কড়া পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও চালের বাজার চড়া
শাহাদাত স্বপন
🕐 ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ০১, ২০২০
হঠাৎ করেই খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বরাবরই তৎপর ছিল খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। চালকল মালিকদের ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় সভা করতে দেখা গেছে মন্ত্রণালয়কে। এমনকি কোনো চাল কত দামে বিক্রয় হবে তাও নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য অধিদফতর। এত কিছুর পরেও হঠাৎ করেই চালের দাম বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর।
খাদ্য অধিদফতর বলছে, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় মিটিং করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোনোভাবেই যেন চালের দাম বৃদ্ধি না পায়। একদিকে ব্যবসায়ীদের চালের দাম বৃদ্ধি না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অপরদিকে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরকে বলা হয়েছে চালের বাজারের ওপর নজর রাখতে। এ লক্ষ্যে অধিদফতর ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বাজার মনিটরিং এর জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে চাল ব্যবসায়ীদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, চালের দাম যাতে বৃদ্ধি না পায় সে জন্য সব ধরনের সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে।
এতসব উদ্যোগের পরও চালের দাম বৃদ্ধি কেন? এর কারণ জানতে জোর মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, আমরা কৃষি বিপণন অধিদফতর, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন চালের দামের বিষয়টিকে ভালোভাবে মনিটরিং করে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি।
আমরা বলেছি যেখানেই অতিরিক্ত চালের মজুদ পাওয়া যাবে সেখানেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুপার কোয়ালিফাই মিনিকেট প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকায় ও মিডিয়াম কোয়ালিফাই মিনিকেট ২ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দিয়েছি। কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা আইনুনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে বাজার মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ বলে মিল মালিকরা টালবাহানা করছেন। আমরা তাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছি, প্রতিদিন একজন মানুষ ৩৭২ গ্রাম চালের ভাত খান। সেই হিসেবে দেশে পর্যাপ্ত চাল মজুদ থাকার পরে কোনভাবেই চালের দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেই।
খাদ্য অধিদফতরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিচালক আমজাদ হোসেন দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি মিল মালিকরা চাল সংরক্ষণ করছেন। চালের যে পাইকারি দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি তা না মানলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পক্ষ থেকে মঙ্গলবারের সভায় পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে চাল কলগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এক্ষেত্রে কোথাও পরিমাণের বেশি মজুদ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সারা দেশে বাজারগুলোতে এবং যেসব জায়গায় চাল মজুদ রাখার সম্ভাবনা সেখানেও অভিযান জোরদার করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ অটো, মেজর এন্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী খোলা কাগজকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা পূর্বের মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে চাল বিক্রি করছি। আমাদের পক্ষ থেকে চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়নি। চাইলে আপনারা নিজেরা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। আমাদের কাছ থেকে চাল স্বল্প মূল্যে ক্রয় করে রিটেইলার এবং পাইকারি বিক্রেতারা বেশি মূল্যে বিক্রি করছে। যার ফলে খুচরা বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ভোক্তা অধিকার অধিদফতর কে পরিষ্কার বলেছি তারা যেন বাজার মনিটরিং করে। অহেতুক মিল মালিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। কোনোভাবেই মিল মালিকদের পক্ষ থেকে চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়নি দাবি করেন এই ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন করলে তারা বলে আমরা মিল মালিকরা নাকি চাল ক্রয়ের সময় মেমো দেই না। এটা সঠিক নয়, কারণ চাল পরিবহনের সময় প্রমাণপত্র হিসেবে তাদের মেমো লাগবেই। ফলে এটা বলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে কচুক্ষেত চালের পাইকারি ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, আমরা বর্তমানে মিনিটেক চালে প্রতি বস্তায় অর্থাৎ ৫০ কেজিতে দেড় থেকে দুই’শ টাকা বেশি দামে কিনছি। বিক্রিও করছি সেই হিসাব করে। প্রতি কেজি চাল খুচরা ব্যবসায়ীরা ৪ টাকা করে বেশি দিয়ে ক্রয় করে বিক্রির সময় তারা প্রতি কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে। এভাবেই চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়ে গেছে।
মিল মালিকদের দাবি তারা আগের মূল্যই চাল বিক্রি করছে সেক্ষেত্রে আপনারা- রিটেইলার বা আড়তদাররা বেশি দামে বিক্রি করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এ ব্যবসায়ী বলেন, তারা আপনাদের ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছে। তারা বেশি দামে চাল বিক্রি করে ম্যামো পর্যন্ত দিচ্ছে না। চোত কাগজে (চিরকুট) হিসাব লিখে দিচ্ছে। মিল মালিকরা বিশেষ করে মোজাম্মেল ও আবদুর রশিদ ব্রান্ডের চাল কেজি প্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা করে বেশি দামে পাইকারি ক্রয় করতে হচ্ছে। আপনি তাদের প্রশ্ন করেন খাদ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরেও কেন তারা বেশি দামে চাল বিক্রি করছে।
মোহাম্মাদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তদার ব্যবসায়ীদের দাবি, আমরা যখন যে দামে চাল ক্রয় করি সেই দাম হিসেবে করেই তা বিক্রি করি। বেশি দাম নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে বাজার মনিটরিং করা হয় না। কী পরিমাণ পাইকারি দাম বৃদ্ধি করা হয় আর খুচরা বাজারে চালের দাম কত নেওয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে মনিটরিং দরকার। মিল মালিকরা ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করে। এতে আমরা যারা মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ী তাদের ওপর চাপে বাড়ে।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, আমরা মিল মালিকদের বলেছি বাজারে ১৫ দিন আগে চালের যে দাম ছিল ওই দামে বিক্রি হবে। আগামী এক মাসে চালের দাম বাড়ানো যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাদের ধান মজুদ অস্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টিসিবি ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ দিন আগে ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা, মাঝারি চাল ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা, মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ও নাজিরশাইল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা ছিল।
আর পাইকারিতে ১৫ দিন আগে মোটা চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকা, মাঝারি ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা, মিনিকেট ৪৮ থেকে ৫২ টাকা ও নাজিরশাইল ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চালের দর সব পর্যায়ে কেজিতে গড়ে ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।