ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তিনি ইতিহাসের নায়ক

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১২, ২০২০

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলা সাহিত্যের বিদগ্ধ প-িত প্রয়াত ড. মুহম্মদ এনামুল হক বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে অভিহিত করেন। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলমান সমাজে দু’জন প্রভিভাবান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ মুজিব লুপ্ত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি জাতিকে সাহসী মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত লাভ করিয়েছেন।

আগস্ট মাস শোকের মাস। আগামী ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদত বার্ষিকী। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট কতগুলো বিপথগামী সামরিক অফিসার তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহাকলঙ্ক। 

বর্ষ পরিক্রমায় আমরা এ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করি। করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ১৫ আগস্ট পালন হবে এবার। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে যে অমানিশা নেমে আসে সে ঘটনাকে আমরা কোনোক্রমেই সমর্থন করতে পারি না। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালনের মধ্য দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে থাকি। বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে শোষিত বাংলাকে সোনার বাংলা করার জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন। নিজের জীবন দিয়ে বাংলার মানুষের ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করে গেছেন। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এ দিনে টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে মুজিব জন্মগ্রহণ করেন। মুজিব তার সাংগঠনিক দক্ষতায় বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে আসেন। সুযোগ্য নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এ কাজ করতে তাকে যৌবনের সোনালি দিনগুলো তার কারাগারের মধ্যে কেটেছে। অনেক দুঃখ কষ্ট নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। বাংলার হাজার বছরের ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সুখী সমৃদ্ধ শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যে অবর্ণনীয় ত্যাগ শিকার করেছেন এজন্য জাতি মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। মুজিব পরাধীন শাসনে আবদ্ধ শোষণ নির্যাতিত বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার মানসে সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা বাংলার গণমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। মুজিবের ডাকে বাংলার কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। দেশমাতা মুক্তি পায়। মুজিব বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। বাঙালির দুঃখ কষ্ট দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি সুস্পষ্ট কতগুলো পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তার চিন্তা চেতনায় প্রাধান্য পায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, সকল ধর্মের বসবাসের উপযোগী ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। মুজিবের এ পরিকল্পনাকে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনও বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর এ ধ্যান-ধারণা অনেকেই গ্রহণ করতে পারেনি। তাই পুঁজিপতি রাষ্ট্রব্যবস্থার অধিপতি, স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী, দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের ফলে বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পশ্চিম র্জামান নেতা উইলি ব্রান্ড বলেছিলেন, ‘বাঙালিকে আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ ইতোমধ্যে মুজিব হত্যার অধিকাংশ ঘাতকদের বিচার হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত দুজন খুনিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সব খুনিদের বিচার করে বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মতো উদার, গণতন্ত্রী রাজনীতির কবি যিনি নীতি, আদর্শ, ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল মহিমায় কোনো নেতা শুধু বাংলাদেশে কেন দক্ষিণ এশিয়ায় আর আবির্ভূত হবেন না। বাঙালির ত্রাণকর্তা স্বাধীনতার মহানায়ক যিনি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ৭২ সালের আট জানুয়ারি যখন লন্ডনে পৌঁছান তখনও কিন্তু ব্রিটেন আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। দিনটি ছিল শনিবার। ছুটির দিনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের বাইরে চেকার্সে অবকাশযাপন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান জানাতে তিনি ছুটে এসেছিলেন ক্লারিজ হোটেলে। ১০ ডাইনিং স্ট্রিট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এডওয়ার্ড হিথ তাকে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান আর কোনো নেতা কী বাঙালি জাতির জীবনে আসবেন যার গাড়ির দরজা খুলে কোনো ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী সম্মান জানাবেন? এমন দৃশ্য বাঙালি জাতির জীবনে আর আসবে না। শুধু ব্রিটেন নয়, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট শেখ মুজিব বিশ্বের যেখানেই গিয়েছেন তিনি বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর মহান জাতীয়তাবাদী নেতাদের যেমন একজন ছিলেন তেমনি দূরদর্শী রাজনীতিবিদ, ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের আর জন্ম হবে না।

তবে সাফল্য ব্যর্থতা নিয়েই মানবজীবন। শেখ মুজিব তার ঊর্ধ্বে নন। তার জীবনে সাফল্যের যেমন সুউচ্চ পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। কেননা পৃথিবীর কোনো নেতৃত্বই ষোল আনা নির্দোষ নয়। সবচেয়ে বড় কথা তিনি একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন এবং শিখিয়েছিলেন অধিকার আদায়ের ভাষা। তার দৃঢ় রাজনৈতিক ভূমিকা দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ সোপানটিতে পৌঁছে দেয়। তাই একথা আমাদের স্বীকার করতে হবে, এমন মহান ব্যক্তি যুগাবতার অনেক জাতির ভাগ্যে জোটেনি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সংবিধান প্রণয়ন, মানচিত্র, ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার, দেশ পুনর্গঠনের সফলতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তার সাহসী দেশপ্রেম, আপসহীন নেতৃত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে আপসহীন চরিত্র কীভাবে জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ চরিত্রে পরিণত হয় তা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় ও বিস্ময়করও বটে। তার মতো একজন সংগ্রামী নেতাকে পেয়েছিলাম বলেই স্বাধীন দেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সোনার বাংলা। এ লক্ষ্যে তিনি এগিয়েছিলেন কিন্তু ঘাতকরা তাকে আর এগোতে দেয়নি। তার আদর্শ বাস্তবায়ন ও তার প্রতি যথার্থ ভালোবাসাই সোনার বাংলায় পরিণত হবে এ দেশ। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন।

জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে তার মর্যাদা সমভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, দলীয় বলয় থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে। তাছাড়া ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনে নেতা উপ-নেতাদের বিশাল আকারের ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি এতটাই ছোট করে ছাপানো হয় যার কারণে প্রথমেই চোখ পড়বে নেতাদের ছবির ওপর। এতে করে বঙ্গবন্ধুকে কি ছোট করা হচ্ছে না? যত্রতত্র বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারে তার মানমর্যাদা কী বৃদ্ধি পাচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে তাকে যথার্থ সম্মান জানাতে হলে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, নীতি, আদর্শগুলো তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তোলাই হবে তার প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো। বাঙালি বলে আমাদের কোনো পরিচয় ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি সারা বিশ্বে আমরা যে বাঙালি তার পরিচয় তুলে ধরে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : শিক্ষক ও লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper