্তার সন্ধান দিতে সক্ষম হয়। আর তাই গবেষকগণ লোকসংস্কৃতিতে বিশেষত লোকসাহিত্য ও লোকগানে মানুষের সমাজচিন্তা, ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিকধারা, মনোস্তত্ত্ব প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা দিন দিন বিস্তার লাভ করেছিল তা কোনো মনীষীর হাত ধরে নয়। এর প্রচার ও প্রসারের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন লোককবিরা। তাদের রচিত গানের মধ্য দিয়েই যে বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদমুখর ভূমিকা থেকে হয়ে উঠেছেন বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক সে কথা প্রমাণ করার জন্য ম্যাক্সিম গোর্কির মতো হারকিউলিস বা প্রমিথিউসদের প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষক বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা করলেও, নিম্নবর্গের মানুষের চেতনার তার অবস্থান নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। অথচ লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বইটির পা-ুলিপি তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি জনমানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম অবস্থান। তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধান চরিত্র করে অসংখ্য গান রচনা করেছেন। কিন্তু লোকসাহিত্যে বা গানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা নজরে আসে না। জানা মতে, এ বিষয়ে ২০২০ সালে তাম্রলিপি থেকে বের হয়েছে ড. তপন বাগচীর গানের কবিতায় বঙ্গবন্ধু, একই বছর বাংলা একাডেমি থেকে বের হয়েছে গবেষক সাইমন জাকারিয়ারের সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি। এর আগে ২০১৭ সালে রোদেলা প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে আমার লেখা লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নামক বই। এসব গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে লোককবিদের ভাবনা চিন্তা বা দর্শন সম্পর্কে যেমন আলোকপাত করা হয়েছে তেমনি ইতিহাস পর্যলোচনার ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান রচনা করেছেন চারণ কবি শেখ রোকনউদ্দিন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের মধ্যে অসংখ্য নির্বাচনী গান রচনা করেছেন। সেই গানগুলোর কণ্ঠশিল্পী এ কে এম চাঁদ মিয়ার সাক্ষাৎকার থেকে যে গানগুলোর হদিস পাওয়া যায় তার মধ্যে শেখ রোকনউদ্দিনের লেখা চারটি গানের মধ্যেই শেখ মুজিবের নামটি উল্লেখ আছে। সে কারণে রোকনউদ্দিনের লেখা গানগুলোকেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু গবেষক সুমনকুমার দাশ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান ও শাহ আবদুল করিম নামে লেখা নিবন্ধে জানান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা শাহ শাবদুল করিমের গানই প্রথম গান। একটি নিবন্ধ রচনা করেন। নিবন্ধটি ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর অন্য আলো সংখ্যায় বের হয়। নিবন্ধটিতে গবেষক বলেন- ‘শেখ মুজিবের লেখা আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে গণভোটের সময় তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিব দলবল নিয়ে সিলেট এসেছিলেন। তবে সুনামগঞ্জে তিনি প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর। সে সময় তিনি দুর্নীতি দমন, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প, পল্লীকৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ এবং সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী। ওই দিন বিকেলে শেখ মুজিব সুনামগঞ্জে আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। সে সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন শাহ আবদুল করিমও। করিম সে সভায় শেখ মুজিবকে নিয়ে স্বরচিত একটি গান পরিবেশন করেন। গানটি এমন-
পূর্ণচন্দ্র উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা
জনগণের নয়ন তারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ জাগ রে মজুর কৃষাণ।
এই গানটিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কোনো গান। ১৯৫৪ সালের দিকে রচিত এ গানের স্থায়ী অংশ পাওয়া গেলেও অন্তরার সন্ধান আর মেলে না।’

এদিকে গবেষক সাইমন জাকারিয়া তার সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি গ্রন্থে জানান, ‘করিম তার আত্মস্মৃতি শীর্ষক আত্মপরিচয়মূলক দীর্ঘ একটি বর্ণনাত্মক সংগীতের বাণীতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যখন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে তখন আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গড়ে তোলে (পৃষ্ঠা ১৫৫)।’ এরপর তিনি সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক প্রকাশিত শুভেন্দু ইমাম সংকলিত ও গ্রন্থিত শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র’র বরাত দিয়ে জানান, ‘বঙ্গবন্ধু সেই সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়ে সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সাথে সুনামগঞ্জ সফরে যান এবং জনসভায় অংশগ্রহণ করেন (পৃষ্ঠা ১৫৫-৫৬)।’ জনাব জাকারিয়া তার রচনায় উল্লেখ করেন, ‘সে সময় তিনি একটি জনসভায় শাহ আবদুল করিম গান গাইতে ওঠেন এবং ভবিষ্যৎদর্শী সাধক কবির চোখে তিনি শেখ মুজিবকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে বেঁধে একটি সংগীত পরিবেশন করেন, গানটি হলো­ পূর্ণচন্দ্র উজ্জ্বল ধরা...। (পৃষ্ঠা ৫৬)’

গবেষক সুমনকুমার দাশ ও গবেষক সাইমন জাকারিয়ারের উপর্যুক্ত বক্তব্য দুটির মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের পারস্পরিক বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে। সাইমন জাকারিয়ারের প্রদত্ত তথ্যানুসারে শাহ আবদুল করিম বঙ্গবন্ধুর সামনে তাৎক্ষণিক গান রচনা করে পরিবেশন করেন। তথ্যটি সত্য হলে প্রশ্ন জাগে, শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জে কত সালে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন, ১৯৫৪ সালে নাকি ১৯৫৬ সালে? বিষয়টির মীমাংসা করা গেলে শাহ আবদুল করিমের লেখা গানটির রচনাকাল সম্পর্কে একটা জানা যাবে। শুরুতেই জাকারিয়ার সাহেব জানান, ‘১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যখন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে তখন আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গড়ে তোলে’। বাক্যটিতেই ঐতিহাসিক তথ্যের বিচ্যুতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ নামে ১৯৫৪ সালে কোনো দল ছিল না। ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ গঠিত হয় ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে (বঙ্গবন্ধু কোষ, সম্পাদনা : মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, জুন ২০১২, পৃষ্ঠা, ৩৯২)। ১৯৫৬ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগগের কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন শেখ মুজিব (বঙ্গবন্ধু কোষ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯৩)। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার ১৯৫৪-তে গড়ে তোলে না গড়ে তোলে ১৯৫৬-তে।

১৯৫৪ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারনার কাজে নিজ এলাকাতেই ছিলেন। তার আত্মজীবনীতে জানান, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা ছাড়া আশপাশের দুই এলাকাতে আমাকে যেতে হয়েছিল।

যেমন যশোরের আবদুল হাকিম সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়, ইনি পরে স্পিকার হন; এবং আবদুল খালেকের এলাকায়, ইনি পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন।’ (দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লি., ২০১২, পৃষ্ঠা ২৫৭)। অর্থাৎ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় বা তার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাহ আবদুল করিমের দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে গবেষক জাকারিয়ার তথ্য মতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে ধরে নিতে হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করলে দেখা যায় ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জে যাননি। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর তিনি যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত তিনি এই ব্যস্ততার মধ্যেই থাকতে হয়। এর মাঝেও ১০ মে তিনি ভাসানীর সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করেন (আনোয়ার আহমেদ, বঙ্গবন্ধু ও যুক্তফ্রন্ট সরকার, তাম্রলিপি, ২০২০, পৃষ্ঠা ৬৭)। এরপর তিনি করাচি যান। সেখানে ১৫ মে তিনি প্রাদেশিক সরকারে কৃষি ও বনমন্ত্রী হিসেবে শপথ পাঠ করেন (বঙ্গবন্ধু কোষ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯২)। ওইদিন আদমজী জুটমিলে দাঙ্গা শুরু হয় এবং সেই দাঙ্গায় প্রায় দেড় হাজার নিরীহ শ্রমিক মারা যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে শেখ মুজিব ওই দিনই করাচি থেকে ঢাকায় আসেন এবং গ্রেফতার হন (বঙ্গবন্ধু কোষ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯২)। সেই থেকে তিনি ১৯৫৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলে থাকেন। ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন (বঙ্গবন্ধু কোষ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯২)। ঐতিহাসিক এ তথ্যউপাত্ত থেকে এটা পরিষ্কার, ১৯৫৪ সালে কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জ যাননি বা তার পক্ষে যাওয়ার সুযোগও ছিল না। তাহলে সুমনকুমারের মতটিই ঠিক। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪-তে নয়, ১৯৫৬-তে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করার পরে প্রথমবারের মতো সুনামগঞ্জে যান। সেই সময়ই শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গানটি রচনা করে পরিবেশন করেন। অনেকেই এটাকে ’৫৪-এর নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারণার গান হিসেবেও দাবি করে থাকেন। কিন্তু গানের বাণীর দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় গানটিতে বঙ্গবন্ধুই কেন্দ্রীয় চরিত্র। অথচ শেখ মুজিব তখনও জাতীয় রাজনীতি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেননি। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কেন্দ্রীয় চরিত্র তখন- হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রে রেখে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। যেমন- লোককবি ফরিদ উদ্দিন হায়দার গেয়েছেন, আমাদের এই মিনতি হক-আতা-ভাসানীর প্রতি/ তোমরা নিজ হাতে খুইদো গো নুরুল আমিনের খাদ। এখানে লোককবির নির্বাচনি এলাকার প্রার্থী আতাউর রহমান খানের কথা উঠে এসেছে হক ও ভাসানীর সঙ্গে। অতএব নির্বাচনী প্রচারণার গানের এই নমুনা থেকেই ধারণা করা যায় সুনামগঞ্জে, যেখানে বঙ্গবন্ধু তখনও যাননি সেখানে তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে নির্বাচনী প্রচারণার গান রচনা প্রায় অসম্ভব।

সাধারণত নির্বাচনী সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুসারে এলাকাভিত্তিক প্রার্থীকে কেন্দ্র করেই লোককবিরা গান রচনা করে থাকেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পরিচিতি পেলেও আপামর জনসাধারণের মধ্যমণি হয়ে ওঠেননি। তবে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়ার মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়, সকলের প্রিয় ‘ম্যাভাই’ (মিয়া ভাই)। কাজেই তাকে নিয়ে প্রথম কোনো গান রচিত হলে সেটা গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়াতেই হওয়ার কথা। ড. তপন বাগচী তার গ্রন্থে জানান, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গান শুরু হয় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়। শেখ মুজিবের বক্তৃতাকে থিম হিসেবে ধরে গান লিখেছেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ রোকনউদ্দিন। তার দেওয়া সুরেই জনসভায় পরিবেশন করেছেন চান মিয়া (পৃষ্ঠা ১৫)।’ ড. বাগচী তার বইয়ে শেখ রোকনউদ্দিনের পাঁচটি গানের অংশবিশেষ উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ‘বঙ্গবন্ধু তখনো বঙ্গবন্ধু হন নাই। তিনি এ গানগুলো শুনে মুগ্ধ হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তার পরামর্শে গোপাল ডাক্তারের পপুলার প্রেস থেকে ১৬ পৃষ্ঠার একটি গানের বই ছাপা হয়। ...বইটি নির্বাচনী প্রচারপত্র হিসেবে প্রতিটি সভায় বিতরণ করা হতো। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন পেয়েই গানগুলো রচিত ও প্রচারিত হয়েছে (পৃষ্ঠা ১৬)।’ ড. বাগচী রোকনউদ্দিনের গানগুলোকে যুক্তফ্রন্ট নির্বচনের নির্বাচনী প্রচারণার গান বলেই উল্লেখ করেছেন।

এদিকে বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট (বিএফআই) থেকে রাকিবুল হাসানের চিত্রগ্রহণ ও নির্দেশনায় রোকনউদ্দিনের কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চারণ কবি রোকনউদ্দিন নামে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা হয়। এত ধারা বিবরণী দেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। এটি আরটিভি-তে ২০১২ সালে প্রচারিত হয়। ডকুমেন্টারিতে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যাচ্ছে- কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর আবদুল আজিজকে। তিনি ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কোটালীপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আবদুল আজিজের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু রোকনউদ্দিনকে আগে থেকেই চিনতেন এবং তিনি যে গান লেখেন সেটাও তার অবিদিত ছিল না। গোপালগঞ্জে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রথম নির্বাচনী প্রচারণা সভা শুরু হয় কুশলা দারোগা সাবের খেলার মাঠে (বর্তমানে এটা সুলতান মাহমুদ চৌধুরী ওরফে কালু চেয়ারম্যানের দীঘি)। সেই দিন রোকনউদ্দিন কোনো গান লিখেছে কিনা শেখ মুজিব তা জানতে চান। সেই সময় শেখ মুজিবের নির্দেশে রোকনউদ্দিনের লেখা গান গেয়ে শোনান কে এম চাঁদ মিয়া। চাঁদ মিয়া তখন রোকনউদ্দিনের লেখা তিনটি গান জনসভায় পরিবেশন করেন। গান তিনটির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি গান ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে প্রথম গানটি হলো-
আরে ও মুসলিম লীগ ব্যাপারী
তুমি সোনার তরী ছেড়ে যাও
মুখি কালি লয়ে যাও বাড়ি।
কে এম চাঁদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে দ্বিতীয় গানটি হলো-
চাষি মরছি না খাইয়া, ওরে আমরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা কইরা মরি রে
স্বাধীনতা পাইয়ারে চাষি মরছি না খাইয়া।

গান দুটির উল্লেখ পাওয়া যায় রোকনউদ্দিনের ছেলে ডা. শেখ সাইফুল ইসলাম শাহীন সম্পাদিত শেখ রোকনউদ্দিনের কবিতা ও গান : যুক্তফ্রন্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধ (দি রয়াল পাবলিশার্স, ২০১১), লেখক ডা. সাইফুল ইসলাম শাহীনের তখন চুয়ান্ন ও আমার লেখা লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বইয়েও সালসহ গানগুলোর উল্লেখ আছে। ডকুমেন্টারিতে দেখা যায় রোকনউদ্দিনের লেখা একটি গান শোনাচ্ছেন চাঁদ মিয়া- ওরে তোরা আয় আজ খুশিতে/ কে দেখবি নতুন চাঁদ আজ উদয় হইযাছে/ ঐ শুক্ল পক্ষের চান শেখ মুজিবুর রহমান/ মাটি মায়ের বাঙালি সন্তান।/ ও আজ বঙ্গভালে উদয় হলো রে...। ধারা বিবরণীতে এ গানটিকেই শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা প্রথম গান বলে উল্লেখ করা হয়। রোকনউদ্দিনের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গানটি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু জয়ী হলে ১৮ মার্চ লেখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে লেখা প্রথম গানের গানের কথা যদি বলা হয় তবে রোকনউদ্দিনের লেখা এ গানকেই প্রথম গান বলে উল্লেখ করতে হবে। তবে কে এম চাঁদ মিয়ার ভিডিও সাক্ষাৎকারটির অপ্রকাশিত কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এ সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় চাঁদ মিয়া খুলনার সার্কিট হাউসে রোকনউদ্দিনের লেখা ‘চাষি মরছি না খাইয়া’ গানটি পরিবেশন করেন। পাকিস্তান সরকারের কর্ডন আইনের কারণে চাষিদের ওপর যে দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে তার বর্ণনা রয়েছে গানটিতে। ফরিদপুরের দাওয়ালরা খুলনায় গেলে প্রায় দুই শত নৌকা আটকে রাখা হয়েছিল। শেখ মুজিব তখন খুলনা ছুটে যান এবং দাওয়ালদের নিয়ে সভা করেন, শোভাযাত্রা করে ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবনে যান (অনিন্দ্য শুভ্র, বঙ্গবন্ধুর কিশোর জীবন, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ৩য় মুদ্রণ, ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪৮)। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও ঘটনাটির উল্লেখ আছে। চাঁদ মিয়া খুলনার সার্কিট হাউসে কখন গানটি পরিবেশন করেন তা নির্ধারণ করার উপায় নেই। এ কারণে গানের বাণীতে উল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের তথ্যকে সামনে রেখে গানটির রচনার সম্ভাব্য কাল অনুসন্ধান করা যেতে পারে। তিনি ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত শত ঊনানব্বই দিন জেল খাটেন (নাছিমা বেগম, রেনু থেকে বঙ্গমাতা, তাম্রলিপি, ২০২০)। এর আগে বঙ্গবন্ধু আরও প্রায় তিন মাস জেল খাটেন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত হিসাব করলে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন হয় প্রায় আড়াই বছর। গানের বাণীতে আড়াই বছর শব্দটা বেমানান, ছন্দে মেলে না। এ কারণে কবি হয়তো তিন বছর উল্লেখ করেছেন। সেই বিচারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রোকনউদ্দিনের লেখা গানটির রচনাকাল ধরা যেতে পারে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে কোনো এক সময়। আবার গানের বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিলে গানটির রচনা কাল তারও অনেক আগের বলে মনে করা যেতে পারে। তবে আবদুল আজিজের একটি অপ্রকাশিত পৃথক একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তিনি ১৯৫১ সালে রোকনউদ্দিনকে নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তা হলে এটা ধরে নেওয়া যায়, গানটি যতই আগে রচিত হোক না কেন ১৯৫১-এর আগে রচিত নয়। পূর্ণাঙ্গ গানটি এখানে তুলে ধরা হলো-
চাষি মরছি না খাইয়া
ও আজ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা কইরা মরি
স্বাধীনতা পাই রে
চাষি মরছি না খাইয়া।
ধান কাটিতে গেলামরে ভাই
খুলনা জেলার পরে
ও সে গোডাউনে ধান উঠাইলো
কন্ট্রোলের ব্যাপারে
আইলাম সবে বাড়ি ফিরা
মহাজনের দেনায় পইড়া রে
ওরে ঘর বাড়ি সব দিলাম ছাইড়া
রাস্তায় রই শুইয়ারে
চাষি মরছি না খাইয়া ॥
শেখ মুজিবর বলেছিল
ছেড়ে দে গো ধান
ও সে আমার দেশের দাওয়াল ভাইরা
ভিক্ষা দাও রে প্রাণ, সরকার ভিক্ষা দাও গো প্রাণ।
জালিম সরকার ধান না দিয়া
মুজিব ভাইরে নিল ধইরা
তারে তিনটি বছর জেলে রাখল
বিচার না করিয়া
চাষি মরছি না খাইয়া ॥
গানটির বিষয়বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রধান চরিত্রও বঙ্গবন্ধু যিনি দাওয়াল চাষিদের হয়ে প্রতিবাদ করেন এবং জেল খাটেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রোকনউদ্দিনের লেখা ১৮ মার্চের গানটি প্রথম গান নয়, তার লেখা প্রথম গানটি হচ্ছে ‘চাষি মরছি না খাইয়া...’।
রোকনউদ্দিন যেহেতু শাহ আবদুল করিমের মতো বিখ্যাত ছিলেন না তাই তার গান ও কর্মজীবন সম্পর্কে কেউ খোঁজ রাখেননি। সুরসম্রাট শাহ আবদুল করিম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন এ কথা সত্য তবে তিনিই যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান লিখেছেন এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। গবেষক সাইমন জাকারিয়া বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে... শাহ আবদুল করিমের উপর্যুক্ত গানটিই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সাধক কবিদের প্রথম রচনা কর্ম’ কথাটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির আগে পাণ্ডলিপি তৈরির সময় পর্যন্ত ঠিক ছিল বলে ধরে নেওয়া গেলেও এখন আর বলার সুযোগ নেই (যদিও তার আগেই ২০১৭ সালে রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বচনে রোকনউদ্দিনের লেখা গানগুলোই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান’ এবং এমনও নয়, লোকসংস্কৃতি কিংবা লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে অবতারণা করে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে! গবেষক গুগলে অনুসন্ধান করলেও বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের অবকাশও পেতেন। আমার বিশ্বাস তখন ২০২০ সালে প্রকাশিত বইটিতে তিনি রোকনউদ্দিনের নামটিই উল্লেখ করতেন)। আজ যেহেতু ঐতিহাসিক তথ্যউপাত্ত, গানের বাণীর বিষয়বস্তু, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লজিং থাকা ও তার সাহচর্যে বেড়ে ওঠা কে এম চাঁদ মিয়ার অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার, আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও বঙ্গবন্ধুর সহচর আবদুল আজিজের সাক্ষাৎকার থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে, রোকনউদ্দিনের লেখা গানগুলোই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা প্রথম গান। তাই কম পরিচিত বলে কৃতিত্ব অস্বীকার না করে রোকনউদ্দিনকে তার প্রাপ্ত কৃতিত্বের স্বীকৃতি দান করাই একজন নিরপেক্ষ গবেষকের কর্তব্য হওয়া উচিত বলে মনে করি।

রঞ্জনা বিশ্বাস : সাহিত্যিক ও গবেষক

 
Electronic Paper