ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সকালবেলার চা

বিশ্বজিৎ দাস
🕐 ১:৪৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২০

‘সারাদিন ঘরে থেকে কী করেন?’ জানতে চাইল রহমান। অফিসে সেলিমের জুনিয়র। তবে ওদের সম্পর্কটা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ।
‘কী আর করব বলো। কখনো নেটফ্লিক্সে মুভি দেখি। কখনো নেট চালাই। আর ঘুমের কথা কী বলব। আগে ঘরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুম দিতাম। এখন ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজ করি।’
করোনাকাল চলছে। মাস দুয়েক হলো সেলিমের অফিসের সবাই নিজ নিজ ঘরে বন্দি।

‘আপনি আবার ঘরের কাজ কী করেন?’ হাসতে হাসতে জানতে চাইল রহমান।
‘এই মাঝে মাঝে দুটো পেঁয়াজ ছিলে দিই। ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার পানি এনে দিই। এইসব টুকটাক কাজ আর কী।’
‘ব্যায়াম ট্যায়াম করেন না?’
‘ব্যায়াম করব কোথায়? ফ্ল্যাট বাসা। নড়াচড়ার জায়গা নেই বললেই চলে। কম্যুনিটির জন্য সেলুন, ব্যায়ামাগার আছে। তবে সেগুলো করোনার শুরু থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘সকালে উঠে হাঁটতে যেতে পারেন। অনেকেই তো সকালে হাঁটে।’
‘আর হাঁটা। রাত জেগে মুভি দেখতে দেখতেই তো অনেক রাত হয়ে যায়। সকালে কয়টায় ঘুম থেকে উঠি জানো?’
‘কয়টায়?’
‘এগারটায়।’
‘বাব্বাহ! এত বেলা করে উঠলে পরে কিন্তু অফিস খোলার পর সমস্যা হবে। অফিসে যাওয়ার পর চেয়ারে বসামাত্র ঘুম পাবে আপনার।’
‘বলছ?’
‘হ্যাঁ। শরীরের একটি সাইকেল অব চেইন আছে। সেটা নষ্ট করবেন না, প্লিজ।’
‘আমাকে কী করতে বলো?’
‘দু-একদিন কষ্ট করে সকালে উঠে হাঁটাহাঁটি করেন। দেখবেন অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনার দেখাদেখি ভাবিও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে। একসঙ্গে সকালে দুজনে বসে চা খাবেন। দেখবেন, বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে।’

দুই.
সত্যি সত্যি বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে সেলিমের।
মোবাইল ফোনে এলার্ম দেওয়াই থাকে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ওর ঘুম ভেঙে যায়। প্রাতঃকর্ম সেরে ফ্ল্যাট থেকে বের হতে ছয়টা সোয়া ছয়টা বেজে যায়। ততক্ষণে সূর্যটা বেশ উঠে আসে। হালকা রোদ গায়ে মাখতে মাখতে মুখে মাস্ক পরে হাঁটতে ভালোই লাগে সেলিমের। মুখে মাস্ক থাকার সুবিধা এটাই- কেউ ওকে চিনতে পারে না।
রুটিন বদলে নিল সেলিম। আগে রাতে ঘুমাতে যেত দেরি করে। উঠত দেরি করে। এখন ঘুমুতে যায় আগে। ঘুম থেকে ওঠেও আগে। ঘুম কম হলে দুপুরে আবার একটু ঘুমিয়ে নেয়।
রাবু প্রতিরাতেই বলে, ‘আমিও সকালে হাঁটতে যাব। আমাকেও নিয়ে যেও।’
প্রতিদিন সকালেই রাবুকে ডাকে সেলিম। সাড়া পায় না। বাধ্য হয়ে একাই হাঁটতে যায় ও। সকাল সকাল চা খাওয়ার যে বুদ্ধিটা রহমান দিয়েছিল, সেটা কোনো কাজেই লাগল না।
মেসেঞ্জারে কথা বলার সময় রহমানকে বিষয়টা বলল সেলিম।
‘আপনি ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে চা খেতে চান কি-না?’
‘চাই। শুধু আমি চাইলে তো হবে না। ওকেও তো বিছানা থেকে উঠতে হবে।’
‘আপনি কেন ভাবছেন, ভাবিই আপনার জন্য চা বানিয়ে অপেক্ষা করবে?’
‘তাহলে?’
‘আপনি হেঁটে এসে সরাসরি ইলেকট্রিক কেতলিতে পানি গরম করে নেবেন। সেই গরম জল কাপে ঢেলে টি ব্যাগ দিলেই তো তৈরি হয়ে যাচ্ছে চা। সেই চায়ের গন্ধে ভাবি আপনা থেকেই ঘুম জেগে উঠবে।’ হাসতে হাসতে বলল রহমান।
কথাটি মনে ধরল সেলিমের। ঠিক করল, আজই বাসায় ফিরে সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকবে ও। চা বানিয়ে ঘুম ভাঙাবে রাবুর। বেশ একটা সারপ্রাইজ হবে ব্যাপারটা।
ইলেকট্রিক কেটলিটা অনেকক্ষণ ধরে রান্নাঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজল সেলিম।
পেল না।
তারপর মনে পড়ল, কেটলি তো মাসখানেক ধরেই খারাপ হয়ে পড়ে আছে। করোনার লকডাউনের জন্য ঠিক করানোই হয়নি।
‘এ মা! চা এত কালো হয়েছে কেন? দেখেই তো রুচি হচ্ছে না।’ চা দেখে মুখ বাঁকা করল রাবু।
‘প্রথম প্রথম তো একটু হবেই।’ আমতা আমতা করল সেলিম।
‘পানি কোন পাত্রে গরম করেছ?’
‘ছোট একটা ডেকচি আছে নাÑ সেটাতে।’
‘যে কাজ পারো না, সেই কাজ করতে যাও কেন।’ ধমকে উঠল রাবু।
‘মানে?’ থতমত খেয়ে গেল সেলিম।
‘ওটা তো দুধ গরম করার পাতিল। ওটাতে চা বানালে পরে কি দুধ গরম করা যাবে? যত্তসব।’
মনটা দমে গেল সেলিমের।
ঠিক করল, পরদিন আর যাই হোক এই ভুল করা যাবে না।
‘কোন পাত্রে চা বানাব, দেখিয়ে দাও তাহলে।’
‘তোমাকে বানাতে হবে না।’ হুকুম করল রাবু।
‘তাহলে?’
‘সকালে হেঁটে এসে আমাকে ডাকবে। আমিই বানিয়ে দেব।’
মনে মনে প্রমাদ গুনল সেলিম। রাবু’র অপেক্ষায় থাকলে চা খেতে খেতে এগারটা বাজবে।
পরদিন হেঁটে এসে রাবুকে ডাকল না সেলিম। আগেই ঠিক করে রেখেছে, যাই ঘটুক, চা নিজেই বানাবে।
চায়ে চুমুক দিয়েই মুখ বাঁকাল রাবু।
‘ছি ছি! এটা কোন চা হলো?’
‘কেন। কী হয়েছে বেবি?’
‘শুধু গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই চা হয় না, বুঝলে? মনে হচ্ছে, গরম পানি খাচ্ছি।’
কী জবাব দেবে ভেবে পেল না ও।
‘রহমানের বুদ্ধি তো দেখি কাজে আসছে না।’ বিড়বিড় করে বলল সেলিম।
‘কী বললে?’
‘কিছু না। কিছু না।’
বিষয়টা নিয়ে রহমানের সাথে চ্যাট করল সেলিম।
‘ভাবি হয়তো লাল চা পছন্দ করে না। দুধ চা পছন্দ করে।’
‘সে রকম হলে তো আমিই আগে জানব, তাই না? রাবু লাল চা-ই পছন্দ করে।’
‘তাহলে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিয়ে দেখতে পারেন।’
পরদিন সকালে রহমানের কথা রাখল সেলিম। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিল রাবুকে। টোস্ট বিস্কুট। আশা করল, রাবু মেজাজ দেখাবে না।
ঘটল উল্টোটা।
বিস্কুট দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল রাবু।
‘আমাকে কি তোমার রাক্ষস বলে মনে হয়?’
‘মানে।’
‘সকাল সকাল বিস্কুট কেন খেতে দিয়েছ?’
‘খালি পেটে শুধু চা খাবে! তাই বিস্কুট দিয়েছি।’
‘তোমার ওই বিশ্রী চায়ের সঙ্গে বিস্কুট আমি খাব না। যত্তসব।’
মনটা বেশ খারাপ হলো সেলিমের। ঠিক করল, আর সকালে ফিরে এসে চা বানাবেও না। রাবুকে জাগিয়েও তুলবে না।
পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠল রাবু। উঠেই একগাদা প্রশ্ন করে বসল।
আজ হাঁটতে যাওনি?
আজ যে আমাকে ডেকে তুললে না?
আজ চা বানাওনি?
আজ কি চা খাওনি?’
আমাকে ডাকলেই পারতে?
সেলিম কোনো প্রশ্নের জবাব দিল না। চুপচাপ পেপার পড়তে লাগল। আস্তে আস্তে চা বানানোর কথা ভুলেই গেল সেলিম।
সপ্তাহখানেক পরে হেঁটে এসে ঘরে ঢুকতেই চমকে গেল সেলিম।
ডাইনিং টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে রাবু।
‘এত দেরি করলে যে। সেই কখন থেকে চা বানিয়ে বসে আছি- একসঙ্গে চা খাব বলে।’
অমনি একরাশ রাগ আর অভিমান এসে জমা হলো সেলিমের মনে।
‘চা খাব না।’ ঘোষণা দিল সেলিম।
‘কেন?’
‘এমনি ইচ্ছে করছে না।’
ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল রাবু।
‘কী হলো, কাঁদছ কেন?’
‘একশ’বার কাঁদব। হাজারবার কাঁদব। তাতে তোমার কী! এত শখ করে সকাল সকাল উঠে তোমার জন্য চা বানালাম, আর এখন বলছ খাব না। ভেবেছ আমি কিছু বুঝি না।’
‘মানে?’
‘প্রতিদিন সকালে কোথায় হাঁটতে যাও- আমি তো আর দেখি না। নিশ্চয়ই তোমার প্রাক্তন প্রেমিকাদের কারো বাসায় যাও। গিয়ে চা খেয়ে আসো। তাই তো আমি চা বানালে ভালো লাগে না।’
আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল রাবু। যেন চোখের পানি দিয়েই তেতো চা খাইয়ে দিল সেলিমকে। সকাল সকাল।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper