অপরাধ দমনে ক্রসফায়ার কি সার্থক
ওয়াসিম ফারুক
🕐 ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৫, ২০২০
গ্রিক পুরাণের দেবতা-যোদ্ধা হারকিউলিস সম্পর্কে অনেকেরই কম-বেশি ধারণা আছে। টেলিভিশন সিরিয়াল বা বিভিন্ন গল্পে হারকিউলিসের কথা উঠে এসেছে। গত বছর হুট করেই আমাদের দেশে তথাকথিত হারকিউলিসের আবির্ভাব। পিরোজপুর সাভার ও ঝালকাঠিতে চিরকুটের মাধ্যমে হারকিউলিস তার অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়েছিল তথাকথিত কয়েকজন ধর্ষককে হত্যার মধ্য দিয়ে। খুন হওয়া ওই মানুষগুলোকে তথাকথিত ধর্ষক বলছি এই কারণে, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত থেকে যতক্ষণ না একজনকে অভিযুক্ত করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা আইনসিদ্ধ নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হারকিউলিসকে যেমন খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে তেমন ধর্ষণ বন্ধেও ব্যর্থ। প্রতিনিয়তই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয় ধর্ষণের খবর। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করেছিল আমাদের পুলিশ বাহিনী। শুনে প্রথমে কিছুটা স্বস্তি পেলেও পরক্ষণেই চিন্তা মাথায় চেপে বসে। এটা কোনো স্বস্তির খবর হতে পারে না। রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন পথে নেওয়া ও নয়ন বন্ডদের গডফাদারদের রক্ষার জন্যই তো তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে নয়ন বন্ডকে হত্যা।
সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা ফারুক বিমানবন্দর পার হয়ে দেশ ছাড়ার জন্য বিমানে চেপে বসেছিল দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীও একই বিমানের যাত্রী। বিমানের ভেতর তিনি কালা ফারুককে দেখে ঝাপটে ধরে বিমান থেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য করেন। পরে কালা ফারুককে গ্রেফতার এবং ওই দিনই গভীর রাতে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়ে মরতে হয়। কালা ফারুকের মৃত্যুর পর লোক মুখে তৎকালীন সময়ের বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী বহুল আলোচিত ছিলেন কালা ফারুকের গডফাদার হিসেবে। তাকে রক্ষার জন্যই নাকি কালা ফারুকের এমন পরিণতি।
২০০২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সারা দেশে শুরু হয় ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান। তখন জিজ্ঞাসাবাদের নামে কথিত ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা যায় প্রায় শ’খানেক মানুষ। যাদের বিরাট অংশ তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। পরে দেশি ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট বন্ধ করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। এরপর ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের নামে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠা করে। এরপর থেকেই ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি আমাদের মাঝে ব্যাপক পরিচিতি পায় ও আতঙ্কের জন্ম দেয়। বিভিন্ন সময়ে র্যাবের বিরুদ্ধে নিরীহ মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা ও হত্যার হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। যে সব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল বা আছে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও আক্রোশ। যার প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের র্যাব সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সাত খুন। যদিও ওই খুনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে তারপরও মূল হোতা এখনো নাকি ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে। ওই মূল হোতা ও তার পরিবারের ওপর নাকি আছে বহুল ক্ষমতাধরের আশীর্বাদ।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি, অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর দুই-তিন মাসের মধ্যেই ব্যাপক মাদকবিরোধী অভিযানে দুই শতাধিক সন্দেহভাজন নিহত হন, আটক হন হাজার হাজার মানুষ। তখন অভিযোগ উঠেছিল, কেবল সাধারণ মাদক সন্দেহভাজনই নয়, সাধারণ নিরীহ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরাও এসব হত্যাকাণ্ড ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে টেকনাফের যুবলীগ নেতা ও পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যা। র্যাবের কথিত ক্রসফায়ারের সময় টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হকের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোনের একটি সচল থেকে গিয়েছিল। অন্য প্রান্তে সংযুক্ত থাকা তার স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনের সঙ্গে। আর তাতেই রেকর্ড হয়ে যায় হত্যাকা-ের আদ্যোপান্ত। ঐ অডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। আজও একরাম হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে ব্যর্থ আমাদের সরকার।
গত ৩১ জুলাই ২০২০ রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। কক্সবাজার পুলিশের দাবি, পুলিশ চেকপোষ্টে মেজর (অব.) সিনহার গাড়ি তল্লাশি করতে চাইলে তিনি নিজের ব্যক্তিগত অস্ত্র বের করেন। এ সময় আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি করে। পরে তার গাড়ি তল্লাশি করে জার্মানিতে তৈরি একটি পিস্তল, নয়টি গুলি, ৫০টি ইয়াবা, দুটি বিদেশি মদের বোতল এবং চার পোটলা গাঁজা উদ্ধার করেছে। ওই গাড়িতে থাকা অন্য কজন এবং নীলিমা রিসোর্ট থেকে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেজর ( অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা আর এই চ্যানেলের জন্য ভ্রমণবিষয়ক তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্যই মেজর (অব.) সিনহা ও তার সঙ্গীরা কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন।
ইতোমধ্যে এই ঘটনার জন্য টেকনাফের পুলিশের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ বিশ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (যুগ্ম সচিব) অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন), চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রাম। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেনÑ ২. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি, (জিওসি, ১০ পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া কমান্ডার, কক্সবাজার এরিয়া কর্তৃক মনোনীত), ৩. উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক, চট্টগ্রাম রেঞ্জ, চট্টগ্রামের উপযুক্ত প্রতিনিধি, ৪. মোহা. শাজাহান আলি, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার। আমরা এখনো নিশ্চিত নই মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার কী ধরনের বিচার হবে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির দেওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ২১৮টি বন্দুকযুদ্ধেও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ঘটেছে ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন মানুষ। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৩৫৬ জন।
কক্সবাজার তথা সমগ্র বাংলাদেশে ইয়াবা তথা মাদক ব্যবসায় যার নাম সর্বপ্রথম চলে আসে তিনি হলেন ওই এলাকার দুই বারের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ আব্দুর রহমান বদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তাকে সবসময় বাংলাদেশের ইয়াবার মূল হোতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহে যে তালিকা প্রণয়ন করে তাতে বদিকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় তার নাম শীর্ষে দেখানো হয়েছে। তারপরও অদৃশ্য কারণে বদি ও তার পরিবারের সদস্যরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বরং বর্তমান সরকার বির্তক এড়াতে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আব্দুর রহমান বদির পরিবর্তে তার স্ত্রী শাহিনা আক্তার চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য করে আনে।
২০০২ সালের তথাকথিত হার্ট অ্যাটাকে বা ২০০৪ সাল থেকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- চলে আসছে তাতে কি আমাদের দেশের অপরাধের গতি মোটেও কমেছে? না। বরং অপরাধের ধারা পাল্টিয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশকে অপরাধীতে পরিণত করেছে। তাদের অনেককেই করেছে স্বার্থপর ও সম্পদলিপ্সু। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর দেখা মেলে নতুন অধ্যায়ের। লেখক গবেষক সমাজকর্মী রাজনীতিবিদ ছাত্র শিক্ষকসহ অনেকেই তথাকথিত সাদা পোশাকধারীদের হাতে অপহরণ হতে হয়।
অনেকেই সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এলে অনেকের সন্ধান আজও অজানা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এটা কখনোই সুখকর হতে পারে না। আমাদের সংবিধান প্রতিটি মানুষের ন্যায় বিচার পওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংবিধানের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য আমাদের কর্তাব্যক্তিরা শুধু জাতীয় নির্বাচনের সময়ই মরিয়া হয়ে ওঠেন। বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার যেটাই বলি না কেন এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্র বা তার নাগরিকরা সমর্থন করতে পারে না। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরাও এই ধরনের হত্যাকে ঘৃণা করি। তাই চাইব, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করে মানুষের অধিকারের ও আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে।
ওয়াসিম ফারুক : কলাম লেখক
[email protected]