সুঁই
মাহবুব আলী
🕐 ২:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
ময়লাটে নোট বাঁ-হাতে নিয়েই বুঝতে পারে, সেটি পাঁচ টাকার নয়; পঞ্চাশ। সাঈদ কী করে? ফিরিয়ে দেবে? এসে যখন পড়েছে হাতে, সব লাক, লটারি; আজ তার ভাগ্য ভালো। রাশিচক্রে প্রসন্ন দিন। তখন একজন বয়সী মানুষ পাশে এসে দাঁড়ায়। তিনি কিছু বুঝতে পেরেছেন কিনা কে জানে? সাঈদ একপলক দৃষ্টি দিয়ে কোনো সন্দেহ খোঁজে। দেখেছেন বলে মনে হয় না। তখন সে বৃদ্ধ দোকানিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে বসে। অসৌজন্যমূলক অথবা হয়তো অকারণ। কিছু কিনতে এসে খোশগল্প জমিয়ে তোলার কোনো অর্থ হয় না। তারপরও- ‘আপনার কি দেখতে সমস্যা?’
বৃদ্ধ অনেকটা খসখসে টাইপের মানুষ। কেমন পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে কথা বলছেন। সাঈদ প্রথম থেকে লক্ষ করেছে। এই গলিঘুপচি মতো ছোট্ট দোকানে প্রথম আসা। বৃদ্ধের যত না বয়স সেই তুলনায় বেশ অস্থির। একটু কি অমনোযোগী? কিছুক্ষণ আগে এক গ্রাহক কয়েকটি হ্যাঙার আর কী-সব কিনছিল। একটির দাম সত্তর অন্যটি ষাট। গ্রাহক দোকানিকে যোগ-বিয়োগ করে মোট মূল্য বলে। ‘তা হলে ষাট টাকা আর সত্তর মিলি হইল একশ বিশ।’
‘ক্যাংকরি? এখন কছেন এইটা ষাট টাকা আর ওদিক তোমহার সত্তুর... একশ বিশ ক্যাংকরি?’
সাঈদ এই জটিল অঙ্কের মধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ শুক্রবার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মোবাইল কোর্ট জেল-জরিমানা করতে পারে। মার্কেটের প্রায় সকল দোকান তাই বন্ধ। আজ পাওয়া যাবে না, ভেবে নেয় সাঈদ; অথচ কাজটি দরকারি। তারপরও যদি পাওয়া যায়, এই ‘যদি’-র ওপর ভরসা করে আসা। অন্যথায় কাজ আগামীদিনের জন্য রেখে দিতে হবে। সে এই গলি ওই গলি ঘুরে অবশেষে রাস্তার ওপর এক দোকানের দরজা খোলা পেল। এবং সেই সকল জিনিসপত্রের, যার জন্য আসা। ছোট একটি ঘর। পাঁচ ফুট প্রস্থ আর লম্বায় ছয়। মেঝেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্রস্ত জিনিসপত্র। সে সময় সেই গ্রাহক একটি টুলে বসে হিসাব করতে থাকে। দোকানি তার ঘষে যাওয়া অস্বচ্ছ কাচের চশমা দিয়ে জুলজুল দেখে যায়। বিকেলের আবছায়া আলো। বৃদ্ধ অনেকখানি বিভ্রান্ত। সেই ষাট যোগ সত্তরের হিসাব। যোগফল জটিল হয়ে ওঠে। শুভঙ্করের ফাঁকি। সাঈদ এরমধ্যেই জিজ্ঞেস করে, ‘খাতা সেলাই করার সুঁই আছে? বড় আর মজবুত?’
‘আছে আছে... সব পাবেন এখানে।’ দোকানি নয়, জবাব দেয় ক্রেতা লোকটি।
‘দাঁড়াও তো বা হে, ষাট আর সত্তুর ক্যাংকা হিসাব করিছেন? ...ও কী নেবেন বাবা?’
‘সুঁই... খাতা বই সেলাই করার... আছে?’
‘না। নাই।’
‘কেমন কথা হল? আপনার দোকান তো সুতা-সুঁই এসবের, অথচ নেই বলছেন।’
‘কতগুলা নেবেন?’
‘এই ধরেন দু-চারটা।’
তখন ওই গ্রাহক কথার মধ্যখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বোঝা যায় অস্থির হয়ে উঠেছে। অধৈর্য কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘শোনেন চাচা, ক্লিপ হ্যাঙ্গার ষাট টাকা আর সুতা সত্তর; এই হলো গিয়া একশ বিশ।’
সাঈদ কারও বিষয়ে কোনো মন্তব্য করে না। স্বভাববিরোধী কাজ, কিন্তু উপস্থিত একটি অঙ্কের ভুল হিসাব পীড়া দিতে শুরু করে। একটি শুঁয়োপোকা যেন মাথায় উঠে যেতে চায়। সে সাত-পাঁচ না ভেবেই আগ বাড়িয়ে বলে বসে, ‘একশ বিশ নয়, একশ ত্রিশ টাকা হয়।’
‘তাই তো মুই কছো, একশ বিশ ক্যাংকা করি হয়? তোমরা মোর মাথা খারাপ করি দিবেন বা রে।’
বৃদ্ধ এবার নড়েচড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখের চশমা খুলে হাতে রাখেন। পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে কাচ মোছা চলতে থাকে। ঘষে যাওয়া কাচ কি আবার স্বচ্ছ-পরিষ্কার হয়? কে জানে! সাঈদ ধৈর্য ধরে রাখে।
সেই গ্রাহক চলে গেছে। একশ ত্রিশ টাকা গুনে দিতে দিতে মুখ বেজার। কে জানে হিসাবের ভুল অথবা ইচ্ছে করেই এসব হয়। সাঈদ তেমন মনোযোগ দেয়নি অথবা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বৃদ্ধ যে অঙ্কে দুর্বল নন, সে নিশ্চিত; তবে সহজে কনফিউজ করে দেওয়া হয়ত সহজ। বয়সী মানুষের এমন হতেই পারে। তার দৃষ্টি খারাপ। চশমার কাচ ঘোলা। সাইদ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ঠিকমতো দেখতে পান না?’
‘কেমন করি বা?’
‘না, তখন থেকে দেখছি, আপনাকে সুঁইয়ের প্যাকেট ফেরত দিলাম অথচ অন্যদিকে হাতড়াচ্ছেন।’
‘চোখে ছানি বাবা, তিন মাস পর অপারেশন করা লাগবে। তাই ভালোমতো দেখা পাও না।’
‘এখন তো অপারেশন করতে হয় না। নতুন ড্রপ বেরিয়েছে, চোখে দিলে লেন্স পরিষ্কার করে দেয়।’
‘সত্যি বা? মোর তো অপারেশনের কথা শুনি ভয় লাগে। ব্যাডায় কয় সামনের মাসে চোউক কাটিবে। মুই কী করো!’
‘আপনার ছেলেকে বলেন, ভালো করে খোঁজ নিতে। আজকাল কাটাকুটি না করেও ছানি ঠিক করা যায়।’
এইসব গল্পের মধ্যে বৃদ্ধ টাকা ফেরত দেন। তার বাঁ-হাতের মুঠোয় পাঁচের বদলে পঞ্চাশ টাকার নোট। সাঈদ কী করে? সে হাত বাড়িয়ে আলগোছে দেখেও না দেখে নোট নিয়ে পকেটে রেখে দেয়। মাথার মধ্যে অবিবেচক এক অঙ্ক যোগ-বিয়োগ শুরু করে দিতে থাকে। সুঁই দুটোর মূল্য পাঁচ টাকা, সে দশ টাকার নোট দিয়েছিল, দোকানি পাঁচের পরিবর্তে পঞ্চাশ ফেরত দিয়েছেন। সুতরাং অঙ্কের হিসাবে লাভক্ষতি কত? পঞ্চাশ না পঞ্চান্ন? দোকানি একজন বয়সী মানুষ। কিছুক্ষণ আগে একজন দশ টাকা হাপিস করে দিয়েছিল আর কি! সাঈদের এখন কী করা উচিত? সে কি নোটখানি ফেরত দেবে? অথবা পকেটের মধ্যে রেখে আনন্দ মনে ফিরে যাবে? আবার মন চাইছে, জীবনে যা করেনি কেন তেমন হতে চলেছে? কয়েকটি মাত্র টাকা হাপিস করে নিজের দিকে কেন অপরাধ টেনে নিতে চায়? একদিন সেও বুড়ো হবে। তার চোখেও কি ছানি পড়বে? সেও হয়ত কোনোকিছু ঠিকমতো দেখতে পাবে না। এই আলোকিত পৃথিবীর বর্ণিল দৃশ্য নীল-লাল-হলুদ রঙ সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাবে? এসব ভাবতে ভাবতে কলার বাজারে এসে দাঁড়ায় সে। ভ্যানের ওপর কলার স্তূপ। কার্বাইড দিয়ে পাকানো। মানুষজনের ভিড়। তারা জেনে-বুঝেই কিনছে। সেও কিনে নেবে একটি ছড়ি। কলাওয়ালার নির্বিকার ব্যবসা। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। কে জানে তার অন্তরে অট্টহাসির হল্লা ফুলঝুরির মতো ফুটছে কিনা। আজকাল এমনই তো হয়। সব জায়গায় মিথ্যে আর প্রতারণার ফাঁদ। এসব দেখার কেউ নেই? আমাদের দৃষ্টিও কি আজ ঘোলা? ছানি পড়ে গেছে? অথবা সবকিছু জেনে-বুঝেই মেনে নিয়েছি? কে জানে ঈশ্বরের চোখেও ছানি পড়েছে কিনা? তিনি কি দেখতে পান?
সাঈদ এইসব ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি ভাবনার মধ্যে একছড়ি কলা কেনে। কলাওয়ালাকে দাম দিতে পকেটে হাত দেয়। আঙুলের ফাঁকে বেরিয়ে আসে পঞ্চাশ টাকার সেই নোট। তার দিকে তাকিয়ে থাকে কমলা রঙ কাগজ। আকস্মিক তার দৃষ্টি বুঝি অস্বচ্ছ হয়ে যায়। সাঈদ চোখ কচলে তাকায়। ভ্যানের ওপর কলার সাজানো ছড়িগুলো হলদেটে স্তূপ হয়ে গেছে। সামনে বসে থাকা মানুষের মুখ কেমন অদ্ভুত লাগে। সে কি মানুষ নাকি লুসিফার? এখন লুসিফার পৃথিবী চালায়। তার হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ অনুসারী। এই মানুষটিও তেমন একজন চ্যালা। সাঈদ আলগোছে কলা রেখে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। এখন সেই দোকানির কাছে যেতে হবে। বৃদ্ধ মানুষ। তার চোখে চশমা। সেই চশমার কাচ দুটো ঘষে যাওয়া সাদা মেঘের মতো। সেই মেঘের অপরপ্রান্তে পাথরের মতো দুটো চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি কী? তার রেটিনায় কোনো ছায়া খেলা করে? সাঈদের বুকপকেটে কাগজে মোড়ানো দুটো সুঁই। সে একটি নোটবুক সেলাই করতে চায়। জুস সেলাই শেখা আছে। নিজের পছন্দমতো সেই নোটবুকে প্রতিদিনের ভাবনা আর কাজের কথা লিখে রাখবে। একদিন আজকের হারানো দিন সেইদিন হয়ত পড়বে। কে কে পড়বে আর? সে অথবা অন্য কেউ। সেখানে এমন কথা যেন না থাকে, যেখানে কেউ একজন তার চোখে, দু-চোখের মণিতে সুঁই ফুটিয়ে দেয়; আর আকাশদিগন্তে অসহ্য আর্তচিৎকার।
সাঈদ যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।