ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

উদাসী হাওয়ার ডাকে

দীলতাজ রহমান
🕐 ১২:৩৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০২, ২০২০

‘উদাসী হাওয়ার ডাকে’ ও তার লেখক ডিনা চৌধুরী, এই দুটির কোনদিকে লেখার মোড় নেব, ভেবে আঙুল জড়িয়ে যাচ্ছে। স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি আমাকে সমানভাবে আপ্লুত করছে। লেখক সম্পর্কে আগে কিছু জানান দেওয়া যাক পাঠককে। তাতে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবেন বলে ধারণা। একটি বিস্ময় থেকে পাঠককে আড়ালে না রেখে বরং যেতে যেতে হয়ে যাক আরেকটি কাহিনির বর্ণনা।

২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে একুশের এক অনুষ্ঠানে, মেলবোর্ন প্রবাসী বাংলাদেশের একজন সাহিত্যিক-প্রকৌশলী লুৎফর খানের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। সেখানে সবার অচেনা আমি শহীদ মিনারে ফুল দিতে অঢেল অপরিচয়ের বেড়িতে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে খেতে এক-আধটু এর ওর সঙ্গে পরিচিত হতে চেষ্টা করছি। এর ভেতর এক পরী সদৃশ নারী কাছে এসে আমার গালে গাল ছুঁয়ে বলে উঠল, ‘কেন যেন মনে হতো, কখনো না কখনো আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে!’

বিস্মিত হয়ে বললাম, আমাকে চেনেন? তিনি বললেন, ফেসবুকে আপনার লেখা দেখি...! আমিও আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু আপনি তো আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন বলে মনে হয় না! পরী বললেন, যখন অন্য কাউকে লেখা ট্যাগ করে পোস্ট দেন, তারা কেউ আমার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তখন দেখতে পাই। আপনার লেখা খুব ভালো লাগে!

একজন লেখকের বিদেশ-বিভূঁইয়ে এমন পাঠক পাওয়া মানে একখানা পরম কূল পাওয়া! আমার সে ফেসবুকের ভায়া পাঠকের সঙ্গে এবার সরাসরি ফেসবুক ও ফোনে পরিচয় ঘন হতে থাকে। ঘন পরিচয় থেকে ক্রমে জানা হতে থাকে, তিনি গান শুধু জানেন, তা-ই নয়। আসর মাতিয়ে গাইতেও সক্ষমতা ধারণ করে আছেন।

একসময় ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়া ছিল। জীবন-জীবিকার ধরন পাল্টাতে দুই যুগেরও বেশি সময় আগে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছেন। তারপর ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, তাদের বিয়ে। আর এসব দেশে তো কারওরই বসে খাওয়ার উপায় নেই। অতএব তাকে বাইরেও কাজ করতে হতো। যা এখনো চলমান।

এর ভিতরই তিনি ইউটিউবের বদৌলতে বাচিক শিল্পীদের অনুকরণে শুদ্ধভাবে আবৃত্তি করতে পারেন অনেক জনপ্রিয় কবিতাও। এখানে একটি নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত; যেকোনো নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিও সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলেন। আর এসবই নিজের চোখে দেখা। থলে থেকে বিড়াল বেরিয়ে আসার মতো অবশেষে আমার জন্য বেরিয়ে এলো, ছেঁড়াখোঁড়া কাগজে তার কিছু লেখাজোকা। তাকে বললাম, এর ভিতর যে উপাদান আছে, এইগুলোর উঁকি দেওয়া ডালপালাগুলোকে টেনে বিস্তৃত করো।

যে নানির মা’কে দেখেছেন, ‘উদাসী হাওয়ার ডাকে’র স্রষ্টা ডিনা চৌধুরী, তাকে নিয়ে কিছু লেখা ছেঁড়া কাগজে ছিল। তিনি ছোট কাকা মহিউদ্দিন মিয়া, বড়ভাই রেজাউল করিম ডিটো ও লাগাবান্ধা বাড়িতে থাকা পুরনো চাকর ছমির চাচাসহ মায়ের দা-বটি-কুড়াল, খুন্তি, কোদাল, কুলো-ডালাসহ আরও বহু জিনিসের ফর্দ ও বস্তা নিয়ে নিজেদের গ্রাম কাটাখালি থেকে মাঝখানে দুই গ্রাম পার হয়ে ভাকলা গ্রামের নছির মেলায় যেতেন। রাজবাজি জেলায় অবস্থিত সেই ভাকলা গ্রামের মেলার পথে পড়ত তার মায়ের নানাবাড়ি। যখন তিনি কিশোরী তখনও তার মায়ের সে নানি কাছরন্দ বানু জীবিত এবং মায়ের নানির বাড়ি নছির মেলায় যাওয়ার পথের পাশেই।

