উপজেলা চত্বরে আর হাঁসাবে না ভান্টু দা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ২:৪৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০
সকলের কাছে প্রিয় ও এক নামেই সবাই চেনে ভান্টু দা বলে। ভান্টু নামটি এতোটাই মানুষের কাছে পৌছে গিয়েছিল এতে বাবা-মায়ের দেয়া নামটি আজও সবার অজানা। তার পুরো নাম, অধির চন্দ্র কর্মকার। তার পিতার নাম, মৃত নিতাই কর্মকার। বাড়ী রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার মৌকুড়ি গ্রামে (আমতলা)। তার জীবনের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন উপজেলা পরিষদের বারান্দায়।
এখনও তার দিনকাটে উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকায়। তবে তার বয়স ৭২ বছর হয়েছে। সেই তরুণ দীপ্ত বয়সে পাতা দিয়ে তৈরী বাঁশি বাজিয়ে ও কথার মধ্যে অফিসের কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে রাখতেন। বয়স হওয়ার সাথে সাথে পাতার বাঁশির কাছে হার মেনেছেন একজন সাদা মনের মানুষ ভান্টু দা। অবশেষে বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন।
তার মৃত্যুর খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে একনজর দেখতে তার বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের বাড়ীতে হাজির হন সরকারী কর্মকর্তা, বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার, সাংবাদিক, শিক্ষক ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শত শত লোক তাকে দেখতে বাড়ীতে হাজির হন। বৃহস্পতিবার দুপুরে বালিয়াকান্দি মহাশ্মশানে তার সৎকার করা হয়।
অধির চন্দ্র কর্মকার ওরফে ভান্টু। জন্ম প্রতিবন্ধি হওয়ায় পাশ্ববর্তী বাদশা কেরানীর বাড়ীতে ছোট বেলা থেকেই রাখালের কাজ শুরু করেন। গরু চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন গাছের পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে সুরের ঝড় তুলতেন। ভালো বাসতেন আমতলা বাজারে যাত্রাদলের শিল্পীদের অভিনয়। নিজেও অভিনয় করে মানুষকে হাঁসি দিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। গৃহকর্তা তাকে দিয়ে সকল কাজ করালেও সততার কোন কমতি পাননি তার মধ্যে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাড়ি জমান ভারতে। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেই শিশু বয়সেই বিয়ে করেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের গীতা রানীকে। বিয়ের পর সংসার চালানোর জন্য কিছুদিন কাঠুরিয়ার কাজও করেন। শারিরিক অসুস্থতার কারণে কাঠুরিয়ার কাজও ছেড়ে দেন তিনি। এরপর বাড়ী-ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেন উপজেলা চত্বরে। বিভিন্ন অফিসের বারান্দায় কাটতে থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।
অফিসের বারান্দায় থাকলেও ভান্টুর সততা, নিষ্ট্রা ও তার গান, অভিনয়, পাতার বাঁশি ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে পড়ে থাকতেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একদিন ভান্টুকে না দেখলে মনে হয় তারা কিছু হারিয়েছে। তাকে দেওয়া হয় বিভিন্ন অফিসে সহায়ক হিসেবে ঝাড়ু ও চা টানার কাজ। তবে মাসিক বেতন না থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় তার সংসার খুব সুখেই চলতে থাকে।
এরই মধ্যে গীতা-ভান্টুর সংসারে একে একে ১০টি সন্তান জন্ম নিলেও এখন তার ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে জীবিত রয়েছে। ছেলে ৪ জনই বিয়ে করে তাদের মতো সংসার পেতেছে। ৩ মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। তবে বয়স তার ৭২ বছর হয়েছে।
বয়সের ভারে এখন আর পাতার বাঁশি বাজাতে পারতেন না। বয়স হলেও তার মনের জৌলশ কমতি ছিল না। কর্মকর্তাকে বিষন্ন দেখলেই এমন একটি কৌতুহলী কথা বা অভিনয় করে, এতে পড়ে যায় হাসির ঝিলিক। তাকে কখনোই মন খারাপ দেখেছে কেউ তা বলা দুষ্কর। সে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ হিসেবে দাবী করতেন। এখন আর উপজেলা চত্বরকে হাসির ঝিলিকে মাতিয়ে রাখবেন না।