ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চট্টগ্রাম নৌ বাণিজ্যে টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না

আরিচ মাহমুদ
🕐 ৯:৫৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০২০

করোনাকালে একটানা ২ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে চট্টগ্রাম নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওভারটাইমসহ নানা কায়দায় অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে লকডাউন চলাকালে প্রায় দুই মাস কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রধান কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন। এ অনুপস্থিতির মধ্যেও তিনি ওভারটাইম (ওটি), জাহাজের সার্ভে, সুপারভিশন ফি, এনওসি প্রদান, ওয়েভার চার্জ বাবদ প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিল-ভাউচার বানিয়ে তা উত্তোলন করেছেন। ঈদের পর সরকারি ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগ দিয়েই ব্যাক ডেইটে স্বাক্ষর করে তা আদায় করেন সরকারি এই কর্মকর্তা। মাত্র পাঁচ দিন অফিস করে আবারও বিনা ছুটিতে ২০ দিন অনুপস্থিত তিনি।

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি জাহাজের তদারকি করতে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন চট্টগ্রামে রয়েছে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট বা নৌ বাণিজ্য অধিদফতর। এ অধিদফতরের বর্তমান প্রধান (প্রিন্সিপাল অফিসার) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন। তার বিরুদ্ধেই উঠেছে নানা অভিযোগ। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না এ দফতরে। ক্যাপ্টেন গিয়াস প্রধান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ভর করেছে এ দফতরে। এর আগে তিনি ঢাকায় ডিজি শিপিং অফিসের নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ১০ অক্টোবর তিনি চট্টগ্রামে নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রিন্সিপাল অফিসার পদে যোগ দেন।
এ প্রসঙ্গে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’

জানা গেছে, গত মার্চে দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৪ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনের (স্মারক নং ০৫.০০.০০০০.১১০.০০.০৪০.২০.৩৪৭) মাধ্যমে সরকারি ছুটির সময়ে কর্মকর্তাদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সরকারি ছুটির পুরোটাই পরিবার নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করেছেন। নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের অন্য কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সরকারি ছুটি শেষে ঈদের পর তিনি কর্মস্থলে যোগ দেন। মাত্র ৫ দিন অফিস করে আবারও বিনা ছুটিতে চলে যান ঢাকায়। এই পাঁচ দিনে তিনি আগের আড়াই মাসের জমে থাকা ফাইল স্বাক্ষর করেন ব্যাক ডেইটে। এভাবে প্রতি মাসেই অধিকাংশ সময় তিনি কর্মস্থল চট্টগ্রামে না থেকে ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করেন।

লকডাউনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা সরকারি সব ফি দ্বিগুণেরও বেশি আদায় করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) প্রেসিডেন্ট আহসানুল হক চৌধুরী গত ৯ এপ্রিল লিখিত অভিযোগ (স্মারক নং বিএসএএ/১২৪/২০২০/৩২) করে বাড়তি টাকা আদায় বন্ধ করার জন্য ডিজি শিপিংয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

জরুরি পরিসেবা সংস্থা হিসেবে নৌ বাণিজ্য অধিদফতর লকডাউন সময়েও খোলা ছিল। তবে অফিসিয়াল সব কাজ হয়েছে অনলাইনে। কাজকর্ম অনলাইনে হলেও ওভারটাইম নিতে ভুল করেননি এ দফতরের কর্মকর্তারা। নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেন, এ দফতরের অনলাইন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে সংস্থাকে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাও ক্যাপ্টেন গিয়াসের নিকট আত্মীয়। অফিস থেকে অনলাইনে সার্টিফিকেট ইস্যুর জন্য আলাদাভাবে অনলাইন চার্জ নেওয়া হয়েছে ১৫০ টাকা করে। সরকারি ছুটি চলাকালে এ দফতরের সব কাজ হয়েছে অনলাইনে। তারপর ওভারটাইম আদায় করেছে একটি চক্র।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করে বলেন, লকডাউন চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ২৯৫টি জাহাজের এনওসি (অনাপত্তিপত্র) সার্টিফিকেট দিয়েছে নৌ বাণিজ্য অধিদফতর। এনওসি প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি দুই হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিটি জাহাজ থেকে বাড়তি তিন হাজার টাকা যোগ করে মোট পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে আগত ১২৫টি বিদেশি জাহাজ থেকে ওয়েভার চার্জ বাবদ দুই হাজার টাকার স্থলে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন শিপিং কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করোনা মহামারিতে সরকারি ছুটির মধ্যে কোনো জাহাজ সার্ভে করা হয়নি। সার্ভে ছাড়াই বিদেশি জাহাজের পোর্ট স্টেট কনট্রোল ইন্সপেকশন (পিএসসিআই) সার্টিফিকেট প্রদানের নামে একেকটি বিদেশি জাহাজ থেকে তিন হাজার ডলার করে আদায় করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে এসব অনিয়মে নেতৃত্ব দিয়েছেন নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের তৃতীয় অবস্থানে থাকা কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম। জাহাজ মালিকদের জিম্মি করে নৌ বাণিজ্য অধিদফতরে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটকে খুশি না করলে ফাইল চাপা পড়ে থাকে দিনের পর দিন।

এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, মার্চের শেষদিকে সরকারি ছুটি শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকটি জাহাজের সার্ভে হয়েছে। সার্ভের ক্যাটাগরি অনুযায়ী পাঁচ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি আদায় করি। এর একটি অংশ সরকারি কোষাগারে যায় এবং বাকিটুকু আমরা কর্মকর্তারা পাই। সরকারি ছুটি চলাকালে নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের অন্য কোন কোন কর্মকর্তা জাহাজ সার্ভে করেছিলেন তা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারি ছুটির প্রথম দিকে আমরা এনওসি এবং ওয়েভার চার্জ আদায়ের ক্ষেত্রে ওভারটাইম আদায় করেছিলাম।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওভারটাইম নেওয়া বন্ধ করি। সরকারি ছুটি চলাকালে অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, আমি ঈদের পর অফিসে যোগদান করি। এক সপ্তাহ অফিস করে আবার ছুটিতে আসি। এ বিষয়টি নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালককে অবহিত করেছি। নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের বিভিন্ন অনিয়ম বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, লকডাউন (সরকারি ছুটি) চলাকালে নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রিন্সিপল অফিসার অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন বিষয়টি আমার জানা ছিল না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।

 
Electronic Paper