ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাবা তোমার পাশে বারবার হাঁটতে চাই

আলী ইউনুস হৃদয়
🕐 ১:২৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

আজ থেকে পনের বছর আগে সাইকেলের সামনে বসিয়ে বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন। ছুটির দিন বাদে সকাল হতেই প্রায় দুই কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলের গেইটে পৌঁছে দিতেন। সাইকেলের পেছনে বসার ব্যবস্থা না থাকায় সামনে বসে যেতো হতো। সামনে বসার কারণে সাইকেল চালানোর সময় বাবার ঘেমে যাওয়া বুকের আলতো ছোঁয়া আমার পিঠে লাগতো। সাইকেল থেকে নামার পরে পিঠে হাত দিতেই বুঝতে পারতাম আর এখন মনে পড়ছে। আজ যখন স্কুল, কলেজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি পেরোতে বসেছি।

ঠিক তখনই বাবার সেই ঘেমে যাওয়া বুকের স্পর্শ অনুভব করতে পারছি। আর স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি! আসলে বাবাকে কোনো দিবসের গণ্ডিতে মনে করার মানসিকতা আমার নেই। একটি পরিবারের জন্য আনসাং হিরো হিসেবে বাবারাই সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যান। তাই প্রতিটি দিনের পাশাপাশি বাবা দিবসেও আমাদের বাবাদের একটু বিশেষভাবে স্মরণ করা হলে তারাও আনন্দিত হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

স্কুল থেকে টিফিন দিতো তারপরও বাবা পাঁচ টাকার কয়েন হাতে ধরিয়ে দিতো। সেই টাকা দিয়ে স্কুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্যানে করে ফিরতাম। যখন স্কুল ছুটি হতো তখন দিনমজুর বাবা কাজে বিভোর ব্যস্ত। আর হ্যাঁ বাবা আমাকে স্কুলে রেখেই কাজে যোগ দিতেন। তিন বছর পর যখন একা চলাফেরা করার মতো বোঝাপড়া হলো তখন ভ্যানে করে স্কুল থেকে যাওয়া-আসা করতাম।

তারপর থেকে আর বাবার ঘেমে যাওয়া বুকের স্পর্শ পাইনি। চাইলেও কী সেই স্পর্শ পাওয়া যাবে, পাবো না! বড় হওয়ার দৌঁড়ে এখন দৌঁড়াচ্ছি। তাই বাবার সঙ্গে জড়িত স্মৃতিগুলোর মুহুর্ত খুঁজেফিরে মনে করার চেষ্টা করি। এরমাঝে দুই বছরের কলেজের গ-ি শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দুই বছর হয়েছে। হঠাৎ একদিন চূড়ান্ত পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে জানতে পারি, বাবা বিদ্যুতায়িত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। মা, বোন ফোন দিয়ে হা-হুতাশ করছেন।

আর পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে আমার উপর ভরসাও কম ছিলো না। কিন্তু আমি তখনও নিজেকে গুছিয়ে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত, এখনও আছি। তবে সেদিনের সেই মুঠোফোনের আকুতি আমি কখনও ভুলতে পারবো না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বড়ভা সহকর্মীদের সহযোগিতায় বাবাকে একপলক দেখার জন্য চলে আসি। বাবাকে দেখতে আসার সে সময়টুকু আমার জীবনের দীর্ঘশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলেছিলো।

বাবাকে হাসপাতালে দেখার পর নিজেকে সামলে রাখতে পারছিলাম না। কোনোমতে বাবাকে দেখে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফিরে আসতে হবে। বাবা বলছে, তুমি এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাও (পোড়া শরীরের চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না)। বিভিন্ন জটিলতার কারণে সেদিন নিয়ে আসা সম্ভব হলো না। আমি ফিরে আসলাম, সাধ্যমতো পরীক্ষাও দিলাম। দিনে দিনে বাবা অস্থির হয়ে পড়লেন। 

পরে সব ধরনের জটিলতা কাটিয়ে বাবাকে নিয়ে আসা সম্ভব হলো। আমার একাডেমিক পরীক্ষার সঙ্গে বাবাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাও চলছে। সেই দিনগুলো মনে পড়তেই হতবাক হয়ে পড়ি। এখন মনে হয়, কীভাবে সে সময় আমি পাড়ি দিয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে শরীরে ছোট-বড় দুই-তিনটি অপারেশনের পর বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন। পোড়া জায়গা ড্রেসিং করার সময় বাবাকে কতবার যে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছি তা মনে করতে খুব কষ্ট হয়।

সঙ্গে ছিলো হৃদয়বিদারক আর্তনাদ আর চিৎকার। এখন বাবা হাটা-চলাফেরা করতে পারেন। দিনে দিনে অসুস্থ বাবাকে চলাফেরা করতে দেখে আমি প্রাণ ফিরে পেয়েছি। বাড়িতে আসলে যখনই সুযোগ পাই বাবার সঙ্গে হাঁটতে বের হই। আবার আমার ক্যাম্পাসে যেদিন বাবাকে নিয়ে আসি সেদিনও বাবার সঙ্গেই প্রিয় প্যারিস রোডে হেঁটেছি। কখনও ভাবতে পারিনি বাবা আবার হাঁটতে পারবেন। যারা আমার বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখেছিলেন তারাও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বাবা আবারও সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

আর বাবার সঙ্গে হাঁটার সময় মনে মনে বলি, বাবা তোমার সঙ্গে এই হাঁটতে পারার মাঝে এতো আনন্দ আর ভালোলাগা যে আমি আমার জীবনের পথচলার শক্তি খুঁজে পাই। আর বারবার তোমার পাশে হাঁটতে চাই। বাবা তুমি সবসময় সুস্থ আর ভালো থেকো। আর পৃথিবীর সব বাবা সন্তানদের ভরসা হয়ে বেঁচে থাকুক।

সমন্বয়ক, এগারজন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper