ঈদ, কখন এসে কই গেল!
ইমরুল কায়েস
🕐 ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৬, ২০২০
আজকের বর্তমান, কালকের অতীত। আর অতীত ভালো হলে ভবিষ্যৎ ভালো না হয়ে ব্যতিক্রম ছাড়া খারাপ হয় না। গত প্রজন্মের পরিবেশের প্রতি জুলুমের কারণে করোনা দ্বারা আমরা মজলুম। আবার আমাদের উদাসী দায়িত্বে সামনের প্রজন্ম ভুগবে। করোনা আমাদের দুটি উৎসব কেড়ে নিল কোনো করুণা করা ছাড়াই। চিন্তায় বুকের মধ্যে চিনচিন করে ইটের চিমনির মতো আগুন ধিকধিক জ¦লছে। না জানি, অনাগত সব শিশুকে সারা জীবন মাস্ক পরে থাকতে হবে কিনা! তাহলে সেই শিশুরা আমাদের হুকুমের আসামি করবে। বর্তমানের কোনো সদুত্তর দিতে পারব না। যাই হোক চলতি বছরে যে দুটি ঈদ (আবার ‘ইদ’ কিনা! নতুন বানানে হ্রস্ব ই কার দীর্ঘ ই কারের মারপ্যাঁচ) আমরা পালন করলাম এমন ঈদ যেন আমাদের সন্তানদের জীবনে না আসে। ঈদ না হলেও যেন ইদের ইদিটা ওদের থাকে।
মাস্কে ঢাকা বিষণ মুখের ঈদ উদযাপনকে, ঈদ বলা যায় না। উৎসবে যদি মন চনমনিয়ে চাঙা না হয়ে ওঠে তবে কীসের সেই উৎসব! দিনকে দিন আমরা সরস থেকে নিরসের দিকে ধাবিত হচ্ছি। হয়ত উৎসবগুলোও আমাদের দূষিত মনের বাতাস পেয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অভিমান করে বলছে- ‘স্বভাবে ধনী হলে অভাব হয় না।’ আমাদের শুধু নয়, এখন পুরো বিশ্বের মানুষের স্বভাবে সদভাবের বালাই নেই। কারণ আচরণে আমরা মুখায়বের শ্রী থেকে বেড়িয়ে মুখোশের অভিনয়ে মত্ত। আমরা যত বেশি মেকি হব তত আমাদের নিখাঁদ অনুভূতির উৎসব-পার্বণগুলো বেদনাময় হয়ে উঠবে। সামনে আরও কঠিন থেকে অতি জটিল সময় ধেয়ে আসছে। তাই সাধু শতবার সাবধান।
রঙ্গ ভরা বঙ্গদেশের মুখ আজ মলিন। সতের কোটি সন্তান আজ প্রতিনিশি প্রতিদিন হাপিত্যেশ করছে। সদা এই ভাবতে হচ্ছে- জীবন না জীবিকা! জীবন জীবিকার দোলাচলে পড়ে এক পা বাইরে থাকে তো; অন্য পা ঘরের ভেতরে। পিছু ছেড়ে আসতে নারাজ পা- ঘরের কোনায় লুকিয়ে থাকা প্রিয়জনের আতঙ্কিত মুখ আর ভরসার হাতগুলো বারবার বলে না না বের হয়ো না। কিন্তু ঐ যে সহজ কথার প্রবাদ আছে- ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। এখন অবস্থা এমন বাঁচতে হলে করোনায় নয় ভয়। মারি করোনার সঙ্গে আমাদের এখন মাত্র সমঝোতা স্মারকের কাল চলছে। সামনে আসছে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের পর্ব।
এই চুক্তিতে থাকবে- হয় করোনা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে; নয়ত আমরাই স্থান ছেড়ে দেব। পৃথিবীর রাজত্বে সেইই থাক প্রজাবিহীন রাজশাসনে। অপেক্ষা শুধু কে জয়ী হয় তা দেখার। তবে ফেলে আসা পৃথিবীর মহামারির ইতিহাস বলছেÑ এ যুদ্ধে শেষমেষ মানুষই জয়ী হয় জীবনের দামে। আর কত জীবন, সময় ও উৎসব উৎসর্গ করলে এই মারির উদরপূর্তি হবে তা স্বয়ং উপরওয়ালাই ভালো বলতে পারবেন।
বেশ মুখচলতি একটি প্রবাদ আছে- ‘যদি পরে কহর ছেড়ো না কো শহর’। কিন্তু করোনা এসে ঢাকাবাসীর অনেককে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে আসা নীড়ের দিকে ছুটতে হয়েছে। এখনো অনেক পিকআপ রাস্তাজুড়ে- জবুথবু হয়ে তাঁবুর নিচে ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের পানে ছুটছে পরিবার। শহর ফেলে দিলেও গ্রাম যে মা। কোথায় ফেলবে এই বিপদের দিনে। তো এই ঢাকা ফেরত মানুষগুলোর এবারের গ্রামে ঈদের স্বাগতম কি গত বছরের ঈদযাত্রার মতো? না এবার যাওয়া অভাব নিয়ে। এমন অভাবে গ্রামে গিয়ে এমন মানুষগুলোর গেল ঈদ কখনোই আনন্দের হয়নি।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের সব পরিবারের মধ্যে অর্ধেক পরিবারের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে বা কেউ না কেউ থাকে। অভাবে, রোগে, শোকে, শান্তি পেতে, নিয়োগ পেতে, পরবাসে যেতে, ইত্যকার যে যাই করতে চাই না কেন সবাইকে রাজধানীতে আসতেই হয়। সেজন্য আমাদের রাজধানীটি রাজার আবাসে স্বগর্বে মহীয়ান। কিন্তু এই মহামারির কালে ঢাকা তার বুক থেকে হাজার হাজার অভাবী ভাগ্যসন্ধানী মানুষদের ফেরত পাঠাচ্ছে। কাউকেই আর আগলে রাখতে পারছে না। কারণ দেশের অর্থনীতি করোনা লকডাউনে লক হয়ে আছে। এ অবস্থা কেটে অর্থনীতিকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে আরো বেশ খানিক পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু ততদিনে ঢাকা থেকে মানুষ এখন ফেলে আসা নীড়ে ছুটছে। হয়ত কোনো গাঙের ধারে বা নদীর কূলে এক বা দুই শতাংশ জমির বসতভিটে আজও আছে। ঘর বলতে দাদা বা বাবার রেখে যাওয়া মরচেপড়া পুরনো টিনের একখানি ঘর। সেই ঘরে ঠাঁই নিচ্ছে পরিবার ছেলেপুলে নিয়ে। কী করবে? যে ঘরের চালে ঝকঝকে নতুন আনোয়ারের কুইন ব্রান্ড ঢেউটিন বা কেওয়াই স্টিলের চিকন মুরগি মার্কা ঢেউয়ের টিন দিয়ে নতুন করে ঘর করবে। আর সুখের বৃষ্টির ছন্দের ঢেউ তুলবে। তা আর হয়ত হল না।
প্রতি ঈদে স্বাভাবিক যে চিত্র- লঞ্চে, ট্রেনে, বাসে, বিমানে যেমন উপচেপড়া ভিড় তেমনি ঈদযাত্রা নিয়ে হাতাহাতি বা মারামরি ও ছোটাছুটির অন্ত থাকে না। লক্ষ্য করার বিষয়, এবারের কোরবানির ঈদের এর কোনো চিত্রই গত বছরের মতো নয়। ঈদ এমন একটি উৎসব যেখানে শুধু থাকে খুশির ফোয়ারা। টাকা ব্যয় করার শ্রেষ্ঠ আনন্দ একমাত্র ঈদেই মেলে। ঈদের আনন্দ মানে ব্যয়ের আনন্দ। ঢাকাবাসী সারা বছর কষ্ট করে টাকা জমায় বা কাটছাঁট করে টাকা পাঠিয়ে দেয় গ্রামের পরিজনের কাছে। এবার চিত্র কিন্তু উল্টো হয়েছে। কোথায় ঢাকাফেরত মানুষ ঈদে গ্রামের মানুষের জন্যে ইদি নিয়ে যাবে সেখানে তল্পিতল্পাসহ ছুটতে হচ্ছে। গ্রামের পরিজন চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে ঢাকানিবাসীর ওপরে। সবাই আপন আলয়ে ছোটেÑ বছরে দুটো দিন মনের সুখে মা-বাবা কিংবা যাদের বাবা-মা নেই তাদের পাড়া প্রতিবেশী, অন্যান্য আত্মীয় আছে তাদের সঙ্গে ভালো জামা, ভালো রান্না ও ভালো যানবাহনে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে আসার সুযোগ এ ঈদে হয়নি।
এ বছর দেখতে দেখতে দুটি ঈদই চলে গেল। ঈদুল ফিতরে কারো সেমাইয়ে কারো দাওয়াত হয়নি। যেন এমন হয়েছিল যার সেমাই তার চামচ। কোরবানিতে গরু এবার তেমন কেউ নিজ হাতে ধরেনি। চুক্তিতে সব করে নিয়ে রান্না বা মাংস বিতরণ। কোলাকুলি কোনো ঈদে হল না। এমন করে তো আনন্দ উদযাপন হয় না। শোক যাপন হয়। আশা ছিল হয়ত করোনা করুণা করে বা অলৌকিকভাবে কোরবানির ঈদের আগে বিদায় নেবে কিন্তু না করোনার মাঝেই কোরবানি ঈদ কাটল। কেমন করে ঈদ এল আর কীভাবে চলে গেল কোনো কিছু ঠাওর করা গেল না।
ঈদুল ফিতরে মানুষের হাতে টাকা ছিল কিছু। তাই লকডাউনের শিথিলতায় কিছু কেনাকাটা করেছিল। কোরবানির এই ঈদে প্রতি দশ পরিবারের দুই পরিবার কোনো রকম করে কমের মধ্যে কোরবানি দিয়েছে। কারণ রাজধানী থেকে আয় করে মানুষ খুব একটা টাকা গ্রামে পাঠাতে পারেনি। ঢাকার চাকুরে থেকে মুটে মজুর সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানোসহ নানাবিধ ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে মুটে থেকে বড় ব্যবসায়ী সবার হাত এখন- ভাঁড়ের মা ভবানী। তাই ঈদের ছিল না কোনো সরগরম ভাব। ছিল না কোনো কোলাহল।
না কোরবানি, না প্রিয়জনের জন্য নতুন কোনো উপহার। বরং ঢাকার বাড়ি গুছিয়ে কোনো রকম পিকাপ ভাড়ার জুটিয়ে গ্রামের সেই ছেড়ে আসা অভাবি সংসারে বোঝা হয়ে যাওয়া। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বড় চাপ পড়ছে। একটি নতুন জনকোলাহল ও কৃষি সম্পদের ওপর আলাদা চাপ পড়ছে। ইতোমধ্যে টানাটানি শুরু হয়েছে। যে আত্মীয়রা এতদিন ঈদে মুখিয়ে থাকত কখন আসবে? এবার কিন্তু উল্টো রথ! ফলে গ্রামে সেরকম আহামরি উৎসবের নিশানা এবার ঈদে হয়নি। দুইদিন আগে গেল কোরবানির ঈদে তাই ঢাকাফেরত আর স্থায়ী গ্রামীণ বাসিন্দাদের মধ্যে মনে মনে একটি ভাগাভাগির বোঝাপড়া শুরু হয়েছে।
সবাই কেমন যেন একটা ঘোরতর দুঃখবোধ নিয়ে চিন্তিত। যাই করি, যাই খাই, আর যেখানে যাই না কেন কেমন জানি একটা অস্তির আর অস্বস্তির ঘোরলাগা আবহাওয়া বিরাজ করছে। এমন আতঙ্ক আর অস্বস্তি নিয়ে কোনোদিন আনন্দের ঈদ জমে না। জমেও নাই। বছরের দুটো ঈদ এমন বেখাপ্পা আর বেরসিকভাবে চলে গেল যে কেউ বুঝতেই পারলাম না।
আশপাশের এমনকি নিকট অনেকজন পরিবার পরিজনকে ঢাকা থেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু নিজের কর্ম থেকে ছাঁটাই হওয়ার ভয়ে রয়ে গেছে। চাকরিটি টিকে না থাকলে কই যাবে। যার আবার চাকরি চলে গেছে; বা চাকরি নেই, যে শিক্ষকের স্কুলের বেতন নেই; যে টিউটরের টিউশনি নেই, যে উকিলের মক্কেল নেই; যার বই বিক্রি নেই; মঞ্চদলের নাটক নেই; যে পরিচালকের হাতে সিনেমা নেই; যে হলের টিকিট বিক্রি নেই; যে রেস্তোরাঁয় মানুষ নেই; ফুটপাতের আইসক্রিম ঝালমুড়ি বিক্রি নেই এমন হাজারো নেই এর মাঝে কখনো কোনো উৎসব জমে না। এমন অনেক নামী বেনামী কর্মের কর্মজীবীদের কর্মের আর জায়গা নেই। সংসারে দু’পয়সা আসার কোনো ফুটো নেই। ফলে একটি বেরসিক ঈদ গেল।
গ্রামের অর্থনীতি এমন দুই ঈদে ও উৎসবে চাঙ্গা হয়ে উঠে। নতুন একটা আবহ পায়। সঙ্গে ঢাকাফেরত মানুষের ব্যাপক আনাগোনা বেড়ে যায়। দোকানি থেকে মুচি সব জায়গায় বাড়তি আয়ের সুযোগ আসে ফলে আনন্দ বেড়ে যায়। কিন্তু গেল দুই ঈদে কে কার জন্যে বাড়তি খরচ করবে। সবার অবস্থা এখন- দিন পার করলে বাঁচি। এবার রাস্তায় রিকশামামারা আর হাত বাড়িয়ে বলেনি- মামা, ঈদের বোনাস! সেলুনের কোনো কারিগরই এ কথা বলেনি। কে কার কষ্টের দিকে তাকাবে। মনে মনে দুপক্ষের একটা আফসোস থেকে গেল।
এমন সৃষ্টিছাড়া ঈদ আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। আনন্দ যেন আজীবনের জন্যে বিদায় নিল। মাস্ক পরে থাকতে থাকতে এখন সবাই হাসতে ভুলে গেছি। তাই এবার ঈদের আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মোবাইল ফোন কোম্পানির কোনো দুই তিনশ’ এসএমএস কিনব না।
সেই টাকা দিয়ে দেব কোনো দিনমজুরকে। একবেলার ঈদের বাজার করার জন্যে। তাই করেছি। মলিন মুখে অতৃপ্ত মনে হাজার হাজার মানুষকে মিথ্যে অভিনয় করে সুখের বার্তা দিইনি। হাজার জনের মুখে হাসি না ফোটাতে পারলেও একজনের একবেলার অভাব তো দূর করা যাবে।
উৎসবে নতুন নতুন ব্যবসা হয়। নতুন জামা কাপড়; আরও কত ব্যবসা। এবার গেল ঈদে ভিন্ন চিত্র। এমন করেই গেল ঈদ। চারপাশে শুধুই হাহাকার আর গোমড়া মুখ। মাস্কে ঢাকা মুখগুলোর কপালে, নাকে আর কানে বসে যাওয়া দাগগুলো বারবার কেন জানি মনে করিয়ে দেয় আমরা মানুষ হিসেবে কোথায় যেন একটা ভুল করে যাচ্ছি। জানি না এক প্রজন্মের ভুলে আরেক নতুন সম্ভাবনাময় সভ্যতার সূচনা হবে কিনা। তবে সামনে নতুন সময় আসছে; তাই নতুন করে ভাবতে হবে। অনাগত ঈদ আবার ভার্চুয়াল ইমোজিতে ইদি দেব নাকি সামনে থেকে কোলাকুলি করে নেব। দিন শেষে দায়টা কিন্তু বর্তমানের!
যতনে রতন মেলে। পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি হেঁয়ালি না হয়ে খেয়ালী হলে বুঝি এমন বিষণœ বদনে কোনো উৎসব পালন করতে হবে না। মানুষের হাসি কেড়ে নিলে জড় আর মানুষের মধ্যে কি পার্থক্য থাকে। প্রতিটি মাস্ক প্রকৃতির প্রতীকী কড়া থাপ্পড় যা আমাদের মুখে চেপে আছে। গানের ভাষায় করোনা বলছে- মানুষ তুই অপরাধী রে...।
ইমরুল কায়েস : গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তা
রশধুবংহনৎ@ুধযড়ড়.পড়স