তখন তো যার যার পা দুটো ছাড়া গাঁয়ের পথে কোনো বাহন ছিল না। তাই সে পরনানি, মানে মায়ের নানি জানালা দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মাঝখানে আরও দুই গ্রাম পার হয়ে কাটাখালি থেকে তার নাতিন কন্যা কোনদিন মেলায় আসে। যদি মেলার আনন্দে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, তাই ক’দিন ধরে একটানা ছিল তার পথ চাওয়া! (আহা, সামান্য একটা মোবাইল ফোন এসে আমাদের এ অপেক্ষার মধু থেকে সে বড় বঞ্চিত করে দিল)! তারপর রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তাকে নিজে ডলে-ঘষে পায়ের কাদা তুলতেন। এরই ভিতর ঝকঝকে মাটির বারান্দায় কারও বিছানো শীতল পাটিতে বসিয়ে সকালের বাঁধা বেণি খুলে তেলা মাথায় আবার তেল দিয়ে আবার পটু হাতে রঙিন ফিতেয় মসৃণ বেণি বাঁধতেন। এর ভিতর বাড়ির অন্যরা তার হুকুমেই সবার জন্য হাজির করত গ্লাসভর্তি সরপড়া দুধ। গাছ থেকে পাড়া হতো ডাব। ওদিকে বাইরের চুলো থেকে বেরিয়ে আসত হরেক রকম রান্নার ঘ্রাণ! এ সমারোহ’র ভার যত বেশি টের পেতেন, লেখকের চোখ উপচে আসতে চাইত জলে। মেলায় মন পড়ে আছে যে!

ছেঁড়া কাগজের বয়ান পড়ে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, এ পটীয়সীকে বললাম, প্রতিটি চরিত্রকে বিস্তৃত করো। এরকম গ্রাম-সংস্কৃতির গল্পের আবেদন চিরনতুন। কথা মেনে ডিনা ওই একটা গল্পই শুধু নয়, আরও চৌদ্দটি গল্প লিখেছেন। তার সবই যুৎসই গল্প করে তুলতে পেরেছেন তা নয়। তবে বতরের ফসল ঘরের গোলায় তোলার আগে উঠোনে তার যে সমারোহ দেখা যায়, গেরস্তের তাতেও প্রাপ্তির আনন্দের কোনো কমতি থাকে না! তবু আমার একটু উসকে দেওয়াতে যে তিনি ভিতরের আরও একটি গুণকে আগুন করে তুলতে পেরেছেন, সেই আনন্দ ও বিস্ময় রূপিত করে বহু পাঠকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার আগ্রহও তাড়িত করে চলছে। এ সুযোগে বলে যাই, ডিনা চৌধুরী আমাদের ভিতর থেকে অকালে হারিয়ে যাওয়া কথাশিল্পী মিলিকুনের আপন বোনঝি।

এ গুণবতীর একার গান গেয়ে সরে গেলে সেটাও আমার ভারী অন্যায় হবে। টিমটিম করে জ্বলা প্রদীপটি যদি কেউ বাতাসের আঁচড় বাঁচিয়ে, যতœ করে দেউলা মানে প্রদীপদানির ওপর তুলে না ধরেন তাহলে সে আলোর অকাল পতন অনিবার্য! বাতিটি কিছুক্ষণ জ্বললেও তার আলো বেশিদূর পৌঁছে না! তাই বাতিটি আলগোছে তুলে ধরার কাজটি, পরম যত্ন-মমতায় আলোটুকু অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেছেন ডিনার স্বামী আইটি স্পেশালিস্ট মাহবুব চৌধুরী। যিনি বিদেশে থেকেও দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে ভাবেন। সেই ভাবনা থেকে নিজের গ্রাম কাটাখালিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন চৌধুরী মাহবুব হোসেন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।

‘উদাসী হাওয়ার ডাকে’ বইটিতে গল্প আছে পনেরটি। ‘মেলবোর্নে আমরা’ ছাড়া বাকি গল্পগুলোতে জমে আছে গ্রাম বাংলার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। গ্রামে যাপিত জীবনের টানাপোড়েন। যা গ্রামে জন্ম নেওয়া মানুষের অতি চেনা মনে হবে। গ্রামের ভিতরে একাত্ম হয়ে থাকার সুযোগ যাদের হয়নি, তারা নতুন করে স্বাদ পাবেন অচেনা জীবনের। বইটির প্রকাশক প্রকাশ পাবলিকেশন্স। মূল্য দুইশত টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।

 
Electronic Paper