ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নারীবাদ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

মিথিলা আফসানা সিনথিয়া
🕐 ১:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০

“নারীরাও মানুষ” নয় বরং “নারী-পুরুষ উভয়ে মানুষ” এই ধারণার প্রসার ঘটাতেই উনবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদের উৎপত্তি হয়। তখন সমাজে নারীরা মৌলিক মানবাধিকার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল। মূলত নিজেদের অধিকারের অপূর্ণতা পূরণেই তৈরি হয় নারীর অধিকার আন্দোলন। নারীবাদ বা ফেমিনিজমের সূত্রপাত পশ্চিমা দেশগুলোতে, যে স্রোত অভিজাত থেকে আমজনতা সকলের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল। প্রথমদিকে নারী অধিকার সম্পর্কে আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের বিষয় ছিল ভোটাধিকার কেন্দ্রিক। নারীবাদের উৎপত্তিস্থল যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা কোনো প্রকার সম্পত্তির অধিকার, উইল বা আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষরের উপযুক্ত ছিল না। কেননা, তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কোনো কিছু ছিল না। এ ছাড়া ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, নির্বাচনে ভোটদান, বিচারক বা জুরিবোর্ডের সদস্য হওয়ার অধিকার। সেকালে সন্তানের আইনি কাস্টাডি, বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি ছিল না স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে অসম্মতি জানানোর অধিকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তারা ছিল বাবা, ভাই অথবা স্বামীর সম্পত্তি।

নারী আন্দোলনের প্রথম জোয়ারের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয় ১৮৪৮ সালে, ‘সেনেকা কনভেনশন ফলস’-এ। ৩০০ জন নারী-পুরুষ এ সম্মেলনে নারী অধিকারের পক্ষাবস্থানের সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম পর্যায়ের দাবিগুলো ছিল, ভোটাধিকার, রাজনৈতিক সমতা এবং আইনি অধিকার। এছাড়া কিছু কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সন্তান ধারণে নারীর সম্মতি সম্পর্কে জনমত গঠন করা হয়। এ আন্দোলনের প্রথম ধাপের পরিসমাপ্তি ঘটে সংবিধানের উনবিংশ সংশোধনীর মাধ্যমে, যেখানে সাংবিধানিকভাবে ১৮ বছর বয়স্কা নারীরা ভোটাধিকার প্রাপ্ত হয়।

১৯৬০ সালে নারীবাদী আন্দোলনের ২য় ধাপে নারীরা সমধিকারের বিষয়টি সামনে আনে । এ স্রোতের দাবিগুলো ছিল, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকার, সাংস্কৃতিক বৈষম্য লোপ, ক্ষমতার লৈঙ্গিক প্রয়োগ রোধ ইত্যাদি। কিন্তু এ দাবিগুলো বাস্তবায়নের ফলে নারীরাই সমস্যায় পড়ে। ঘর-বাহির দু’দিক সামলানো তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফলে অনেক নারী এ স্রোতের বিরুদ্ধাচরণ না করলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। ২য় ধাপের ভুলগুলোকে শোধরাতেই ৩য় ধাপের সূচনা হয় । শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা নারীদের সীমাবদ্ধতা দূর করাই ছিল এ ধাপের মূল উদ্দেশ্য। যেমন, নারীর পাশাপাশি পুরুষও সাংসারিক কাজে অংশগ্রহণ করবে।

আমাদের উপমহাদেশেও বেগম রোকেয়া নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের কা-ারী বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষা, অধিকার সচেতনতা নিয়ে কথা বলে গেছেন। সামাজিক ভারসাম্যের সমতায় নারীর অবদান দেখিয়েছেন। দেশের উন্নয়নে নারীও যে কত বড় মানবসম্পদ তার প্রেক্ষাপট সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে গঞ্জনার শিকল ভেঙে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বলা যায়, উপমহাদেশে বেগম রোকেয়া থেকেই নারী আন্দোলনের পদযাত্রা।

কিন্তু তৎকালীন নারীবাদ এবং বর্তমানের কথিত নারী আন্দোলনে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য বিরাজ করছে। বর্তমানে নারীদের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি ভোটাধিকার, উচ্চশিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়ার অধিকার, কর্মক্ষেত্রে প্রাধান্যসহ সকল অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে । তবে কি এখন নারীবাদী আন্দোলনের প্রয়োজন নেই? উত্তরটা হলো, অবশ্যই আছে। কেননা, নারীরা এখনো সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ধর্ষণের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পারিবারিকভাবে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। বছরে সারাদেশে হাজার হাজার নারী নির্যাতনের মামলা হয়। এ ছাড়া আরও একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে নারীরা পারিবারিক মতামতের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় না। ব্যক্তিগত জীবনে এখনো অনেক মেয়েদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

কিন্তু, দেশে কথিত নারীবাদীদের দিকে তাকালে যেন ভিন্ন কিছুই চোখে পড়ে। নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট বলে পরিচিতরা সর্বপ্রথম যে বিষয়টির সমালোচনা করে তা হলো নারীর পর্দা। ফেমিনিস্টরা নারীর পর্দা করা দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। বোরকা, হিজাব, ঘোমটা ইত্যাদি পোশাক তাদের প্রধান সমস্যা। নারী আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল, একজন নারী তার ইচ্ছেমতো স্বাধীন কাজ করতে পারবে। একজন নারীবাদী যদি তার পছন্দমতো আদর্শের ভিত্তিতে খাপছাড়া বাঙালি সংস্কৃতি বহির্ভূত পোশাক পরতে পারে, তবে একজন নিরপেক্ষ মেয়ে স্বেচ্ছায় বোরকা হিজাব পরতে পারবে না কেন? নারীবাদীদের জন্য প্রযোজ্য হলে অন্যদের জন্য তা হবে না কেন? পাশাপাশি অপসংস্কৃতির প্রসারে বর্তমান ফেমিনিস্টদের জুড়ি মেলা ভার। নবীন ফেমিনিস্টরা স্বাধীনতা বলতে বোঝে ফ্রি মিটিং, ওয়েস্টার্ন পোশাক, সন্ধ্যার পর বা রাত বিরাতে বাইরে থাকা, ধূমপান করা ইত্যাদি। তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌন বিদ্বেষী আবার কিছু ক্ষেত্রে অতিপ্রত্যাশী। ‘ছেলেরা পারলে মেয়েরা কেন পারবে না’ এমন বাক্য মনে পোষণ করে যাচ্ছে তাই করার নাম স্বাধীনতা নয়। সামাজিক শৃঙ্খলাকে টেক্কা দিয়ে তথাকথিত স্বাধীনতায় মত্ত হলে ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমাজের চোখে দোষী বলে গণ্য হবে। কোনো নারীই নারীবাদের বিরোধী নয়। তবে সেটা হওয়া চাই যুক্তিসঙ্গত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ। বর্তমান ফেমিনিস্টরা উগ্রতার মধ্য দিয়ে নারীবাদকে যে পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে আদৌ নারীবাদ বলে কি না সন্দেহ!

ধর্মহীনতা কিংবা ধর্মকে কলুষিত করা আদৌ নারীবাদের পর্যায়ে ছিল না। উপমহাদেশের নারীবাদীর অগ্রদূত বেগম রোকেয়াও প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি কুরআন শিক্ষার কথা বলেছিলেন। পাশাপাশি এটাও বলেছিলেন যে, কুরআন শিক্ষার কথা বলায় অনেকে তাকে গোড়া বলবে কিন্তু কুরআন শিক্ষাও প্রাথমিক শিক্ষারই অংশ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নয়, এই কথার শিক্ষা হলো, যেখানেই ভালোটা আছে তা গ্রহণ করা।

আমরা ফেমিনিস্টরা স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে নিজেরাই নাস্তিকতার কাছে পরাধীন হচ্ছি না তো? স্বাধীনতা মানে অন্যের স্বাধীনতা হরণ নয়। ‘নারীবাদ’ একটি আন্দোলনের নাম, যার ছায়াতলে অসংখ্য নারী অধিকারের, স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। সমাজসম্বন্ধীয় প্রত্যেকটি মতবাদ সমাজ সংস্কারের জন্য। তবে সমাজের সংস্কার করতে গিয়ে সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধাচরণ করা কখনোই কাম্য নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক নারী একটি সুস্থ, সামাজিক নারী আন্দোলনের প্রত্যাশী।

মিথিলা আফসানা সিনথিয়া : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper